বার্সেলোনায় চলছে বড়দিনের ছুটি। পুরো পরিবার নিয়ে আর্জেন্টিনায় উড়াল দিয়েছেন লিওনেল মেসি। তিন ছেলে, স্ত্রী আন্তোনেল্লা রোকুজ্জোকে নিয়ে সেখানে দারুণ সময় কাটছে বার্সেলোনা অধিনায়কের।
খেলার বাইরে থাকলেও সংবাদ কর্মীদের হাত থেকে রেহাই মেলেনি এলএম টেনের। ছুটির মাঝেই স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম মার্কার মুখোমুখি হয়েছেন মেসি। সেই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে পারিবারিক জীবন, ক্লাব সতীর্থ ও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর প্রসঙ্গও।
আরেকটা বছর, সঙ্গে পঞ্চম গোল্ডেন বুট। কেমন লাগছে, এতকিছু জিতেও ক্লান্ত লাগছে নাতো?
স্বীকৃতির জন্য এটা দারুণ এক পুরস্কার এবং এটা সবার জন্য। এই পুরস্কার দলের জন্য। একজন গোলরক্ষক যেমন তার পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি হিসেবে জামোরা ট্রফি জেতে, সেটাও কিন্তু দলের জন্যই। আমি খুব খুশি যে আবারও এই পুরস্কারটা জিতলাম।
পাঁচটা গোল্ডেন বুট, পাঁচটা ব্যালন ডি’অর; পঞ্চম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ হলে ভালো হত না?
সেটা হলে তো ভালোই হত। আমরা মৌসুমের শুরুতে বলেছিলাম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সবথেকে আলাদা, আর আমরা যেকোনো মূল্যে সেটা আবারও জিততে চাই।
জীবনের এই প্রান্তে এসে এমন মনে হচ্ছে ফুটবলটাই আপনার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাকি পরিবারের গুরুত্বটাই বেশি?
যতদিন আমার সন্তানরা থাকবে, আমি বলবো পরিবারই আমার কাছে সবচেয়ে আগে। পরিবারই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। আমি ফুটবলকে ভালোবাসি এবং এটাই আমার জীবিকা। কিন্তু পরিবার সবথেকে ঊর্ধ্বে।
তিন বাচ্চাই যথেষ্ট, নাকি আরও সন্তান চান?
সিরো(মেসির ছোট ছেলে) মাত্র দাঁড়াতে শিখেছে। আন্তোনেল্লা আর আমার একটি মেয়ের ইচ্ছে আছে। দেখা যাক এখনো তো অনেক সময় বাকি আছে।
আমরা আপনার দুই ছেলে থিয়াগো ও মাত্তেওকে ক্যাম্প ন্যুতে দেখেছি। ওরা আপনাকে এমন কোনো প্রশ্ন করেছে যেটা আপনার মনে ধরেছে?
ওরা দুজনেই ফুটবল দারুণ ভালোবাসে। থিয়াগো একটু বেশিই আগ্রহী, কারণ ও বড়। সে খেলা নিয়ে অনেক আলোচনা করে। খেলাটা নিয়ে সে আগ্রহী।
সে বাবাকে নিয়ে কোনো আব্দার করে না?
হ্যাঁ, করেতো। আমি এরইমধ্যে ওর কাছ থেকে অনেক সমালোচনা শুনেছি। ও বার্সেলোনা, লা লিগা আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের খেলা দেখে। এগুলো বেশ পছন্দ করে, অনেক প্রশ্ন করে, প্রতিবেদন দেখে এবং যেদিন আমি ভালো খেলি না সেদিন আমার সমালোচনা করে।
এটা কি সত্যি, যেদিন বার্সেলোনা হেরে যায় সেদিন আপনি বাসায় খেলা নিয়ে কথা বলেন না?
আগে বলতাম না, কিন্তু এখন বলতে হয়। হার হজম করাটা আর খারাপ খেলাটা সত্যি খুব কষ্টের। কিন্তু থিয়াগো আমাকে কথা বলতে বাধ্য করে। কেনো আমরা জিতিনি, কী হয়েছিল? আমরা এ নিয়ে অনেক কথা বলি।
আপনারা এখন ছুটিতে আর্জেন্টিনায়, কেমন কাটছে বড়দিনের ছুটি?
আমরা যেখানেই থাকি না কেনো, বড়দিনটা আর্জেন্টিনাতেই কাটাই। সেখানকার দিনগুলো বিশেষ এবং খুব সুন্দর। আমরা সবাই এক হই, আবহাওয়া দারুণ থাকে এবং আমরা পার্টি দেই। বাচ্চাদের নিয়ে সেসব দিনগুলো যেন উড়ে চলে যায়। সান্তা ক্লজের কারণে ওদের সঙ্গে থাকলে আপনি দারুণ আনন্দ পাবেন।
আপনার জার্মান সতীর্থ মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগেন বিশ্বকাপে সাইডবেঞ্চে কাটালেন। আপনার মনে হয় না দারুণ এক মৌসুম কাটানোর পর তাকে বসিয়ে বায়ার্ন মিউনিখের চোটাক্রান্ত গোলরক্ষক ম্যানুয়েল ন্যুয়ারকে খেলানো অন্যায় ছিল?
এটা অবাক করার মতো বিষয় ছিল। মার্কের বছরটা দারুণ কেটেছে। আসলে এসব তাদের বিষয়।
কোনটা বেশি ভালো লাগবে? লেরয় সানের মতো খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলা নাকি আবারও পেপ গার্দিওলার অধীনে খেলা?
অসাধারণ সব খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলতে পারাটা দারুণকিছু। যদিও এটা বলা কঠিন তবে ভবিষ্যতে সম্ভব হলে আমি গার্দিওলার সঙ্গে কাজ করতে চাইবো। তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা কোচ।
স্পেন এবং নেদারল্যান্ডসে ডি লিট এবং ডি ইয়ংকে নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। আপনি ওদের খেলা দেখেছেন? তারা বার্সায় খেলার যোগ্য?
তারা আমাদের মতই একই বিদ্যালয়ের ছাত্র। আমাদের মতই একই কাজ করে, আমাদের মতই বল পায়ে খেলে। তারা সম্ভাবনাময় তরুণ, দারুণ দুজন খেলোয়াড়।
আপনার জীবনে অসম্ভব স্বপ্ন কোনটি? যেটা করতে চান কিন্তু পারছেন না?
কোনকিছুই অসম্ভব নয়। আমরা আমাদের সর্বস্ব দিয়ে লড়াই করতে পারলে সবকিছুই অর্জন করা সম্ভব। মানসিকতা, পরিশ্রম এবং উদ্যোগ থাকলে কোনকিছুই অসম্ভব নয়।
কিছুদিন আগে বলেছিলেন পেনাল্টি নিয়ে আরও কাজ করতে চান। কীভাবে এই উন্নতিটা করা সম্ভব? আপনি কি গোলরক্ষকদের ভিডিও দেখে রিহ্যার্সেল করেন?
অনুশীলন আর দেখা। বর্তমানে আমরা সবকিছুর কাটাছেঁড়া করতে পারি- ফাউল, পেনাল্টি এবং খেলা, সবকিছু নিয়ে। সবকিছু নিয়েই বিশ্লেষণ করা হয়, কোনকিছুই আড়াল করা যায় না।
আবার উল্টোভাবে যখন আপনি ফ্রী-কিক নেন, তখন তো অর্ধেক গোল হয়েই গেছে বলে সবাই ধরে নেয়। ফ্রী-কিক ও পেনাল্টির মাঝে কী অনেক পার্থক্য?
পার্থক্য তো অবশ্যই আছে। একটার ক্ষেত্রে মানবদেয়াল আর দূরত্বের বিষয় থাকে। আপনাকে অবস্থা বুঝে শট নিতে হবে এবং আপনাকে গোলের জন্য কেউ চাপ দেবে না। পেনাল্টির ক্ষেত্রে জয়ের চেয়ে হারের সম্ভাবনাই বেশি থাকে। গোলরক্ষক স্বস্তিকর অবস্থায় থাকে। এখানে অন্যরকম এক চাপ কাজ করে।
গত বছর আমরা বলাবলি করেছি যে, বার্সা আক্রমণের চেয়ে রক্ষণেই বেশি রেকর্ড গড়েছে। এই বছর এমন কী ঘটলো যে আপনারা অনেকবেশি গোল হজম করছেন?
এই বছর আমরা আবারও ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলছি। গত বছর আমরা দুই লাইনে চারজন করে খেলিয়েছি। যেকারণে প্রতিপক্ষ খুব অল্প সুযোগ পেয়েছে গোল করার। এখন ৪-৩-৩ ফর্মেশনে আমরা পজিশন ধরে রেখে ভালো ফুটবল খেলছি। কিন্তু একই কারণে রক্ষণে অনেকটা অংশ ফাঁকা থেকে যাচ্ছে, আর প্রতিপক্ষও অনেক ফাঁক পাচ্ছে। ইদানীংকার ম্যাচগুলোতে আমরা রক্ষণে ভালো করছি, আশা করছি সামনে আরও ভালো করবো।
যুব প্রকল্প থেকে যে খেলোয়াড়রা বেরিয়ে আসছেন, তাদের মান কী আপনাকে অবাক করে না?
প্রথমে বলবো, হ্যাঁ করে। কিন্তু তারা আমাদের সঙ্গে অনেকসময় অনুশীলন করে। তখন আপনার মনে হবে তারা অসাধারণ সব খেলোয়াড়। ক্লাব তাদের মানোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে, আমাদের সঙ্গে অনুশীলন করতে পাঠাচ্ছে। আর এ কারণে তারা দ্রুত শিখতে পারছে। এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।
আপনার কখনও মনে হয়, যুব প্রকল্প থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়দের নিয়ে একাদশ সাজানো এক বার্সেলোনাকে কোনদিন দেখতে পাবেন?
এটা বলা কঠিন। আমার মনে হয় এমন এক দল দেখা অসম্ভব কিছু নয়, হয়তো ভবিষ্যতে আমরা দেখতেও পাবো। তবে সময় লাগবে।
সার্জিও বুসকেটস কিছুদিন আগে বলেছিলেন আজকালকার তরুণ ফুটবলারদের মধ্যে উপরে ওঠার জন্য খুব তাড়াহুড়া। তারা যেন আজে-বাজে কাজ করা থেকে নিজেদের বিরত রাখে। আপনি একমত?
আমরা ভিন্ন এক সময়ে বেড়ে উঠেছি। বর্তমানে অন্য আরেক যুগে বাস করছি। আমাদের এতে অভ্যস্ত হতে হবে। এটা সত্যি যে তরুণরা অল্প বয়সে খুব লোভনীয় সব প্রস্তাব পাচ্ছে। কেবল অর্থই নয়, অনেকে মনে করে যে এখানে থাকলে মূল দলে খেলা সম্ভব নয়, অন্য দলে গেলে সেটা সম্ভব। এটা সত্যি প্রলুব্ধকর।
এই মৌসুমে জর্ডি আলবার যোগ্য কোনো বিকল্প নেই। স্যামুয়েল উমতিতি এখনো চোটে জর্জরিত, আর রাফিনহা তো পুরো মৌসুমের জন্যই ছিটকে গেছেন। বার্সা দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে না? আপনার কি মনে হয়, জানুয়ারিতে দল বড় করা জরুরী?
এটা পুরোপুরি কোচ ও ক্লাবের ব্যাপার। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি আমাদের দারুণ একটা দল আছে। এর বাইরে একাডেমির খেলোয়াড়রা আছে যারা কোনো সমস্যা ছাড়াই খেলতে পারে।
আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার অভাবটা বোধ করেন?
অবশ্যই। মাঠে-বাইরে সবজায়গায়। আমরা একসঙ্গে অনেকটা বছর, অনেক সময় কাটিয়েছি। অনেক ভাবনা ভাগাভাগি করেছি। একসঙ্গে অনুশীলন করেছি, অনেক ম্যাচ খেলেছি। ফুটবলের বাইরের বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। তাকে ছাড়া অবশ্যই সবকিছু অদ্ভুত!
এবারের লা লিগা খুব হাড্ডাহাড্ডি হচ্ছে?
এখন যেকোনো দলের বিপক্ষে জয় পাওয়া এমনিতেই খুব কঠিন। লিগে দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব খুব কম এবং জয় পাওয়া খুব কঠিন।
এই বিষয়টা নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলছে। এবারের ব্যালন ডি’অরে পঞ্চম হওয়ায় আপনি খুব বিস্মিত?
সত্যি বলছি, পুরস্কারটা অনেক বড়, কিন্তু আমি এই বিষয়কে মোটেও গুরুত্ব দেই না। আমি জানতাম এই মৌসুমে আমার জয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই মোটেও অবাক হয়নি।
এই বছর দল চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ভালো খেলছে। বিশেষ কোনো অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন কী?
প্রত্যেক বছর সবারই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের ইচ্ছে থাকে। এটা অনন্য, অসাধারণ, আমার খেলা সবচেয়ে সুন্দর প্রতিযোগিতা। এটা সবার থেকে আলাদা একটি আসর, যেকারণে আমরা এটি জিততে চাই।
টটেনহ্যামের বিপক্ষে উসমানে ডেম্বেলের গোলটি ছিল অসাধারণ। তিনি একজন দারুণ খেলোয়াড়, কিন্তু তার আচরণ, আপনার মনে হয় না আরেকটু পরিপক্ব হওয়ার প্রয়োজন আছে তার?
মাঠে সে অসাধারণ। সবকিছু তার উপর নির্ভর করে। সে যা কিছু করতে চায়, সবরকম সুযোগ সুবিধাই তার জন্য বরাদ্দ। তার বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার হওয়ার যোগ্যতা আছে। অন্যদিকে সে তরুণ একজন ফুটবলার, যাকে পেতে ক্লাব ও শহর দুহাত পেতে বসে আছে। এ নিয়ে যত কম বলা যায় ততই মঙ্গল। তাকে তার মতই থাকতে দেয়া উচিত, যাতে সে শান্ত থাকে। সে ইতিমধ্যেই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে এবং সেগুলো শোধরানোর চেষ্টা করছে। আমরা তাকে ফুটবলে মনোযোগী করানোর চেষ্টা করছি।
রিয়াল মাদ্রিদ যেভাবে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর অভাব বোধ করছে, তাতে আপনি বিস্মিত?
মৌসুমের শুরুতে বলেছিলাম তারা দারুণ এক ক্লাব, বিশ্বের অন্যতম সেরা, যাদের অসাধারণ সব খেলোয়াড় আছে। কিন্তু ক্রিস্টিয়ানো এমন একজন ফুটবলার যার অভাব সবাই টের পাবে। সে আপনাকে অনেক গোল ছাড়াও আরও অনেককিছুই উপহার দেবে। সুতরাং তার অভাববোধ হওয়াটা আমাকে অবাক করেনি।