সেদিন অনলাইনে নিউজ ঘাঁটছিলাম। হঠাৎ একটা নিউজে চোখ আটকে গেল। শিরোনাম ছিল ‘ফেসবুক হোয়াটস অ্যাপ থাকলে বউমা চলবে না!’ ঘটনাটা যদিও ভারতের। তবু নিউজটা পড়ে মনে হলো, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেও এমনটা শুরু হতে দেরি নেই।
নিউজের সূত্র ছিল, একটা পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন। যেখানে একজন সরকারী চাকরিজীবী পাত্রের জন্য পাত্রী চাওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞাপনটা এমন, পাত্রীর বয়স ১৮-২২ হলে চলবে। শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চমাধ্যমিক, দেখতে মানানসই। দাবি বলতে একটাই, ফেসবুক-হোয়াটস অ্যাপের নেশা থাকা চলবে না। আমাদের দেশে যৌতুকের দাবিতে এখনো মেয়েরা নির্যাতিত হয় শ্বশুর বাড়িতে। খুনের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। সেখানে এই শ্বশুর শাশুড়ির দাবি খুব একটা বেশি নয়।
প্রযুক্তির কল্যাণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন জনপ্রিয়। ফেসবুক হোয়াটস অ্যাপ ব্যবহার করেন না এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। তবে সেক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্ম এগিয়ে। ফেসবুক ছাড়া এক পা হাঁটতে পারে না ছেলে মেয়েরা। আগে আমরা স্কুল কিংবা কলেজে বন্ধুরা বসে আড্ডা দিতাম। কত গল্প খুনসুটি ছিল। কিন্তু এখন চারজন বসে থাকলেও সবার চোখ হাতে থাকা মোবাইলে। খেতে গিয়ে, পড়তে গিয়ে, বেড়াতে গিয়ে এমনকি টয়লেটে গিয়েও সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড এ আর নতুন কী!
ছোটবেলায় ভোরবেলা মা ঘুম ভাঙত রেওয়াজ করার জন্য। হারমোনিয়াম দিয়ে সকাল শুরু হতো আমাদের। সকালে রেওয়াজ না করলে মা বকা দিবেন এই ভয়ে ঘুম ভেঙে যেত। আর এখনকার ছেলেমেয়েরা ফেসবুক টিপে ঘুমাতে যায় ভোরবেলা! তারপর সারাদিন ঝিমুনি। ঝিমোতে ঝিমোতে স্কুল কলেজ অথবা অফিস। সারাদিনের কাজের মধ্যেও ফেসবুক। স্কুল শেষে বিকেলে আমরা খেলতে যেতাম বাইরে। সন্ধ্যায় স্যার বাসায় আসতেন পড়াতে। স্যার চলে যাওয়ার পর আবার দ্রুত পড়া শেষ করে টিভি দেখতে বসা। বিটিভিতে তখন সাপ্তাহিক নাটক হতো। ছায়াছন্দও দেখতাম। যেদিন সিনেমা থাকত সেদিন তো কথাই নেই। আমাদের বাসায় ভিড় জমে যেত। তখন খুব কম বাসায় টিভি থাকত। বাঁশের মাথায় এন্টেনা ঘুরিয়ে ছবি ক্লিয়ার করা সে সময় ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ। ওই বয়সেই আমরা ইংরেজি সিরিয়াল দেখতাম। ম্যাকগাইভার, দি এ টিম, দি ফল গাই, ওশিন। বৃহস্পতিবার ইংলিশ ছবি দেখতাম মুভি অব দ্যা উইক। আমি হলফ করে বলতে পারি এ প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা কেউ তেমন টিভি দেখে না। সবাই বসে থাকে ওই ফেসবুকে।
এখনকার ফেসবুক আর ইউটিউব জেনারেশন যতোই বিটিভিকে নিয়ে হাসাহাসি আর ট্রল করুক, এই বিটিভিই আমাদের অসংখ্য আবেগের স্মৃতি ধরে রেখেছে। বিটিভিতেই প্রথম কার্টুনের সাথে পরিচয় হয় পাপাই দিয়ে, এরপর থান্ডার ক্যাটস কত জনপ্রিয় ছিল সেটা শুধু আমরাই জানি। তখন ক্রাশ ব্যাপারটা না বুঝলেও এখন এটা ভালোমতো বুঝি যে, বিটিভিতে দেখানো সিনবাদে বা আলিফ লায়লার নায়িকারা ছেলেদের ক্রাশ ছিলো। রবিনহুড রোবোকপ সিরিয়াল অথবা নাইটরাইডারের নায়ক তখনকার অনেক মেয়েরই ক্রাশ ছিলো । হলিউডের মুভি দেখার সুযোগ তখন তেমন না থাকায় বিদেশী নায়ক-নায়িকা দেখার শুরুটা এসব সিরিয়াল দিয়ে হয়েছিলো আমাদের।
সাপ্তাহিক নাটকের পর এলো প্যাকেজ নাটক। ওই সময় যেদিন প্যাকেজ নাটক থাকত, রাতে কেউ হাতে কোন কাজ রাখতো না। বাড়ির ছেলেমেয়েরা আগেই পড়া শেষ করতো, মহিলারা ঘরের কাজ শেষ করতেন। নাটক শুরু হওয়ার আগে সবাই একসাথে বসে যেতেন টিভির সামনে। যেই এলাকায় তখনো সবগুলো বাসায় টিভি আসেনি, সেই এলাকায় থাকা টিভিওয়ালা বাসায় সেদিন প্রতিবেশীদের অঘোষিত দাওয়াত থাকতো। নাটক শুরু হতেই তারা এসে পড়তেন। বিছানায়, সোফায় জায়গা না পেয়ে মেঝেতেই পাটি পেতে বসার হিড়িক পড়তো। সবচেয়ে বড় আসর বসতো শুক্রবার বিকেল তিনটায়।
‘এবার দেখবেন পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি’-শুনতেই গা শিউরে উঠত। আহ! ভালো ছিল দিনগুলো, কোলাহল মাখা। কোথায় হারিয়ে গেল সেই সোনালি বিকেলগুলো? উত্তরটা আমার হাতে আছে। আপনারও জানা। নির্ঘাত ফেসবুক। প্রযুক্তি আসবে। তাকে মেনে নিতে আদিকালের মনটাও ঝেড়ে ফেলতে হবে। তাই বলে ওই প্রযুক্তির পেটে চলে যাওয়া যাবে না। পাত্রী চাওয়ার ওই বিজ্ঞাপনটা কিন্তু সেই কথাই বলছে। ফেসবুক নিয়ে নিশ্চয়ই পাত্রপক্ষের এমন কিছু অভিজ্ঞতা আছে, যেটা তাদের ওভাবে বিজ্ঞাপন দিতে বাধ্য করেছে। হতে পারে ওই বাড়ির অন্য বউরা কিংবা ছেলেরা সারাদিন ফেসবুকে ডুবে থাকে। হতে পারে ফেসবুক তাদের কারো সংসার ভেঙেছে। হতেই পারে! সাধু সাবধান!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)