সুমন রহমান লিখছেন প্রায় তিন দশক। প্রথম বই ঝিঝিঁট, লিখেছেন ঈশান জয়দ্রথ নামে। সেই বই আর প্রকাশনা নিয়ে আছে নানা কিংবদন্তী! তিনি মনে করেন, কাব্য প্রক্রিয়ার উপর নিজের জীবনকে সামান্য বসাতে পেরেছিলেন। ফলে জীবন তার কাছে দুর্বহ হয় নি। লিখেছেন পরিমাণে খুব কম। কবিতা গোটা চল্লিশ! ঝিঝিঁট ছাড়া একটা কবিতার বই, ‘সিরামিকের নিজস্ব ঝগড়া’। এবার বইমেলায় এলো নির্বাচিত কবিতা। আদতে যা কবিতা সমগ্রই বলা যায়৷ ‘গরিবি অমরতা’ আর ‘নিরপরাধ ঘুম’ তার গল্পের বই। একমাত্র প্রবন্ধের বই ‘কানার হাটবাজার’। শাহাদুজ্জামানের সাথে যৌথ সম্পাদনায় ‘দেখা না-দেখার চোখ’ দৃষ্টি সংবেদনশীলতা নিয়ে লেখার সংকলন।
পড়েছেন দর্শন, উন্নয়ন অধ্যয়ন ও সাংস্কৃতিক অধ্যয়নে। শিক্ষকতা করেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহ সুমন রহমানের। নিজের কাজের বাইরেও সাহিত্য, বইমেলা, পপুলার কালচার ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেছেন চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে…
এই মেলায় আপনার নতুন বই নাই বলতে গেলে। কিন্তু এইবারেই আপনি সবচেয়ে বেশি হাজির। আপনার প্রায় সব লেখালেখি পাওয়া যাচ্ছে। নির্বাচিত কবিতা এলো। কবিতার বইটা নিয়েই আলাপ শুরু করা যাক। অনেকের কাছেই ঈশান জয়দ্রথ তেমন পরিচিত না। যদিও তার নামে নানান কিংবদন্তী। আপনার বইয়ে সেসব দেখলামও। যেন সুমন রহমানের সাথে একটা রফার ব্যাপার। আপনি ঈশান জয়দ্রথের কথা বলুন, হে সুমন রহমান…?
ভালো বলেছেন। নতুন কোনো লেখা নাই। কিন্তু চার-চারটা বই! কাণ্ডই বটে। কোনো পরিকল্পনা থেকে করি নি। হয়ে গেল আর কি। সবটাই প্রকাশকদের বদান্যতায়।
ঈশান জয়দ্রথ ‘ঝিঁঝিট’-এর কবি। ঐ বই লিখবার সময় আমার ওরকম একটি পারসোনা ছিল। বা ছিল বলে মনে করতাম। সেটা আমি একা একা বানাই নি। ঈশান জয়দ্রথ নামে একজন কবির গল্প বানিয়ে শোনাতাম বন্ধুদের। পরে যখন বই করতে যাই, বন্ধুরা কেউ আমাকে ছাড় দিতে রাজি হলেন না। তাদের নস্টালজিয়া আর কল্পনাশক্তিকে সমীহ করবার জন্যই আমাকে ঈশান জয়দ্রথ হয়ে থাকতে হল। এটা খুব আহামরি কিছু না। খুচরা দ্বৈতবাদ বলে উড়িয়েও দেয়া যায়। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি পারি নি। আমাকে খুব রক্তাক্ত বোঝাপড়া করতে হল। বইতে এ নিয়ে একটা দীর্ঘ গদ্য আছে। ফলে কথা না বাড়াই।
আপনার নির্বাচিত কবিতা নামে যা বের হলো, একার্থে কবিতা সমগ্রই। চল্লিশটার মত কবিতা, এত সামান্য পরিমাণে লেখা। কেন? কেন এমন ‘মেঘমেদুর মেটান্যারেটিভ’?কয়টা কবিতা আপনারা মনে রেখেছেন প্রিয় কবিদের? সবচে বেশি হয়ত রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দেরই হবে। তাও গোটা বিশেক হয় কি না দেখেন। আমাকে স্মৃতির ভেতর সম্পাদনা করবার প্রিভিলেজ খুব বেশি দিতে চাই নি পাঠককে। মে বি এটাই কারণ।
আপনি বলছেন, কাব্য প্রক্রিয়ার উপর আপনার বৈষয়িক জীবন চাপাতে পারছেন। এই যে সামনের জীবন, সেই জীবনে কবিতা ও জীবনের সম্পর্ক কেমন হবে? মানে বলছি মধ্যস্ততাকারী হিসাবে কবিতা আপনার (বা আমাদের) জীবনে কতটা কেজো আছে এখনও?
সেটা নিয়ে আমি সিরিয়াসলিই ভাবি। খুব সোজাসাপ্টা বলা মুশকিল। তবে ‘কেজো’ যে অর্থে মানুষ ব্যবহার করে, আপনি সেই অর্থে বলেন নি অবশ্যই। কবিতা জরুরি। জীবনের জন্য। আমার বৈষয়িক জীবনে আমি কবিতাকে খুব অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে দেখেছি। এটা দরকার ছিল। নয়তো এরকম নশ্বর আর রিক্ত জীবনের অনেকটা সময় কবিতাচর্চায় কাটানোর আফসোস জীবনেও মিটতো না। আমার সেটা কোনোদিনই হয় নি। খুব ব্যক্তিগত প্রাপ্তিযোগ আছে কবিতা নিয়ে, আমার। আমার পাঠক পর্যন্ত হয়ত সেটুকু পৌঁছে দিতে পারি নি। কিন্তু নিজে উপভোগ করেছি। এই আনন্দের তুলনা নাই।
আপনার গল্পের বই দুটো। ‘নিরপরাধ ঘুম’ বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। পুরস্কারসহ। তো এর বাইরেও সাহসের ব্যাপার আছে। গল্পের ফর্মে জাদুবাস্তবতার একটা চেহারা আছে। আবার ক্ষমতার ক্রিটিক আছে। ক্রসফায়ার প্রসঙ্গটা। ‘গরিবি অমরতা’র ‘বয়স আমার বাড়েনা’তেও এই ব্যাপার আছে। তো ক্ষমতাকে লেখক হিসেবে আপনি কেমন করে ডিল করেন? আমাদের এখানের রাজনীতিকেও। সব মিলিয়ে যদি আপনার লেখালেখির ভিতর থেকে বলতেন।
জাদুবাস্তবতাকে আমি ফর্ম হিসেবে চর্চা করি না। নিরপরাধ ঘুমে যেটি দেখছেন সেটি টুইস্ট। কিন্তু এই টুইস্ট এত বেশি পলিটিক্যাল যে, মনে হয় জাদুবাস্তবতা।
আর ক্ষমতার ক্রিটিক করা সাহিত্যের ঈমানী দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এমন কি রাজ্যসভার কবি গোপাল ভাঁড়ও রাজদরবারে বসে ক্ষমতার ক্রিটিক করেছেন। আপনার পাঠক ক্ষমতাহীন। ক্ষমতাপিষ্ট। শুধু চোখ-ধাঁধানো নান্দনিক সৌকর্যই তার কাম্য নয়। অনেক কিছু চায় সে। যে সমাজের গল্প আপনি বলছেন, সেখানে কোথায় আপনি দাঁড়িয়ে এটা সে খুব মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করে। আপনি যদি খুব বেশি সুবিধাজনক (ক্ষমতার অর্থে) দাঁড়ান, তাতে পাঠকের সমীহ হবে, কিন্তু ‘সাহিত্য’ (সহিত অর্থে) হবে না। সে কারণেই অতি উচ্চ সাহিত্যমূল্য থাকবার পরেও নাযিল হওয়া ধর্মগ্রন্থগুলো সাহিত্য নয়। আজকাল অনেক কৃত্যবিদ সাহিত্যিককে ঐ ধরনের ঐশ্বরিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখি। তারা আসলে চোখ ধাঁধাতে আসেন। ক্ষমতার ক্রিটিক আপনাকে দাঁড়ানোর মত জমিন দেয়। ফলে আইভরি টাওয়ার থেকে আপনার সাহিত্যিক ইগো মাটিতে নামার সুযোগ পায়।
আপনার লেখায় একটা জিনিস খুব প্রকট। মানে প্রকটই বললাম। খুব উইট। আমাদের ট্রেডিশনাল সাহিত্যিক সিরিয়াস মুডটা গড় হাজির। নমুনা হিসেবে ‘গরিবি অমরতা’র নাম গল্পটা নেয়া যায়। বা যে কোনোটাই। পরের বইতেও এটা সত্য। তো আপনি এই ভঙ্গিতে লেখতে গেলেন কেন?
সিরিয়াস মুড বলতে যা বোঝাচ্ছেন, ওটা আমার মুড নয়। আমার গল্প খুব ব্যথাদীর্ণ।চরিত্রগুলোর কথা বলছি। এই বেদনাবোধ কোনো সুখী সুন্দর জীবনে হঠাৎ করে নেমে আসা বেদনাবোধ নয়। খেয়াল করে দেখবেন, তারা অনন্তকাল ধরেই এই বেদনার বলয়ের মধ্যে বেঁচে আছে। এবং বেঁচে থাকবে। উইটের জন্ম হয় এখানে। যখন আপনি বুঝতে পারছেন, অপার বেদনাই আপনার নিয়তি। তখন আপনি অশ্রুসিক্ত হৃদয়ে জীবনকে উপভোগ করতে শুরু করেন। এটাই আমার জীবন। ফলে এটিই আমার ভঙ্গি।
আপনার গল্পে ভাব আর ভাষা দুই জায়গাতেই আমার কাছে ‘অপ্রমিত’ ঠেকে, ভাব বলতে আপনার কন্টেন্ট, চরিত্র, তাদের আচার ব্যবহার ইত্যাদি আইডিয়াল মধ্যবিত্ত না। তাই বললাম। ‘মিস্টার প্রফেসর’ হিসেবে এগুলো ঝামেলা তৈরি করে না? করলে কী রকম? না করলেই বা সেই ক্ষেত্রটা কেমন করে তৈরি করছেন?
প্রথমত ‘প্রফেসর’ খুব অভিজাত পরিচয় কিনা আমার সন্দেহ আছে। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় আপনার আভিজাত্য নির্ধারিত হয় ব্যাংক একাউন্ট দিয়ে। ফলে প্রফেসরের সেই হিসেবে তলানিতেই থাকবার কথা। তবু প্রফেসর বিষয়ে আমাদের যে একটুখানি হালকা সমীহ আছে, এটা প্রি-ক্যাপিটালিস্ট যুগের মিথ। হা হা হা!
ভাব ভাষা নিয়ে যা বললেন, ঐ যে ‘অপ্রমিত’ ভাষার বিষয়টা, এটাও এসেছে ক্ষমতার ক্রিটিক থেকে। আপনি আগে যেমন বলেছিলেন। ক্ষমতা তো ভাষাব্যবস্থার মধ্য দিয়েই পারসিভড হয়। ফলে, বিকল্প ভাষাব্যবস্থার মাধ্যমেই তাকে ক্রিটিক করতে হবে। চ্যালেঞ্জ করতে হবে।
নাগরিক সমাজ থেকে ভূমির দূরত্ব সামান্য হলেও আমাদের সাহিত্যে আল্ট্রা পুউর আরবানরা খুব কম হাজির। যেটা ধরেন গ্রামের হতদরিদ্ররা আছে। তো গল্পের বিষয় হিসেবে একটা বড় অংশে আপনি শহুরে হতদরিদ্র ও তাদের জীবন নিলেন। তাদেরকে যে দেখা দেখির বিষয়টা, রিয়েলেস্টিক করার ক্ষেত্রে, এটার স্কোপগুলা কই আপনার? আপনিও তো শিক্ষিত মধ্যবিত্তই, শ্রেণিকরণ করতে গেলে?
আমি নিজেও আরবান পুউর। গ্রাম থেকে শহরে এসেছি। ফলে অবস্থানগত জায়গা থেকে তাদের খানিকটা বুঝতে পারি। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হওয়ায় বুঝতে সমস্যা হবে কেন? আরবান পুউর মানে কিন্তু ঠিক হতদরিদ্র না। তাদের একটা বড় অংশ অর্থনৈতিকভাবে নিম্নমধ্যবিত্ত। সাংস্কৃতিকভাবে মধ্যবিত্ত। ঘরে পর্দা টাঙায়। ফ্রিজ আছে। স্মার্টফোনে ওয়াইফাই কানেকশন আছে। ফ্ল্যাট টিভি আছে। হানিমুনে কক্সবাজার যায়। জি-টিভি দেখে। শহুরে নিম্নবর্গের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে গত এক দশকে। সবচে ইন্টারেস্টিং হচ্ছে, তাদের রূচি এখন অনেকাংশে শহরের সাংস্কৃতিক রূচিকে শাসন করছে। খুব নিরবে। কোনোরকম আওয়াজ না দিয়ে। এটাই আরবান পুউরের সাংস্কৃতিক রাজনীতি।
আমাদের সাহিত্যের ব্যাপারটা ভিন্ন। এতকাল আমাদের সাহিত্যের কনটেন্ট নির্ধারিত হয়েছে মার্কসবাদী চিন্তাচেতনা থেকে। সেই চেতনায় আরবান পুউর হচ্ছে ‘লুম্পেন প্রলেতারিয়েত’। গরিব, কিন্তু বিপ্লবী হয়ে উঠবার কোনো সম্ভাবনা নাই এদের। ফলে মার্কসবাদীগণ এদের নিয়ে আগ্রহী নন। বিপ্লব আসবে গ্রাম থেকে। নয়ত কারখানা থেকে। মার্কসবাদী অরিয়েন্টেশন নিয়ে আরবান পুউর বিষয়ে খুব ইতিবাচক থাকার সুযোগ নাই। ফলে, চোখের সামনে থাকলেও এমন একটা ‘অবৈপ্লবিক’ জনগোষ্ঠী নিয়ে সাহিত্যিকবৃন্দ তেমন উৎসাহ পান না।
মজার একটা কথা বলে নেই, এইটা আমার ক্ষেত্রে ঘটছে। এরশাদ সাহেব যখন নানান কিছুতে রাজি হয়ে যাচ্ছিলেন জেলের ভয়ে তখন আপনার ‘নয়টা পঞ্চাশ’ গল্পের কথা মনে হতো আমার। সিরিয়াসলি। তো আমার মনে হয়েছে, সুযোগ পেলে আপনাকে জিজ্ঞেস করবো, জামান সাহেব কাকে মাথায় রেখে বানাইছিলেন?
একজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন। নাম না বলি। এরশাদ অবশ্য অতখানি জবুথুবু হয়ে যান নি মরবার আগে।
দৃষ্টিসংবেদন বিষয়ে সাহিত্য নিয়ে আপনাদের বই, দেখা না-দেখার চোখ। বইটা ছিল না অনেক দিন। আবার বাজারে এলো। দৃষ্টি সংবেদনশীলতাকে কেন্দ্রে রেখে একটা বই করার ইচ্ছা বা প্ল্যান কোথা থেকে? থাকে না একটা লক্ষ্য কোনো কাজের, যেহেতু সম্পাদনা করছেন। তো জানতে চাই এই বইটা করার বিশেষ কী উদ্দেশ্য ছিল?
এটি আমি যৌথভাবে সম্পাদনা করেছি বিশিষ্ট লেখক এবং আমার শিক্ষক শাহাদুজ্জামানের সাথে। বইটা কেন করেছি, বইয়ের ভূমিকায় বিস্তারিত বলেছিও। সাহিত্যিকেরা কীভাবে দেখেন, কীভাবে ‘অদেখা’কে দেখেন। দৃষ্টিসংবেদন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবেদন নিশ্চয়ই। সেটির একটা সাহিত্যিক অডিট করবার উদ্দেশ্য ছিল আমাদের, বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষাপটে।
দর্শনে পড়ছেন, কমিউনিকেশনেও। আবার আগ্রহ বিচিত্র বিষয়ে, পপুলার কালচার তার একটা যদি আমি ভুল না করি। যখন কাসেম বিন আবুবাকারকে নিয়ে হাইপ উঠলো, তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মত নিয়েছেন, মানে একার্থে মত উৎপাদন করছেন। আবার আপনি উনাকে কেন্দ্রে নিয়ে গল্পও লিখছেন। ঐদিন আড্ডায় হিরু আলমের বই নিয়ে বলছিলেন। এই ব্যাপারগুলা তো মধ্যবিত্ত শিক্ষিতরা একটা উন্নাসিক জায়গা থেকে দেখেন। সেখানে এই প্রপঞ্চগুলোর সাথে সরাসরি জড়িয়ে যাওয়াকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? এটা কেন?
আমি জনসংস্কৃতির পাঠক। কাসেম বিন আবুবাকার বা হিরো আলম আমার কাছে সাহিত্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নন। কারণ আমার সাহিত্যরূচিও মধ্যবিত্ত-শাসিত। কিন্তু আমি তাদের পড়ি বৃহত্তর সমাজের পালস বুঝবার জন্য। পপুলার কালচার দিয়ে সেটা বোঝা যায়। আবার পপুলার কালচার মানেই নিম্নবর্গ সমাজের রেপ্রিজেন্টেশন না। এখানেও একটা উৎপাদনব্যবস্থা আছে। উৎপাদকশ্রেণী আছে। কে কার জন্য বানাচ্ছে, এটাও বুঝতে হয়। ‘জড়িয়ে যাওয়া’ বলতে আপনি কী বোঝালেন ঠিক বুঝি নি। যদি ‘পাঠ করা’ অর্থে বলেন, অতি অবশ্যই আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পাঠ করি।
আপনি একটা আলাপে বলেছিলেন মাধ্যম হিসাবে লেখ্য মাধ্যমের হুমকির কথা৷ অডিও ভিজ্যুয়াল মাধ্যমের প্রাধান্যের সময়ে উপন্যাস বা গল্পের ক্ষত্রে তার একটা যোগ্যতা হওয়া উচিত অডিও ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে প্রায় প্রকাশের অসম্ভব্যতা। নইলে মানুষ পড়বে না, সেই গল্পটা নয়া মাধ্যমে দেখে নিবে। তেমন অসম্ভব্যতার নমুনা হিসাবে ‘গড অব স্মল থিং’-এর কথা বলছিলেন। এটার কাব্যগন্ধি গদ্য ও জটিল কন্টেন্টের কথা। সেই জায়গা থেকে আপনি আপনার বা বাংলাদেশের অপরাপর লেখাকে কেমন করে দেখেন, যেগুলা আপনার নজরের মধ্যে অন্তত?
বেশিরভাগই কাহিনি-নির্ভর। ফলে ক্যামেরা দিয়ে তাদের পুনর্কথন সহজে সম্ভব। কাহিনিমাত্রই সাহিত্য না। সাহিত্যের ইউনিক সিগনেচার আছে। সেটা থাকলে অপরাপর মাধ্যমে তাকে পাচার করে দেয়া কঠিন হয়ে উঠবে। অসম্ভব না। কিন্তু কঠিন। পাচার করলে হবে না। পুনর্সৃজন করতে হবে। সেটি স্বাস্থ্যকর। দুপক্ষই লাভবান হয়।
একই জিনিস সিনেমার দিক থেকেও ঘটে। তারকোভস্কির নস্টালজিয়া কিংবা বুনুয়েলের মিল্কিওয়েকে পুস্তকে পাচার করার চেষ্টা করুন। ক্লিশে হতে বাধ্য। কারণ, তাদের ইউনিক সিনেমাটিক সিগনেচার।
আলাপ দীর্ঘই হয়ে গেলো কিছুটা। বইমেলা কেন্দ্রিক আলাপ করার কথা। মেলায় ফিরে আসি। আমাদের এই ফেব্রুয়ারির মেলাকে আপনি কেমন করে দেখেন? সোশিও কালচারাল, আবার বাণিজ্যিক জায়গা আছে এইগুলোর সাথে সাহিত্যের জায়গাটাসহ। মানে মেলা সম্পর্কিত আপনার অভার অল চিন্তাটা জানতে চাইছিলাম…
মেলা ভাল জিনিস। যদিও বাণিজ্য বিশেষ নাই। একটা বহুজাতিক কোম্পানির সিইওর বেতনভাতা সম্ভবত বাংলাদেশের গোটা পুস্তকশিল্পের জিডিপি থেকে বেশি। ফলে, মায়াবি পুঁজির নজর এই সম্ভাবনাময় কিন্তু অবহেলিত সেক্টরে পড়তে শুরু করেছে। সাহিত্যচর্চাকে ক্ষমতাচর্চার বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে উপভোগ করবার লোকেরও অভাব নেই। বইমেলা মূলত এসব দেখবার একটা ইউনিক চিড়িয়াখানা। নানান চাপে ও তাপে মানুষ বই কেনে। বই কেনা আমাদের দেশে আস্তে আস্তে সামাজিক চর্চার অংশ হয়ে উঠছে। আশা করা যায় বই পড়াও একসময় আমাদের সামাজিক চর্চার অংশ হয়ে উঠবে।
শেষ করা যাক, লেখালেখি নিয়ে আপনার সামনের পরিকল্পনা কী?
নানাবিধ পরিকল্পনা আছে। তবে পরিকল্পনার বাইরে যা ঘটে তাইই সাহিত্য। কে যেন বলেছেন, পরিকল্পনা গোপন রাখতে পারাই সৃজনশীলতা। আজকেই কোথায় পড়লাম। এটা না পড়লে গড়গড় করে নানাবিধ পরিকল্পনার কথা এখন আপনাকে বলতে পারতাম।