শিক্ষকদের আন্দোলন চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলনের দিকে দেশের নজর- গুরুত্ব বেশি। তারা যে ভালো এবং শ্রেষ্ঠ শিক্ষক সে কারণে না। কারণ তারা রাজনীতি করেন! দলীয় রাজনীতিতে তারা ফ্যাক্টর! টকশোতে অংশ নেন। পত্রিকায় লিখেন। চাইলেই হাসিনা-খালেদার সঙ্গে দেখা করতে পারেন।
শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনের কারণ শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর দাবিতে না। তাদের বেতনভাতা স্কেল এসব বাড়ানোর দাবিতে। যোগ্য শিক্ষকদের বেতনভাতা অবশ্যই বাড়ানো দরকার। কিছু শিক্ষকের সম্মান রাষ্ট্রপতি-স্পিকার-প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতিদের পরেই রাখার পক্ষে আমি। কিন্তু সব শিক্ষক তেমন স্থান পাওয়ার যোগ্য না। পড়াশুনা অথবা একাডেমিক কেরিয়ার না, দলবাজি-তেলবাজিতে তারা ওই স্থান পেয়ে গেছেন!
শিক্ষকরা হয়তো এসব বিষয় নিয়ে কথা তোলায় ক্ষিপ্ত হয়ে বলবেন, দলবাজি-তেলবাজি কোথায় নেই? কথা সত্য। কিন্তু সবার আগে যে শিক্ষককে ঠিক হতে হবে। শিক্ষক যেমন হবেন তেমন পয়দা করবেন ছাত্র।
শিক্ষামন্ত্রী আন্দোলনরত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। অন্য স্তরের শিক্ষকদের সঙ্গেও বৈঠক করে তাদের বেতন সম্মানজনক বাড়াবেন আশা করছি। কিন্তু শিক্ষকতার পেশাকেও একটি শৃংখলায় আনার উদ্যোগ নেয়া জরুরি। দুর্ভাগ্যক্রমে আর সব শ্রেনী পেশার মতো বাংলাদেশের শিক্ষকদের বড় অংশ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন! শিক্ষকদের দুর্নীতি দেশ-সমাজকে বেশি স্পর্শ-প্রভাবিত করে। কারণ তাদের মাধ্যমে সৃষ্টি হচ্ছে একদল দুর্নীতিবাজ ছাত্রের!
একটা দেশের সচেতন মানুষজন রাজনীতি সচেতন হন-হবেন এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু পেশা যেমন শিক্ষক-সাংবাদিক-সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী-চিকিৎক-প্রকৌশলী এরা যদি প্রত্যক্ষ দলীয় রাজনীতিতে জড়ান, সে দেশ-সমাজে নৈরাজ্য ছাড়া কিছু ঘটতে পারেনা। আমাদের দেশে তাই হয়েছে এবং চলছে!
শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ দলীয় রাজনীতি ছাত্রদের সরাসরি প্রভাবিত করে! আজকাল কিছু শিক্ষক ছাত্রদের গুন্ডার মতো ব্যবহার করছেন! সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে তা আমরা দেখেছি! দলীয় সাদা-নীল-গোলাপী এসব প্যানেলে বিভক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা! এদের কাছে কি করে নিরপেক্ষ ছাত্র পড়ানো অথবা সৃষ্টি আশা করা যায়?
একবার সিডনিতে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষককে আমি বড়দিনের উপহার দিতে চাইলাম। আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি সবিনয়ে বলেন, তার চাকরির শর্তানুসারে তিনি কোনো ছাত্র থেকে এ ধরনের উপহার নিতে পারেন না। কারণ তার হাতে আমার মার্কস সহ ফলাফলের নানা বিষয় জড়িত। এদেশে কোনো শিক্ষক কোনো ছাত্রের বাড়িতে দাওয়াতে যান না বা যেতে পারেন না। সংশ্লিষ্ট স্কুলের কোনো ছাত্রকে প্রাইভেট পড়াতে পারেন না কোনো শিক্ষক। কোনো ছাত্রকে তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা মনে হলে তার জন্য বাড়তি ক্লাস অথবা যত্মের উদ্যোগ নেয়া হয়। শিক্ষক মনে করেন, এটাই তার দায়িত্ব।
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা, এনজিও সহ নানাকিছুর সঙ্গে যে জড়িত এটাও কি এক ধরনের দুর্নীতি নয়? কারণ কোনো প্রেমতো পার্ট টাইম বা আংশিক রঙ্গিন নয়। আপনাকে এখানে একটু ওখানে একটু প্রেম করলেতো কোনো প্রেমের প্রতিই সুবিচার করলেন না!
ভিজিটিং প্রফেসর পদ সারা পৃথিবীতে আছে। বছরের একটা সময় মূল চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে একজন অধ্যাপক আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে সেখানে বিশেষ কিছু লেকচার দিতে যান। কিন্তু আপনাদের অনেকেতো সারা মাসই ভিজিটিং! ঢাকার এক প্রান্ত আরেক প্রান্ত শুধু ভিজিটই করছেন! সকালে আপনার ক্লাস, কিন্তু আগের গভীর রাত অবধি আপনি টকশো নিয়ে ব্যস্ত! তাহলে সকালের ক্লাসের প্রতি আপনি সুবিচার করবেন কি করে? এমন সব পারেন, সবকিছুতে স্পেশালিস্ট শিক্ষক শুধু বাংলাদেশেই আছেন!
প্রিয় শিক্ষকবৃন্দ, অপরাধ নিয়েন না। আপনারা সারাদিন সাংবাদিক সহ দেশের নানা শ্রেনীপেশার মানুষজনের আত্মজিজ্ঞাসার পরামর্শ দেন! আপনারা কি আত্মজিজ্ঞাসা করেন? শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর পক্ষে থাকুন। একইসঙ্গে তাদেরকে এই প্রশ্নগুলোও করুন। কারণ রাষ্ট্র আপনার বেতন বাড়ালো, কিন্তু এরপরও যদি আপনারা এখনকার মতো চাকরির বাইরে অন্যত্র ব্যস্ত থাকেন বেশি তাহলে মানুষ কেন আপনাদের পক্ষ নেবে?
প্লিজ প্রিয় শিক্ষকবৃন্দ, আয়নায় দেখুন নিজের মুখ। আমি প্রাইমারী-হাইস্কুলের শিক্ষকদের আরও বেতন বাড়ানোর পক্ষে। কারণ তাদের হাতেই সৃষ্টি হয় একজন ছাত্রের ভিত্তি। কিন্তু তাদেরকে একই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট পড়ানো সহ দুর্নীতির পথগুলো বন্ধ করতে হবে। বেতন বাড়ানোর পরেও হয়তো বলা হবে পোষায়না! কার কততে পোষাবে তার কোনো সীমা পরিসীমা কিন্তু নেই। শুধু একটা সত্য মাথায় রাখবেন? আপনি যে এখানে এসেছেন তাতো কেউ আপনাকে হাতেপায়ে ধরে আনেনি! আপনার না পোষালে আপনাকে এখানে পড়ে থাকতে কে হাতেপায়ে ধরেছে?
বাংলাদেশের রাস্তার ফুটপাতে যে লোকটি পিঠা বিক্রি করে সেই লোকটিও একটা সংসার চালায়। তার কাজটি সে কিন্তু সিরিয়াসলি করে। আমাদের সকল পেশায় এমন সৎ আন্তরিক সিরিয়াস লোক দরকার। অজুহাত মাষ্টার নয়।