বইমেলার সবখানে সমান আলো পড়ে না। সমান ভীড় হয় না। কোথাও কিছু গলদ থেকে যায়। অন্তত পঞ্চাশটি স্টল (প্যাভেলিয়ন) সন্ধ্যার পর হায় হায় করে। ভাষাটি মনে হয় ঠিক হলো না। কারণ, যারা প্রকাশনা ব্যবসায় যুক্ত তাদের বেশিরভাগই মুখে বাণিজ্যের গন্ধ রাখতে চান না।
বইমেলার উত্তর প্রান্তে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর গিয়ে এক শ্মশানসম পরিবেশ দেখলাম। স্টলে স্টলে অন্যরকম শূন্যতা। এক প্রতিশ্রুতিশীল প্রকাশক বইমেলার আগে যেসব স্বপ্ন বুনেছিলেন, উত্তরপ্রান্তের এই মন্দা আবহাওয়ায় কুঁকড়ে গেছে সেসব স্বপ্ন। বলেই ফেললেন, ‘পাঠক আসছেন না। বিক্রি বাট্টা থাকলে আলাদা এক উৎসাহ থাকে। পাঠক না আসাতে আমরা গুটিয়ে গেছি। আমরা বইমেলার এক প্রান্তের ভীড় আর অন্যপ্রান্তের এই শূন্যতার ভেতর অনেকটা উপায়হীন বসে আছি। এমনই এক ক্ষেত্র, যেখানে চাইলেই লোক সমাগম বাড়ানোর মতো কোনো প্রচারণা সম্ভব নয়।’ তার দীর্ঘশ্বাস কেন যেন আমার গায়ে এসে লাগলো। আমি তার প্রতি সমব্যথি ভাব নিয়ে চলে এলাম।
একজন সুপ্রতিষ্ঠিত প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী তার স্টলে বসেছিলেন। একই শূন্যতা। ক্রেতা নেই। পাঠক দর্শক নেই। বললাম, কী অবস্থা ভাই? বললেন, খুবই ভালো। আমি বললাম, ‘আপনারা মনে হয় এক কর্ণারে পড়ে গেছেন!’ তিনি বললেন, “না ঠিকই আছে। বইমেলা মানেই তো বিক্রির ব্যাপার নয়। বইমেলা হলো মেলা। এখানে মানুষের আনন্দ বিনোদনটা অনেক বড় বিষয়। মানুষের বিনোদনের সঙ্গে আমরা যুক্ত আছি। ভালো লাগছে।”
তিনি বললেন বটে। বোঝা গেল কিছু কথা মনের ভেতর থেকে গেল। সেগুলো উপযুক্ত ভাষা পেল না। আমার মনে হয়, তিনি বলতে চাইলেন, বইমেলার সবখানে সমান আলো পড়েনি। যারা বইমেলার নকশা করেন, অবকাঠামো পরিকল্পনা করেন এটি তাদের কাজ। তারা চাইলেই বইমেলার প্রতিটি ক্ষেত্রকে সমান গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারেন। আমরা নকশাকার ও স্থপতির কোনো ত্রুটি ধরতে চাই না। তারা যেটুকু করেছেন, তা অনেক। এটুকুর মধ্যেই বিপুল সৃজনশীলতা আছে। বইমেলার রং ও আবেশ আছে। আছে আবহ। এখানেই দর্শক পাঠক এসে আনন্দমেলার স্বাদ পাচ্ছেন।
তারপরও মনে হয় অনেক কিছু হতে পারতো। সব প্রান্তেই রাখা যেতে পারতো আকর্ষণীয় কিছু। লটারিতে যে প্রকাশক যেখানে তার বরাদ্দ পেয়েছেন, সেখানেই বসেছেন। এ ব্যাপারে তিনি তার ভাগ্যবরণ করে নিয়েছেন। কিন্তু সারা বইমেলায় সমান আকর্ষণ ছড়িয়ে দেয়া, সমান আকর্ষণের বিন্যাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যের জায়গাগুলো ছড়িয়ে দেয়া যেত সারা মেলায়। যে দিকটায় লোক উপস্থিতি নিয়ে সংশয় উপলব্ধ হয় সেদিকটায় গড়ে তোলা যেত বিশেষ কোনো ব্যবস্থা। এগুলো সংশ্লিষ্টরাই ভালো বলতে পারবেন। তারা গভীরভাবে ভাবতে পারেন।
বইমেলার মৌসুমে একজন প্রকাশক অনেক বেশি প্রাণিত হতে পারেন। বাণিজ্যিক যশ ও প্রসারের ভেতর গিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখতে পারেন। স্টলে লেখক, পাঠকদের ভীড় বাঁধলে শুধু বই বিক্রি হয় তাই নয়, অনেকের চোখে অনেক কিছু ধরা পড়ে। প্রকাশকের কাজটি সারা বছরের। সারাবছর তাকে বই প্রকাশ করতে হয়। বই বিপণন করতে হয়। বইমেলা তাদের সে সম্ভাবনার জায়গাটি তৈরি করে। আমার মনে হয়, এসব বিষয় গভীরভাবে ভাবা উচিত। বইমেলার সবখানে সমান আলো ফেলার ব্যবস্থাটি আগামীবার নিশ্চিত হবে আশা করি।
কেউ উচ্ছ্বাসে থাকবে, কেউ থাকবে হতাশায়, এটি কোনো মেলার ধরণ হতে পারে না।