স্বাধীনতা লাভের দু’দিন পর বঙ্গবন্ধুর পরিবারের খোঁজ পাওয়া যায়। ১৭ ডিসেম্বর মেজর অশোক কুমার তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে ধানমন্ডির ১৮নং রোডের বাড়িতে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সন্ধান পান। মাত্র ৩ জন সদস্যকে নিয়ে প্রায় ১ ডজন পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করে খুব দ্রুত ফজিলাতুন নেছা মুজিবদের শত্রুমুক্ত করেন মেজর অশোক। মেজর অশোক কুমার তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে রক্ষা করেন, পাকিস্তানি বাহিনী তারাকে হত্যার হুমকি দেয়। হুমকিকে উপেক্ষা করে নিরস্ত্র হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে আলোচনা চালিয়ে যান মেজর এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের অক্ষত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
আলোচনার মাধ্যমে পাকিস্তানি সৈন্যদের নিরস্ত্র অবস্থায় বাড়ির ভেতর থেকে বের করে নিয়ে আসেন বুদ্ধিমান মেজর। মেজর তারার টিম মিজোরামের পার্বত্য অঞ্চলে তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য চলে যায় কিন্তু মেজর তারা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের বিশেষ অনুরোধে থেকে যান। বেগম মুজিব অনুরোধ করেন, বঙ্গবন্ধু আসার আগ পর্যন্ত তিনি যেন তাদের নিরাপত্তা দেন। মেজর তারাও অত্যন্ত নির্ভরতা ও বিশ্বস্ততার সহিত অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছিলেন নিষ্ঠার সঙ্গে।
বিদায় বেলায় ফজিলাতুন নেছা মুজিব মমিনুল হক খোকার মাধ্যমে একটি ঘড়ি কিনে মেজর তারার হাতে পরিয়ে দেন। মমিনুল হক খোকার ভাষ্যমতে, “১৪ জানুয়ারি নাস্তার টেবিলে ভাবী বললেন, ১৬ ডিসেম্বর আমাদের যে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করেছিল সেই মেজর তারাকে ধন্যবাদ জানাতে তোমার একদিন তাকে চা খেতে ডাকা উচিৎ। মিঞা ভাই রাজি হলেন, আমাকে বললেন মেজর তারাকে নিমন্ত্রণ করতে, আরো বললেন মেজর তারাকে উপহার দেয়া যায় এমন কিছু একটা কিনে আনতে। তখনও ঢাকা শহরের দোকানপাট পুরোপুরি গুছিয়ে উঠতে পারেনি।
যাই হোক আমি অনেক কষ্টে একটা ওমেগা ঘড়ি সংগ্রহ করলাম। ভাবী বললেন ভালো হয়েছে। তুই মেজর তারাকে ঘড়িটা পরিয়ে দিবি, আমি ওর স্ত্রীর জন্য আমার কাছে কিছু পুরনো পার্লস আছে তাই দেব। আমি মেজর তারাকে মিঞাভাইর পক্ষ থেকে নিমন্ত্রণ করলাম একদিন। মেজর তারা এসেছিলেন। মিঞাভাই তাকে অভ্যর্থনা করলেন, কুশলাদি বিনিময়ের পর আমাদের পক্ষ থেকে মেজর তারাকে আমি ঘড়িটি পরিয়ে দিলাম। ভাবী দিলেন তার স্ত্রীর জন্য পার্লসের গয়না। মেজর তারা খুশী হলেন। তাকে নিয়ে মিঞা ভাই, ভাবী, আমি, আমার স্ত্রী, রেহানা সবাই ছবি তুললাম। কিছুক্ষণ থেকে তিনি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ফিরে যান”।
বঙ্গবন্ধু দেশে আসার পরেও মেজর তারা বেশ কিছুদিন ছিলেন তাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে। ব্যক্তিত্বে, আন্তরিকতায়, কর্তব্য এবং নিষ্ঠায় মেজর তারার উজ্জ্বল্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। মেজর তারার বউয়ের সাথে রেণুর ছিল সুসম্পর্ক, রেণুর ছেলেমেয়েদের খুব আদর করতেন মেজর দম্পতি। যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মেজর তারার সাথে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল বহমান। তাদের মধ্যে পত্রালাপে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। মেজর তারাও বঙ্গজননীর আন্তরিকতা ও ঔজ্জ্বল্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তিনি তার সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সেটি বলেছেন। মেজর তারার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ২০১২ সালে ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। মেজর তারার মতো ব্যক্তিত্বদের অবদান বাঙালি জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সহিত স্মরণে রাখবে। কারণ তিনি যুদ্ধের পরবর্তী অস্থির সময়ে বাঙালির বুকের ধন, রমণীদের অহংকার ফজিলাতুন নেছাসহ তার ছেলেমেয়েদেরকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নিম চন্দ্র ভৌমিকের ভাষ্যমতে, “মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথ কমান্ডের কাছে পাক হানাদার বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পরিবার বন্দি অবস্থা থেকে অনেক মানসিক যন্ত্রণা ও অত্যাচার ভোগ করার পর মুক্তিলাভ করে ১৭ই ডিসেম্বর। বিএলএফ এর আঞ্চলিক কমান্ডার আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, বাংলাদেশের প্রথম স্বরাষ্টমন্ত্রী আব্দুল মান্নান ও আমি মিত্রবাহিনীর হেলিকপ্টারে ১৮ই ডিসেম্বর ঢাকা অবতরণ করি। প্রয়াত আব্দুল মান্নান টাঙ্গাইলের দিকে চলে যান। আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদ আগেই মনস্থির করে রেখেছেন, তারা বেগম মুজিব ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে ১৮ নম্বর রোডের বাড়িতে যাবেন। আমিও তাদের সঙ্গী হিসেবে ওই বাড়িতে গিয়ে উঠলাম।
বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী আমরা রাতে ওই বাড়িতে ছিলাম এবং একত্রে খাবার খেয়েছি। পরদিন সকালে আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ অন্যত্র চলে গেলেন, রাজ্জাক ভাই আমাকে বলে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খুলেছে- তুমি জহুরুল হক হলে ওঠো (জগন্নাথ হলসহ কয়েকটি হলে তখন মিত্রবাহিনী অবস্থান করেছিল)। এরপরও আমি ১৯ তারিখ অতিবাহিত করে ২০ তারিখ সকালে জহুরুল হক হলে চলে যাই। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আমার এ ৩৬ ঘণ্টা জীবনের অত্যন্ত স্মরণীয় দিন এবং তার পরিবারকে কাছ থেকে দেখার এবং অনুধাবন করার সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছিল এবং এজন্য আমি সৌভাগ্যবান।
বেগম মুজিব সে সময় জানেন না তার স্বামী জীবিত আছেন কিনা এবং ফিরে আসবেন কিনা। সে সময়টা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। তার বুকে ব্যথা ছিল; কিন্তু জাতির বিজয়ে তিনি ও উদ্বেলিত। নেতাকর্মীদের প্রতি তার দরদ ও আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না। আমার স্মরণ আছে, রাতে খাবার টেবিলে আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ এবং ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে তিনিও খাবার টেবিলে বসেছিলেন।
সেই টেবিলে আমারও তাঁর পাশে বসে খাবার গ্রহণের সৌভাগ্য হয়েছিল। আমার স্মরণ আছে, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি তখন বসেননি। খাবার ও অন্যান্য বিষয়ে দেখাশোনা করেছিল।”
পরিবারের চরম দুঃসময়ে ফজিলাতুন নেছা মুজিব দলের নেতাকর্মী ও অন্যান্যদের সাথে সর্বদাই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন।
চলবে…