বংশী নদীর তীর ধরে কাগজিয়া গ্রামের পালপাড়া । সেখানে একচালা ঘরের ভেতর বসে মাটির টব বানাতে ব্যাস্ত মালতী রানী(৬০)। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়েছে। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই তার। বৈশাখ আসতে বাকি নেই। তাই তার কাজের চাপ অনেক। কেবল মাটির টবই নয়। মালতীর হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয়, রঙিন পুতুল, দরকারি মাটির হাড়ি কিংবা ঘর সাজানোর জিনিস পাতি।
ওদিকে উঠানের রোদে মাটির থালা শুকাচ্ছিলেন নায়ারণ পাল। পাশেই মাটির তৈরি খেলনাগুলোতে রঙ লাগাচ্ছিলেন নিতাই পাল। তবে আগের মতো সেই ব্যস্ততা আর জৌলস নেই বলে জানান তিনি। কালের আবর্তে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে এদেশের মাটির তৈরি মৃৎশিল্প।
কাজের ফাঁকে কথা হয় মালতী রানীর সাথেও। বয়স ষাট পেড়িয়ে গেছে, পড়নে উঠেছে বিধবার সাদা শাড়ি। হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন ‘প্ল্যাস্টিক হামগো ভাত মাড়ছে, এটা বন্ধ না হলে পালদের জীবন শেষ’। প্লাস্টিকের তৈরি পণ্যের কারণে মাটির তৈরি এসব জিনিসের ভালো দাম জোটে না বলে অভিযোগ তার।
তার সাথে সুর মেলান কুমার হেমন্ত পাল। পয়ত্রিশ বছর ধরে এ পেশায় আছেন তিনি। কুমোর সম্প্রদায় এখন তাদের অস্তিত্ব হারাতে বসেছে বলে জানান তিনি। একসময় বৈশাখী মেলা হতো। সারা দেশেই বিক্রি হতো তাদের তৈরি মাটির তৈজসপত্র। গৃহিণীর রান্নায় দেখা যেত মাটির হাড়ি। মাটির কলসিতে থাকত দরকারি থাকতো দরকারি জল । এছাড়া মাটির তৈরি হাতি,ঘোড়া আর আলপনা আঁকা সামগ্রী স্থান পেত শৌখিন মানুষদের ঘরে।
কিন্তু মানুষ এখন প্লাস্টিক, পলিথিন কিংবা মেলামাইনের জিনিসের প্রতি ঝুঁকছে বেশি।
খেলনা তৈরির জন্য কাঁদা মাটি প্রস্তুত করছিলেন দোলু পাল । একটা মাটির কুমির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, বংশী নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তাই মাটির জিনিস পাতি বানানোর দরকারি এঁটেল মাটিও আর পাওয়া যায় না আর সহজে। তাই চাহিদা থাকলেও উৎপাদন কমে যাচ্ছে তাদের।
তার মুখে শোনা যায় অন্য আরেক গল্প। জব্বরের বলি খেলা উপলক্ষে মাটির জিনিসের জমজমাট মেলা বসতো চট্টগ্রামে। মাটির খেলনা বানিয়ে বিক্রি করতে চলে যেতেন সেখানে। তার ছেলেরা আর বাপের পেশায় থাকার সাহস পায় নি। কিন্তু অনেকই এই পুরনো পেশা আঁকরে ধরেই থাকতে চান। হেমন্ত পাল বলেন, আমার দাদার কাছে কাজ শিখেছিলাম। এখন কি আর এ তিন পুরুষের পেশা ছাড়া যায়? কুমোর পাড়ার সবার মুখেই শোনা গেছে ন্যায্য দাম না পাবার অভিযোগ।
মালতী রানী সর্বোচ্চ দশটি মাটির টব বানাতে পারেন প্রতিদিন। মহাজনের কাছে মাত্র ১২ টাকা দরে কিনে নেন তার শ্রম। মাস শেষে যে আয় হয় তাতে সংসার চলে না তার।
বৈশাখকে পালরা বলে ‘পালানি’ মাস। এ সময় তারা কাজ কাম করে না কিছুই। তাই আয় রোজগারও থাকে না একদম। এ সময় অর্ধাহারে থাকতে হয় তাদের।
অধ্যাপক গোলাম মুরশিদের ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বই থেকে জানা যায়, বাংলায় মৃৎশিল্প তথা কুমোরদের ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে প্রাচীন কাল থেকে। তাদের তৈরি পোড়া মাটির ফলক টেরাকোটার খ্যাতি ছিল বিশ্বব্যাপী। তাই কুমোরদের এ পেশা বাঙ্গালির নিজস্ব ঐতিহ্যের সাথে জড়িত।
তাই এ পেশাকে টিকিয়ে রাখতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান সাভারের মাটির জিনিস পত্রের দোকানি রিপন পাল। দোকান ভাড়া বেড়ে যাওয়া ও পঁচিশ শতাংশ ট্যাক্সের কারণে দিন দিন সবকিছু কঠিন হয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।