শক্তিমান অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদির জন্মদিনে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন অনেকেই। এবার ফেসবুকে তাকে নিয়ে একটি লেখা পোস্ট দিলেন প্রামাণ্যচিত্র পরিচালক কাওসার চৌধুরী। নিজের পোস্টে তিনি হুমায়ুন ফরীদিকে নিয়ে গল্প শোনান পাঠকদের।
সেখানে তিনি লিখেন, ১৯৮৮ কিংবা ’৮৯ সালের কথা। আমি তখন এলিফ্যান্ট রোড-এ থাকি। রাত প্রায় আড়াইটার দিকে ঝনঝন করে টেলিফোন বেজে উঠলো। এনালগ ফোন। ফোন বেজেই চলেছে। আমি অন্ধকারে হাতড়ে বেডসাইড টেবিল থেকে ফোনের রিসিভার তুলে বলি- হ্যালো। অপর প্রান্ত থেকে একটি উদ্বিগ্ন কন্ঠ: আরে শোন, এটা কি কাওসারের বাসা? আমাকে কোন উত্তর দেয়ার সুযোগ না দিয়ে আবারো ঝড়ের গতিতে প্রশ্ন: আরে আমাদের কাওসার, নাগরিকের কাওসার! কি, বুঝতে পারছো? আরে, তুমি কি কাওসার বলছো?
ততক্ষণে আমারতো ঘুমটুম ভেঙ্গে একাকার! স্পষ্টতই বুঝতে পারছি অপর প্রান্তে ফরীদি ভাইয়ের কন্ঠ! তারপরেও নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্যে জিজ্ঞেস করি- ফরীদি ভাই বলছেন? উত্তর: আরে হ্যাঁ, ঠিক ধরেছো; আমি ফরীদি। কাওসার, একটা কাজ করতো; আগে লাইটটা জ্বালাও!
আমি বিস্মিত। ফরীদি ভাই আছেন তার বাসায়, আর আমি আছি আমার বাসায়, এর মাঝে আমার বাসায় লাইট জ্বালালে উনার কি লাভ বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করি- আমাকে লাইট জ্বালাতে বলছেন ফরীদি ভাই? একটু উষ্ণভাবে উনি বলেন: আরে কানে কম শোন নাকি মিয়া, লাইট জ্বালাও! একটু ধরুন বলেই আমি রিসিভার রেখে অন্ধকারে উঠে গিয়ে লাইট জ্বালাই। তারপরে এসে রিসিভার তুলে বলি- জ্বী ফরীদি ভাই, লাইট জ্বালাইসি; বলেন।
ফরীদি ভাই: তোমার বেডরুমে দেয়াল ঘড়ি আছে না?
আমি: হ্যাঁ, আছেতো। বিস্ময়ের ঘোর কাটেনা আমার!
ফরীদি ভাই: দেখতো ঘড়িতে ক’টা বাজে?
আমি: দুইটা পঁয়ত্রিশ মিনিট।
ফরীদি ভাই: আরে, এত রাত হইয়া গেছে!
আমি: মানে?
ফরীদি ভাইঃ না, মানে, আমার আশেপাশে কোনো ঘড়ি নাইতো, এজন্যে তোমারে একটু কষ্ট দিলাম সময়টা জানার জন্য। যাও, এবার ঘুমাও গিয়া! ঘুমাও, ভালো কইরা ঘুমাও! আর শোন, ঘুমাবার আগে লাইটটা অফ করে দিও। বিদ্যুতের অপচয় করাটা ঠিক না!
এবার আমার মেজাজ খারাপ করার পালা। আমি বলি, ফরীদি ভাই, এসবের মানে কি? রাত দুপুরে ফোন কইরা মানুষের ঘুম ভাঙ্গাইয়া জিগাইতেছেন- ক’টা বাজে! তারপরে আবার ক’ন- ঘুমাও গিয়া! অহন আমার ঘুম আইবো কোত্থেইকা! ঘুমের চৌদ্দ গুষ্টি ছুইটা গেছে আমার! আপনি আমার ঘুম ফেরৎ দিয়া যান!
ফরীদি ভাই বলেনঃ:আরে মিয়া, আমার কাছে কি ঘুমের আড়ত আছে নাকি? এক কাম করো। আমি যেভাবে তোমারে ঘুম ভাঙ্গাইলাম, তুমিও আমাদের নাটকের বন্ধুদের কারো ঘুম ভাঙ্গাইয়া জিজ্ঞেস করো আপনার ঘড়িতে ক’টা বাজে! কিংবা বল- এত রাত পর্যন্ত ঘুমান নাই! আহারে, শরীর খারাপ করবেতো; তাড়াতাড়ি শুইয়া পড়েন। হা হা হা ……………। আরে মিয়া, this is call life, জীবনটারে enjoy করতে শেখো! মরার পরে দীর্ঘদিন ঘুমানোর সুযোগ পাইবা। এখন জীবনের এপিট-ওপিট দেখে নাও মিয়া! এরপরে তাঁর সেই খসখসে অট্টহাসি আর থামেনা। আমিও আরো কিছুক্ষণ কথা বলে অন্য আর একজনকে ফোন দিয়ে ঘুম ভাঙ্গিয়ে চলি!
এরপর হুমায়ুন ফরীদি সম্পর্কে কাওসার চৌধুরী আরো লিখেন, এই ছিলেন ফরীদি ভাই! উনাকে নিয়ে গল্প করতে গেলে দিনের পর দিন রাতের পরে রাত কেটে যাবে।
প্রচন্ড উদার মনের মানুষ। বয়স নির্বিশেষে চলচ্চিত্র এবং নাটকের সকল কর্মীগণ ছিলেন তাঁর নির্জলা বন্ধু। জীবনের ‘এপিট-ওপিট’ enjoy করেছেন ইচ্ছেমতো। খুব অল্প সময়ে অভিনয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়েছেন ঝট করে। ধুঁকে ধুঁকে নির্যাতিত হননি ফরীদি ভাই। রাজপুত্রের মতো চলে গেলেন সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করা, মুক্তিযোদ্ধা, অসীম সাহসী এই মানুষটির জন্য বুকের বাম দিকে খুব ব্যাথা হয়। শকুন্তলার সেই তক্ষক, মুনতাসির ফ্যান্টাসির মিষ্টার মুনতাসির, কীত্তনখোলার ছায়ারঞ্জন, ভাঙ্গনের শব্দ শুনি’র সেরাজ তালুকদার, অযাত্রার সেই স্কুল শিক্ষক কিংবা সংশপ্তকের রমজান- কোনটা ফেলে কোন চরিত্রের কথা বলি! সবক’টাতেইতো ‘তিনিই রাজা’!
এরপর ফরীদিকে উদ্দেশ্য করে কাওসার চৌধুরী লিখেন,
ফরীদি ভাই,
অনেক কষ্ট হয় আপনার জন্য। অনেক ভালোবাসি ফরীদি ভাই আপনাকে। যেখানেই থাকুন, অনেক ভালো থাকুন, সুন্দর আর নির্মল থাকুন। রাতে আমাদের সবার ঘুম ভাঙ্গিয়ে বলুন- আরে মিয়া, this is call life, জীবনটারে enjoy করতে শেখো! মরার পরে দীর্ঘদিন ঘুমানোর সুযোগ পাইবা। এখন জীবনের এপিট-ওপিট দেখে নাও!