চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘ফিল্ড হাসপাতালের পাশাপাশি থাকতে হবে বিভাগভিত্তিক সমন্বিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা’

সম্প্রতি ঘোষিত রাজধানীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঁচটি স্থানে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করাকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

পাশাপাশি তারা বলছেন, সারাদেশের জন্য ‘বিভাগভিত্তিক সমন্বিত করোনা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা’ চালু থাকতে হবে এবং ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের ক্ষেত্রে রোগীদের ‘সময়’ যেন বাধা হিসেবে কাজ না করে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম (এমআইএস) জানায়, আজ শনিবার দুপুর ১২ পর্যন্ত ঢাকার ১৬টি সরকারী হাসপাতালগুলো অধিকাংশতেই আইসিইউ খালি নেই। মোট হাসপাতালগুলোতে তিন হাজার ২৩২টি শয্যা, যার মধ্যে খালি এক হাজার ২৯০টি। আইসিইউ ৩৯৫টির মধ্যে খালি রয়েছে ৯৬টি। মহাখালির ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে খালি আছে ৭৪টি আইসিইউ শয্যা।

অন্যদিকে বেসরকারী ২৭টি হাসপাতালে এক হাজার ৯০৮টি শয্যার মধ্যে খালি আছে ৫৮৪টি। আইসিইউ ৪৬৬টির মধ্যে খালি আছে ১২২টি। এরমধ্যে পূর্ব রামপুরার বেটার লাইভ হাসপাতালে খালি আছে ২০টি আইসিইউ শয্যা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা হাসপাতাল, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল, মুগদা হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে কোনো কোনো আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট-নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) শয্যা খালি নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, সারাদেশে হাসপাতালের শয্যা অনুযায়ী রোগী বেশি ভর্তি আছে। দেশে বিভিন্ন হাসপাতালে বর্তমানে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা আছে এক হাজার ৬৮৭টি, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর আছে এক হাজার ৮০৯টি এবং অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে ২৮ হাজার ৫১৩টি। তবে এখনো কয়েকটি হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়নি।

গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব লোকমান হোসেন জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কনভেনশন সেন্টারসহ রাজধানীর ৫টি স্থানে করোনা ফিল্ড হাসপাতাল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

সেসময় তিনি বলেন, আমাদের ফিল্ড হাসপাতাল বড় আঙ্গিকে শুরু হবে। আমরা আশা করি, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ঢাকায় আমরা এটি চালু করতে পারব। এই মুহূর্তে আমাদের ঢাকায় ফিল্ড হাসপাতালের প্রয়োজন নেই, তবুও আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি।

এর আগে বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল বুলেটিনে অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেছিলেন, আমাদের যেসব হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, সেই হাসপাতালগুলোতে কীভাবে শয্যার সংখ্যা বাড়ানো যায়, জনবল কীভাবে পুনঃবণ্টন করা যায়, আমরা সেদিকে মনোযোগ দিয়েছি। এর বাইরে ফিল্ড হাসপাতাল করা যায় কি না, সে বিষয়টি আমরা যাচাই-বাছাই করছি। প্রয়োজন হলে ফিল্ড হাসপাতাল করব।

ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা ভালো সিদ্ধান্ত
রাজধানীতে ফিল্ড হাসপাতাল প্রস্তুত রাখাকে ভালো সিদ্ধান্ত হিসেবে মনে করছেন দুই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ ও ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন।

তারা বলছেন, সেখানে রোগীরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাবেন এবং আইসোলেশনের ব্যবস্থাও থাকবে। তবে ফিল্ড হাসপাতালে অবশ্যই অক্সিজেনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এই হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে জনবহুল এলাকায়। যাতে বিপুলসংখ্যক রোগী সেখানে আসতে পারে।

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে দেশে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। ছবি: জাকির সবুজ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘‘রাজধানীতে দুই কোটির বেশি মানুষ, ফিল্ড হাসপাতালে প্রস্তুত রাখা ভালো। যদি বেশি আক্রন্ত হয় তবে ফিল্ড হাসপাতাল ভালো সাপোর্ট দিতে পারবে। সেক্ষেত্রে হাসপাতালগুলো ফাংশন্যাল হতে হবে। যেখানে চিকিৎসক, নার্স, ওষুধ, অক্সিজেনসহ সকল কিছু থাকবে।’’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘‘আমাদের দেশে যদি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে রোগী ২৫ হাজারও হয় এবং এদের মধ্যে ২০ শতাংশ রোগী যদি কোভিড নিউমোনিয়াতে ভুগে তাহলে তাদের অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়বে, এর ভেতর আবার পাঁচ শতাংশের আবার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি জনিত সমস্যা এমনটি কেউ কেউ ক্যান্সারেও আক্রান্ত আছেন। তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে আইসিইউ সেবা দিতে হয়।’’

ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন

তিনি বলেন, ‘‘বর্তমানে শহর ও গ্রামাঞ্চলে রোগীর সংখ্যা বেশি। শহরের রোগীটা যতো দ্রুত চিকিৎসা নেন, গ্রামাঞ্চলের রোগীরা ততোটা চিকিৎসা নিতে চান না। আমরা যদি খুলনা বিভাগে দেখি সেখানে মৃত্যুহার হঠাৎই বেড়ে গেছে। তারা সবাই দেরিতে চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে এসেছেন । তাদের ফুসফুস ৪০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে অকার্যকর হয়ে গেছে। পর্যাপ্ত অক্সিজেন দিয়েও তাদের অক্সিজেন সাচ্যুরেশন ৮০ থেকে ৯২-এ আনা যাচ্ছে না। পরে তারা মারা যাচ্ছেন। ফলে হাসপাতালে কোভিড রোগীদের শয্যা বাড়াতে হবে এবং আক্রান্ত রোগীদের জন্য অক্সিজেন সেবা নিশ্চিত করতে হবে, এরজন্য ফিল্ড হাসপাতাল প্রয়োজন।’’

সারাদেশে ‘বিভাগভিত্তিক সমন্বিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা’ দরকার
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘‘আগে করোনা ঢাকায় বেশি সংক্রমণ থাকলেও বর্তমানে বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকা, বিভাগীয় জেলা, শহর গ্রামসহ সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। সারাদেশের মানুষ কেউ আক্রান্ত হলে তিনি যেন সহজে চিকিৎসা সেবাটা পেতে পারেন এমন সমন্বিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আমাদের চিন্তা করতে হবে।’’

‘‘আমাদের ৫০০ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে, যেখানে আমাদের ৩০টা থেকে ৫০টা বেড আছে। আমাদের প্রথম কাজ হবে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে  করোনা চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করা। এখানে আমাদের চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্যরা আছেন ফলে আমরা ব্যবহার উপযোগী করতে পারলে আমাদের বেগ পেতে হবে না।’’

তিনি বলেন, ‘‘হয়তোবা কোন কোন হাসপাতালে চিকিৎসকের সংখ্যা কম আছে। সেক্ষেত্রে আমরা দুটো কাজ করতে পারি। আমরা প্রায় হাজার পাঁচেক চিকিৎসককে ভলান্টিয়ার হিসেবে নিয়োগ দিতে পারি। আমাদের ৫০ হাজার চিকিৎসক আছেন। তারা চাকরি না করলেও বিভিন্ন ট্রেনিং করান। তাদের যদি আমরা ভলান্টিয়ার হিসেবে নিয়োগ দেই, তাহলে গ্রাম-গঞ্জে শহরে যারা কম উপসর্গ নিয়ে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের আমরা সহজেই ৫০০ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ব্যবহার করে চিকিৎসা সেবা দিতে পারি।’’

‘‘ঠিক একইভাবে আমাদের ৬৪টি জেলায় জেনারেল হাসাপাতাল আছে, সেখানে শয্যা সংখ্যা নূন্যতম ২০০, কয়েক জায়গায় বেশিও আছে। যেসব হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন নেই সেখানে যদি আমরা দ্রুততম সময়ের ভেতর (কমপক্ষে ১০দিন) হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ব্যবস্থা করে ৮০ শতাংশ রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারি তাহলে রোগীর সংখ্যা মাত্র ২০ শতাংশ থাকবে।’’

ডা. বে-নজির আহমেদ

‘‘তাহলে আমরা যদি জেলা পর্যায়ে ৮০ শতাংশ রোগী চিকিৎসা দিতে পারি বাকি ২০ শতাংশ রোগীদের বিভাগীয় হাসপাতালে সর্বোচ্চ সেবা (আইসিইউ) দেওয়া যায়, যদি আমরা বিভাগীয় হাসপাতালে ২০০ বেডের আইসিইউ শয্যা চালু করতে পারি তাহলে আমাদের আটটি বিভাগে এক হাজার ৬০০টি আইসিইউ চালু রাখতে পারি, যোগ করেন তিনি।’’

ডা. বে-নজির বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা হবে বিভাগ ভিত্তিক সমন্বিত করোনা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা। যে বিভাগের রোগী সেই বিভাগেই চিকিৎসা হবে। উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যারা আক্রান্ত এবং উপসর্গ কম তাদের আমরা সেখানে সেবা দিতে পারি। অক্সিজেনের জন্য আমরা বড় কিছু অক্সিজেন সিলিন্ডার সেখানে রাখতে পারি। এরপর আক্রান্ত যারা একটু সিরিয়াস থাকবে তাদের আমরা জেলা পর্যায়ের মেডিকেল হাসপতালগুলোতে উন্নত চিকিৎসা দিতে পারি। এদের মধ্যে কারো যদি আইসিইউ প্রয়োজন হয় তবে বিভাগীয় হাসপাতালে আইসিইউ সেবা দিতে পারি। তাহলে কিন্তু আমরা সারা দেশের জন্য সমন্বিত ব্যবস্থা চালু করতে পারি। ’

ফিল্ড হাসপাতাল জনবহুল এলাকায়, রোগীর সময় যেন বাঁচে
ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন বলেন, ‘‘ফিল্ড হাসপাতালের স্থানটা কোথায় হবে সেটা নির্ধারণ করা দরকার। কারণ দুরত্ব একটা বাধা হিসেবে কাজ করে। যেমন যাত্রাবাড়ির আক্রান্ত একটা ব্যক্তি মুগদা হাসপাতালে আসার আগে যদি যাত্রাবাড়িতে তাকে সেবাটা দিতে পারি, আবদুল্লাহপুরের রোগীটাকে যদি সেখানেই চিকিৎসা দিতে পারি। তাতে তাদের যাতায়ত অনেক সহজ হবে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত জনবলের প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থেকে শুরু করে একদম পরিচ্ছন্নতাকর্মী পর্যন্ত সবাইকে দরকার। এছাড়াও রোগীর সাথে চিকিৎসকের অনুপাতটাও যেন ঠিক থাকে।’’

আরোপিত বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে মাঠে রয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ছবি: জাকির সবুজ

সহমত প্রকাশ করে ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে জনবহুল এলাকায়। যাতে বিপুলসংখ্যক রোগী সেখানে আসতে পারে। এমন কোনো স্থানে হাসপাতাল স্থাপন করা যাবে না, যেখানে জনসাধারণের পক্ষে যাওয়া-আসা দুরূহ।’

দুই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের অভিমত, ক্রমবর্ধমান হারে দেশে করোনা রোগী বাড়ছে। যা কিনা মধ্য জুলাই থেকে জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত বাড়বে। এই সময়ে বিপুলসংখ্যক রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হলে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন জরুরি। এছাড়াও জনসাধারণের স্বাস্থ্যবিধি মানা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সহ গণজমায়েত থেকে দূরে থাকতে হবে। পাশাপাশি দ্রুত সময়ের মধ্যে সরকারের ঘোষিত ৮০ শতাংশ জনগণের মাঝে টিকাদান সম্পন্ন করতে হবে।