চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ফ্রান্সের রঙে বিতর্ক ফেসবুকজুড়ে

ফ্রান্সে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় শোক প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারে তুলে ধরছেন ফ্রান্সের পতাকার রঙ। কিন্তু এর ফলে এরই মধ্যে দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছেন পুরো ফেসবুকারদের দল।

যাদের একদল প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তনের মাধ্যমে ফ্রান্সের এই হামলায় সহমর্মিতা প্রকাশে উৎসুক। তেমনই অন্যদলের দাবী কেউ তো লিবিয়া, সিরিয়া বা আফগানিস্তানে হামলার পরে তাদের পতাকার রঙে নিজেদের প্রোফাইল পিক রাঙাইনি। তাহলে ফ্রান্সের ক্ষেত্রেই কেন এমন হবে।

ফেসবুকে বিতর্কটা বেশ জোরালো। লেখিকা অদিতি ফাল্গুনীর মতামত অবশ্য এই পরিবর্তনের পক্ষেই। তার মতে অন্যান্য দেশগুলোর চেয়ে ফ্রান্সকে যে আমি একটু বেশি গুরুত্ব দেবো সেটাই স্বাভাবিক। সাকিব আল হাসান বা এ্যাঞ্জেলিনা জোলি বা যে কোনো সেলিব্রিটি আপনার-আমার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। শিল্পকলা, চলচ্চিত্র, সাহিত্যে, মুক্তবুদ্ধির লড়াইয়ে ফরাসীদের গুরুত্বটা একবার ভাববেন না? ব্যক্তিগতভাবে ফিলিস্তিনের ঘটনার পর তৃতীয় বিশ্বের এক নাগরিক হিসেবে যা যা করার ছিল আমি করেছি।

এই লেখিকা আরো বলেন, কোনো দেশের কোনো মৌল সমস্যা বা নিজের দেশের সমস্যা নিরসনের ক্ষমতা আমার নেই। তাতে ‘ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সর্দ্দার’ এই লেখক-কবি সম্প্রদায়ের আমরা ত’ হিসেবের বাইরে। আমরা হয়তো ফিলিস্তিনে বোমা হামলা হলে বড়জোর তাদের কবিতা অনুবাদ করতে পারি বা ফ্রান্সে হামলা হলে পতাকার রঙে প্রোপিক বদলাতে পারি। হত্যা জাস্টিফাই না করাটাই ভালো বলে মনে করি।

চলচ্চিত্র পরিচালক ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী অবশ্য মনে করেন সব খুনের রঙ এক। তাই একদলের জন্য নির্বাচিত শোক করার পক্ষপাতি নন তিনি। তার মতে, পৃথিবীর সব মানুষের খুন যদি আপনাকে পীড়া না দেয়, এর চেয়ে দুঃখের আর কিছু নাই।

আর পশ্চিমারা যদি নির্বাচিত শোক করে থাকে, আপনারাও এখন সেই একই অপরাধ করছেন প্যারিসের নিরপরাধ মানুষের খুনে `হৃদয় বিদারক নৈর্ব্যক্তিকতা’ বা ক্ষেত্রবিশেষে `অসহায়ত্ব উপভোগ’ করার মধ্য দিয়ে।

পৃথিবীর সব মানুষের খুন যদি আপনাকে পীড়া না দেয়, এর চেয়ে দুঃখের আর কিছু নাই। দুঃখিত, আমি হয়তো রাজনীতি সচেতন নই, বিপ্লবীও নই। প্যারিসের মানুষের অসহায়ত্ব আমাকে বিপন্ন করে। সিরিয়ার মানুষের অসহায়ত্বও আমাকে বিপন্ন করে। দুই দলের পরিবর্তে যদি একদলের জন্য শোক করতে পারতাম। কমে যেতো আমার বিপন্ন সময়ের ভার।

তবে এমন সব বিতর্কের পরে যারপরনাই বিরক্ত সুরকার আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ। এই বিষয়ে নিজের ক্ষোভটাও প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, ইসলামের কথা বললে ছাগু, সরকারের বর্তমান পরিস্থিতির সমালোচনা করলে বিম্পী, ধর্ম নিয়ে বিতর্কে গেলে নাস্তিক, প্রোফাইল পিক পাল্টালে মূর্খ, সত্য কথা লিখলে ভন্ড। কোনদিকে গেলে মানুষের পক্ষে হবো?

মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর বক্তব্যের সঙ্গে অবশ্য একমত বাংলাদেশের সাহিত্যিক মইনুল আহসান সাবের। এই বিষয়ে তার মন্তব্য, ফ্রান্সে সাধারণ মানুষ মারা গেছে। ইরাক, গাজা, লিবিয়া, সিরিয়াসহ আরও বহু জায়গায় ঘটনা ভিন্ন নয়। তবে এবার যেন ১২৯ জনের মৃত্যু আমাদের বেশি ধাক্কা দিল! ফরাসিরা সংস্কৃতিবান বলে? জ্ঞানের প্রদীপ নিয়ে ঘোরাফেরা করে বলে? একদা আলজেরিয়া, মরক্কো, তিউনিশিয়া আর প্যাসিফিক অঞ্চলে, কিছুদিন আগে ইরাকে কী করেছিল, আমাদের মনে আছে? ধারণা আছে, আবার পুঁজির রক্ষা ও নিরাপত্তায়, প্রয়োজন পড়লে একা বা দলবেঁধে কী করবে?

প্রশ্ন উঠতেই পারে, এত এত সাধারণ মানুষের এমন করুণ মৃত্যু কেন মেনে নেব আমরা? না, মেনে নেব না। আমরা স্তম্ভিত হবো, লজ্জিতও। এ যে সমাধান না, এও বলব। যেমন বলেছিলাম, যদিও মিউমিউ করে, ইরাক ও লিবিয়ার সময়, যেমন বলি গাজার সময়, যেমন বলছি সিরিয়ার সময়।

তবে ফেসবুকে এমন মতামত প্রকাশকে ঠিক যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। তিনি বলেন, ফেসবুক সারা বিশ্বের মানুষের যোগাযোগের একটি প্ল্যাটফর্ম। সেটা তাই সবসময় নিরপেক্ষ থাকাই যৌক্তিক। ফেসবুকে এভাবে রাজনৈতিক বিষয়ে মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকাটাই অপ্রয়োজনীয়। প্যারিসে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক হামলা তো বিশ্ব রাজনীতিরই একটি অংশ। তাই সেখানে নিরপেক্ষতাই বেশি কাম্য।