ফেসবুক নিউজ ফিডে সংবাদমাধ্যমের পোস্ট কমিয়ে আনতে মার্ক জাকারবার্গের সিদ্ধান্তের পেছনে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য আছে। তবে তার এই সিদ্ধান্ত অনলাইন গণমাধ্যমের জন্য বড় সুযোগ বলে মনে করেন বাংলাদেশের অনলাইন সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্টরা।
তারা মনে করেন ফেসবুক ব্যবহারকারীদের নিউজ ফিডে সংবাদ কম তুলে ধরলে এই সামাজিক মাধ্যম থেকে সংবাদ পড়তে চাওয়া পাঠকের সংখ্যা কমবে। কিন্তু অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকৃত পাঠক ও কনটেন্টের গুণে নিজস্ব পরিচিতি তৈরি হবে এবং সরাসরি নিজের সাইটে ভিজিটর টানতে পারলে নিজেই ব্র্যান্ড হয়ে উঠবে।
ফেসবুক দেয়া এক পোস্টে ফেসবুকের প্রধান মার্ক জাকারবার্গ জানান, একটি গবেষণায় তারা জেনেছেন ফেসবুকে নামেমাত্র সংবাদ প্রতিবেদন পড়ার চেয়ে মানুষ বন্ধু-পরিচিতদের ছবি-আলাপচারিতায় বেশি ভালো বোধ করে। এজন্য ২০১৮ সালে ফেসবুক নিউজ ফিড থেকে সংবাদ মাধ্যম এবং অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থার লেখা-ভিডিও কমিয়ে আনা হবে।
তবে ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টও অ্যাডাম মোসেরি জানিয়েছেন টাকা দিয়ে বুস্ট করা সব সংবাদ প্রতিবেদন, বাণিজ্যিক প্রচারণা চলবে আগের মতোই।
তাই জাকারবার্গের এই সিদ্ধান্ত যতোটা না ভার্চুয়াল দুনিয়ায় মানবিক সম্পর্কে জোর দেয়া,তার চেয়ে বেশি বাণিজ্যে জোর দেয়া বলে মনে করেন সোসাইটি ফর মিডিয়া এবং সুইটেবল হিউম্যান কমিউনিকেশন টেকনিক-সমষ্টির পরিচালক ও গবেষক রেজাউল হক শাহীন।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: সামাজিক মাধ্যমগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি। এজন্য ফেসবুকে নিউজপোর্টালগুলোর পেজ আছে। পোর্টালগুলোতে অনেক পাঠক আসে ফেসবুক হয়ে। অনেকে সেসব পেজ থেকে সংবাদের লিংক শেয়ার করে। আলোচিত খবর ফেসবুকের নিউজফিডে চোখে পড়ে। এখন ফেসবুক চাইছে বিনা টাকায় পোর্টালের খবর নিউজফিডে কমিয়ে আনতে। এটা বাণিজ্যিক কারণে। ফেসবুক চাইছে টাকা দিয়ে নিউজপোর্টালগুলো তাদের সংবাদ পাঠকের নিউজ ফিড অব্দি পৌঁছে দিক। পেইড প্রমোশনে গুরুত্ব দিতে চাইছে ফেসবুক।
বাংলাদেশের নিউজপোর্টালগুলো ফেসবুকের মাধ্যমে পাঠক টানতে চাইলে এখন ফেসবুক বুস্টে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
এই বিশেষজ্ঞের বক্তব্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় একাডেমিক পর্যায়ে সামাজিক মাধ্যম ও অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিষয়ে পড়ানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সাইফুল হক চৌধুরীর বক্তব্যে।
চ্যানেল আই অনলাইনকে এই সহকারী অধ্যাপক বলেন: ফেসবুক গাণিতিক হিসাব-নিকাশ করে বেশি আলোচিত মানে লাইক পাওয়া-কমেন্ট পাওয়া বিষয় নিউজ ফিডে নিয়ে আসে। নতুন সিদ্ধান্তে বোঝা যাচ্ছে ফেসবুক মানি মেকিংকে প্রাধান্য দিচ্ছে। আরেকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য ফেসবুকের মতো বিস্তৃত প্ল্যাটফর্ম এখন আর মুফতে ব্যবহারের সুযোগ থাকছে না।
কিন্তু ফেসবুকের এই নিউজ ফিড বাণিজ্যকে মোটেও অনলাইন সংবাদমাধ্যমের জন্য হুমকি নয় বলে মনে করেন তিনি।
সাইফুল হক বলেন: ফেসবুক আসার আগে থেকেই অনলাইন সংবাদ পোর্টাল আছে। দেশের অনলাইন পোর্টালগুলো যখন যাত্রা শুরু করেছিলো তখনও ফেসবুক তাদের একমাত্র ভরসা ছিলো না এখনো নয়। তবে গত ২-৩ বছরে ফেসবুকে অনলাইন সংবাদমাধ্যমের পাঠক টানার প্রবণতা বেড়েছে। ফেসবুকের মারফত আগে যারা সংবাদ প্রতিবেদন পড়তো না তারাও পড়তে শুরু করে। ফেসবুকের নিউজ ফিড নিউজমুক্ত রাখার সিদ্ধান্তে এই পাঠকদের সংখ্যা কিছুটা কমবে।এজন্য সংবাদমাধ্যমগুলোকেও অনলাইনে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। ভালো কনটেন্ট , বিশ্বাসযোগ্যতার মতো বিষয়গুলোতে জোর দিয়ে নিজেই ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
ফেসবুকের নিউজ ফিডে সংবাদমাধ্যমের অনলাইন সংবাদ কমিয়ে আনার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন নতুন যাত্রা শুরু করা সারা বাংলা ডট নেটের নির্বাহী সম্পাদক মাহমুদ মেনন খান।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: ফেসবুক দিয়ে কোন মূলধারার গণমাধ্যমের সংবাদ জনপ্রিয় করার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্বের নামকরা গণমাধ্যম নিজেদের কনটেন্টের গুণে নিজের পরিচয় তৈরি করেছে। এজন্য ফেসবুকের ওপর ভর করতে হয়নি। আগে সংবাদমাধ্যমে মানুষ সংবাদ পড়তো এখন মানুষ ফেসবুকে সংবাদ পড়ে। এতে করে সংবাদমাধ্যমগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কারণ মানুষ বলে “ফেসবুকে পড়েছি” কিন্তু ফেসবুকে কোন সাইটের নিউজ সে পড়েছে এটা বলতে পারে না। নিউজফিডে ফেসবুক সংবাদমাধ্যমের নিউজ বিনা টাকায় কম প্রচার করলে এটা অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্যই ভালো। এজন্য এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই।
ফেসবুকের সিদ্ধান্ত অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য শাপে বর মনে করে মেনন বলেন: এখন পাঠক সরাসরি আমাদের সাইটগুলো ভিজিট করবে। এতে সাইটগুলোর নিজস্ব পরিচিত হবে, নিজে ব্র্যান্ড হবে। ফেসবুকে যেসব অনিয়মিত পাঠক, হাল্কা পাঠক নিউজ পড়ে তাদের মাধ্যমে আসলে খুব একটা বাড়তি ব্র্যান্ডভ্যালু যোগ হয় না। বরং ফেসবুক খবরের প্রাথমিক উৎস হিসেবে যেরকম অনলাইন সংবাদমাধ্যমকে তথ্য দেয়ার কাজ করছে সেটা চলতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার এক পোস্টে ফেসবুক জানায়, এবছর নিউজ ফিডে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখন থেকে নিউজ ফিডে সংবাদমাধ্যমের খবরের বদলে বন্ধু,পরিবার-আত্মীয়-স্বজনের ছবি,ভিডিও ও লেখা বেশি বেশি তুলে ধরা হবে।
ফেসবুকের নিউজ ফিড পরিবর্তনের এই ঘোষণায় আতঙ্কিত বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ফেসবুক দিয়ে এখন গ্রাহক আকর্ষণ করা নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রতিষ্ঠানগুলো। এর প্রভাব দেখা গেছে মার্কিন স্টক মার্কেটে। নিউজ ফিড পরিবর্তনের শঙ্কা জাগানো ঘোষণার পর শুক্রবার ফেসবুক স্টকের পতন হয় ৪ শতাংশ।