গুজব, রটনা, চরিত্র হনন, নাই ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে অশান্তি সৃষ্টি ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি করছে ফেসবুক। সত্যিই এখন সোশ্যাল মিডিয়া নামক বস্তুটি হয়ে দাঁড়িয়েছে এক খোলা ভাগাড়ে। কিছু মানুষ সাধারণ কথাবার্তা বা বন্ধুত্বের জন্য ফেসবুক ব্যবহার করলেও, অধিকাংশ লোক যেন এখানে আছেন অবাধ ইতরামি করার জন্য। কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিষোদগার, কোনও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিষোদগার, এরপর তার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করা, মেরে ফেলা কেটে ফেলার ডাক দেওয়া, কুৎসা, উস্কানি, বদনাম ছড়ানো- এই হচ্ছে তাঁদের সারা দিনের কাজ। এটাও এক রকমের গণধোলাই। ভার্চুয়াল গণধোলাই। এই লোকেরাই চোরকে ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে তার বুক ভেঙে দেয়, চোখ গেলে দেয়, আর বলে ন্যায়বিচারের পক্ষে লড়ছি।
আর সবচেয়ে বড় সুবিধে হয়েছে, এখানে কোনও সেন্সর নেই, কোনও নিষেধ করার ক্ষমতাওয়ালা কর্তা নেই। তাই যা খুশি বলা যায়, এবং যে কোনও ভাষায় বলা যায়। এই লাইসেন্স পেয়ে সবার আগল খুলে গিয়েছে। অশালীন ভাষা প্রয়োগের উৎসব চলেছে। যে যত জঘন্য গালাগাল প্রয়োগ করতে পারে তার লেখায়, সে তত স্মার্ট। আসলে, এত দিন সমালোচনার অধিকার থাকলেও, এমনকি প্রবন্ধে-নিবন্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণের সুযোগ থাকলেও, একেবারে খুল্লমখুল্লা অভদ্র দাঁত-খিঁচনো আক্রমণের সুযোগ ছিল না। ধরে নেওয়া হত, যারা সমালোচনা করছেন, কিছুটা শিক্ষিত হয়ে, যুক্তি দিয়ে তা করবেন। কিন্তু এখন সমালোচনার একমাত্র যোগ্যতা, কষে গালাগাল দিতে পারা। তাই অনেকেই এই মাঠে লাফিয়ে নেমে পড়েছেন। যে লেখক, শিল্পী, পরিচালককে পছন্দ নয়, তাঁদের নামে চূড়ান্ত অসভ্য কথা লেখা যাচ্ছে, সমাজের কাকে কাকে কী ভাবে ‘লিঞ্চ’ করা উচিত তা নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে ন্যক্কারজনক ভাষায় মত দেওয়া যাচ্ছে। এবং এই পোস্ট-করনেওয়ালারা নিজেদের ভেবে নিচ্ছেন ক্রিটিক, সমাজ-সংস্কারক।
আসলে আমরা যেন ক্রমশ বাহ্যজ্ঞান হারাচ্ছি! কোনও এক পরাবাস্তবে খুব বেশি বুঁদ হচ্ছি এবং তার জেরে আসল পৃথিবীটা, বাস্তবের মাটিটা, আশপাশের মানুষগুলো গৌণ হতে শুরু করেছে! উপসর্গ তাই বলছে যেন।
ইন্টারনেটের হাত ধরেই বদলটার শুরু হয়েছিল। সে বদল আদ্যন্ত ইতিবাচকই ছিল। সোশ্যাল মিডিয়ার আবির্ভাব সে বদলকে বিপ্লবে পরিণত করল, এক নতুন সাম্রাজ্যের পত্তন হল যেন। সর্বশেষ সংযোজন ঘরে ঘরে কম্পিউটার-ল্যাপটপ, হাতে হাতে স্মার্টফোন, অত্যন্ত সুলভে ইন্টারনেট। সাম্রাজ্য আর নয়, আস্ত একটা নতুন পৃথিবী, একটা আনকোরা জগৎ। আঙুলের আলতো স্পর্শেই পৌঁছে যাওয়া যায় সে জগতে।
এই নতুন জগতটা আজ ঘোর বাস্তব ঠিকই।কিন্তু প্রশ্ন জাগছে, মাটির বাস্তবতা থেকে এই জগতটা আমাদের কোনও পরাবাস্তবে নিয়ে ফেলছে না তো? তেমনই লক্ষণ ফুটে উঠতে দেখছি যেন। পরাবাস্তবই ধীরে ধীরে যেন মুখ্য আজ। আর মাটির বাস্তবতা ক্রমে ক্রমে যেন ফিকে।
মানুষ এখনও প্রায় বাধ্যতামূলকভাবে সামাজিক জীব। সমাজের বিধিনিষেধ, মূল্যবোধ তাকে মানতেই হয়। কিন্তু তারপরেও অস্তিত্বে ও মানসিকতায় সে একা। জীবনের সব রকমের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত একজন একা মানুষই নিয়ে ফেলে। ভুল বা অসম্পূর্ণ বোঝাবুঝিতে কখনও কখনও সেই সিদ্ধান্ত মর্মান্তিক হয়ে দাঁড়ায়।
সবাই জানেন মানুষের মনের রহস্য গভীরতায় ও বৈচিত্র্যে যথার্থই অতলান্তিক। অনেকেই অভিমানে, ক্ষোভে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে।
ফেসবুক মানুষের জীবনে নতুন উপসর্গের নাম। সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমটি নানা সমস্যা সৃষ্টি করছে। এখন ব্যক্তিগত বলে আর কিছু থাকছে না। একজনের আবেগ-অনুভূতি-কার্যক্রম অন্য আরেকজনকে ঈর্ষাকাতর করে তুলছে। একে দেখানো, ওকে শিক্ষা দেওয়া, প্রতারণার ফাঁদ হিসেবে ফেসবুক ব্যবহার করা ইত্যাদি নানা ঘটনা অনেকের ব্যক্তিগত জীবনকে বিষিয়ে তুলছে।
রক্ষণশীল মানসিকতার যারা, তারা ফেসবুকে অন্যের সঙ্গে প্রিয়জনের ছবি দেখেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। এক শ্রেণির মানুষ ‘আমি ভালো আছি, সুখে আছি’ এটা অন্যকে দেখানোর দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। তারা ফেসবুকে এই ‘ভালো থাকার, সুখে থাকার’ টুকরো স্মৃতি তুলে ধরে। এটাও কাউকে কাউকে অসুখী করে তোলে। তারা আরও বেশি বিষণ্ণতায় ভোগে।
সামাজিক মাধ্যম থেকে তো আরও বেশি সামাজিক হওয়ার শিক্ষা নেওয়া উচিত। সে মাধ্যমের হাত ধরে এমন অসামাজিক হয়ে উঠছি কী ভাবে? আসলে বাহ্যজ্ঞানই হারাচ্ছি। বাস্তবের মাটিতে শুধু শরীরটা। মানসিক অস্তিত্বের সিংহ ভাগটারই বিচরণ এক কল্প-জগতে।
ঘোর কাটা জরুরি, সম্বিৎ ফেরা জরুরি। না হলে কোনও অভাবনীয় বিপর্যয় আমাদের অপেক্ষায়। সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কে আমাদের নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। তথাকথিত ‘সোশ্যাল মিডিয়া’ বা ‘ফেসবুক’— সবই জীবনের বাইরের অঙ্গসজ্জা। বেঁচে থাকার জন্য মোটেই জরুরি নয়— এই সত্য ছাত্র–ছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
স্বাভাবিক সম্পর্কের প্রশ্নে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং বাড়ির বাবা–মা উভয়পক্ষকেই কমবয়সীদের আরও কাছে পৌঁছে দিতে হবে। জীবনের বৈচিত্র্যময় আনন্দের জন্য শিল্প–সংস্কৃতি ও গঠনমূলক বিনোদন পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়নি, যাবেও না।
ফেসবুকের নেশায় বুঁদ হয়ে অনেকের লেখাপড়া শিকেয় উঠছে। অনেকে বিচ্ছিন্নতাবোধে ভুগছেন। অনেকের মানসিকতায় এক ধরনের অস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছে। যদি এটাও এক ধরনের আত্মপরিচয়ের সঙ্কট হয়, তাহলে অবিলম্বে সমাজ বিশেষজ্ঞদের জীবন সম্পর্কিত বিচার বুদ্ধির বিশ্লেষণ আরও বড় ও কার্যকর পদ্ধতিতে প্রচার করতে হবে। যাতে পথ হারানো এই ফেসবুক-রোগীদের বাঁচানো যায়। জীবনে স্বাভাবিকতার কোনও বিকল্প নেই।
ইদানীং মর্মান্তিক ভুল বোঝাবুঝি, অপরাধীদের মানসিক গঠন ইত্যাদি প্রসঙ্গে সংবাদপত্রে লেখালেখি হচ্ছে, টেলিভিশনেও গুরুত্বপূর্ণ সব বিশ্লেষণ শোনা যাচ্ছে। সমাজ জীবনে যা ঘটছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এই সব কথাবার্তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। জেনেও কেন এর প্রচার এখনও নিয়মিত হচ্ছে না— এই প্রশ্ন উঠতেই পারে।
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন পরিচালিত ‘টেকনোলজি অ্যান্ড সোশ্যাল মিডিয়া, এ ট্রেসফুল, ইয়েট লাভিং রিলেশনশিপ’ শীর্ষক এক সমীক্ষা মতে, স্মার্ট ফোন মস্তিষ্কের বোধশক্তিকে খর্ব করে। এমনকি সেটা বন্ধ করে হাতের কাছে রাখলেও মনের উপর তার কুপ্রভাব পড়ে, মন আপন সংযোগের সামর্থ্য অনেকাংশে হারায়। এই বিষয়ে স্মার্ট ফোনের সঙ্গে প্রেমের সাদৃশ্য আছে। বিশেষত প্রথম প্রেমের। তা মস্তিষ্ক বিকল করে দেয়, চিন্তাশক্তি প্রায় হরণ করে নেয়। প্রাত্যহিক জীবনে প্রেমাস্পদ ছাড়া কারও অস্তিত্ব প্রাসঙ্গিক থাকে না। প্রেম না থাকলে জীবন স্থবির প্রায়। স্মার্ট ফোন না থাকলে মাথায় বজ্রাঘাত, কোনও কাজ সুসম্পাদনের সম্ভাবনা কমে যায়। উভয় ক্ষেত্রেই মন, যথাক্রমে প্রেম ও ফোনের দিকেই, পড়ে থাকে। আধুনিক মানবকে স্মার্টফোনই নিয়ন্ত্রণ করে, ঠিক যেমন প্রেমে পড়লে প্রেমই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। তারা তখন চাঁদের কথা ভাববে না পার্কের কথা, প্রেমই তা স্থির করে দেয়। এমনকি প্রেমাস্পদের সঙ্গে না থাকলেও। স্মার্ট ফোনের মতোই, অনুপস্থিত প্রেমিক বা প্রেমিকা মনের অগোচরেই মনকে চালনা করে, সেটাই নির্ধারণ করে দেয়— মস্তিষ্ক কতটা আকুল ও বিহ্বল হবে। এমনই চরম সেই অনুপস্থিতিও।
তবে প্রেমের সঙ্গে স্মার্ট ফোনের একটি বড় পার্থক্যও রয়েছে। প্রেম নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। নিজেকে আবিষ্কার করবার, ভালোবাসবার উপাদান যোগায়, সাহস যোগায়। প্রেমাস্পদের কথা চিন্তা করে মস্তিষ্ক বিকল হলেও প্রেম নিজের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেয়, আপনাতে নিমগ্ন থাকবার উপকরণ এনে দেয় মনের কাছে। আত্মনিমগ্ন শব্দটি সজীব হয়ে উঠে। অন্য দিকে স্মার্ট ফোনও আত্মনিমগ্ন করে রাখে, কিন্তু তার অতিরিক্ত কার্যকারিতায় বিস্মৃতির পথে চলে যায় আপন সত্তাটি। তখন, সে কী ভালোবাসত, কী কারণে আনন্দিত হতো, সেটা সে নিজে স্থির করে না, স্থির করে স্মার্টফোন। নিজস্বতা বলতে তখন রকমারি স্মার্টফোন, তার আচ্ছাদন এবং রিংটোন। বাকিটা থান কাপড়ের মতো বৈচিত্রহীন। প্রেমে পড়লে মানুষ নিজেকে নিজের কাছে আনতে শেখে, স্মার্টফোনে পড়লে নিজেকে দূরে ঠেলতে।
এই বিড়ম্বনা থেকে মুক্তির উপায় আছে কী? আছে একখানা। স্মার্ট ফোনের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
ফোনের ব্যবহার সীমিত করা অত্যন্ত জরুরি। এতে মন ও মস্তিষ্ক আপন চিন্তাশক্তির বশে থাকবে এবং সেই অনুযায়ী মানুষকে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সাহায্য করবে। মানুষের নিজেরই ঠিক করা উচিত, সে কতক্ষণ ও কী ভাবে ফোন ব্যবহার করবে।
সমীক্ষাটিতে আরও দেখা গেছে, প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে ফোন বন্ধ রেখে দিলে, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা, ভাববার ক্ষমতা বহুলাংশে উন্নত হয়। অর্থাৎ মনকেও শাসনে ও নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন। ঠিক যেমন পরীক্ষার সময় অভিভাবকরা প্রেমিক-যুগলকে শাসন করে থাকেন, পড়াশোনায় মন দিয়ে ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে বলেন, তেমনই। প্রেম ভালো, স্মার্ট ফোনও খারাপ না, কিন্তু উভয়কেই কী ভাবে বাগে আনতে হয়, বশ মানাতে হয়, সেটা না জানলে বিপদ।
তবে কিনা, হাজার হাজার বছরের উপদেশেও প্রেমের বেগ ও আবেগ সামাল দেওয়া যায়নি। স্মার্ট ফোনের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হবে, সেই ভরসা কম। কারণ আমরা জানি কিন্তু মানি না!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)