বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মতে, আনন্দহীন শিক্ষা; শিক্ষা নয়। যে শিক্ষায় আনন্দ নেই, সেই শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। আমাদের তথাকথিত শিক্ষা ব্যবস্থা আজ প্রাথমিক শিক্ষাকে আনন্দহীন করে তুলেছে। শিশু বিদ্যালয়ে যায় ঘুম ঘুম চোখে। বিদ্যালয়ে সারাদিন টানা ক্লাস। যেখানে পর্যাপ্ত খাওয়ার সময়ও থাকে না। যে বয়সে ছোটাছুটি, খেলাধুলা করে আনন্দ নিয়ে শিশু ক্লাস করবে, সেখানে বিরতিহীন ক্লাসে পাঠ গ্রহণ করা বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। তবে কি শিশুদের জন্য আনন্দময় স্কুল হবে না?
স্কুল শুরু হয় সকালবেলা একেবারে ঘোড়দৌড়ের মতো করে। ঘোড়দৌড় বললাম এই জন্য, ঘোড়ার যেমন কাজ সামনের দিকে শুধু ছোটা, এদিক ওদিক তাকানোর কোনো উপায় নাই, ঠিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচিও দৌড়ের মতো। সকাল ৯ টায় স্কুলে পৌঁছাতে হবে। ৯টা থেকে সোয়া ৯টা পর্যন্ত সমাবেশ। সোয়া ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ক্লাস চলবে প্রাক-প্রাথমিক, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির। ১২টায় ছুটি হয় প্রাক প্রাথমিক, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির। ১২টা থেকে সোয়া ১২টা পর্যন্ত সমাবেশ। সোয়া ১২টা থেকে দ্বিতীয় শিফটের ক্লাস শুরু দেড়টা পর্যন্ত। দেড়টা থেকে ২টা পর্যন্ত টিফিন। ২টা থেকে সোয় ৪টা পর্যন্ত ক্লাস। এই নিয়ম চলে দুই শিফটের স্কুলে।
এক শিফটের স্কুলে ৯টা থেকে সোয়া ৯টা পর্যন্ত সমাবেশ। সোয়া ৯টা থেকে সোয়া ১টা পর্যন্ত ক্লাস প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণির। সোয়া ১টায় ছুটি হয় প্রাক প্রাথমিক, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির। সোয়া ১টা থেকে ১টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত টিফিন চলে। ১টা ৪৫ মিনিট থেকে সোয়া ৪টা পর্যন্ত আবার ক্লাস চলে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির। এমন কি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের রমজান মাসেও স্কুলে আসতে হবে দুই-এক ঘণ্টার জন্য। পঞ্চম শ্রেণির পাঠ এত দীর্ঘ যে তার কোনো ছুটি নাই। তা দেখে মনে হচ্ছে পঞ্চম শ্রেণির শিশু সমাপনী পরীক্ষা না, যেন এমফিল বা পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করবে। আর এই সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে অন্য বিদ্যালয়ে গিয়ে বেশ কয়েকটা মডেল টেস্ট দিতে হয়। স্কুলে পরীক্ষাই শিশুর কাছে ভীতিকর। তার উপর অন্য বিদ্যালয়ে গিয়ে পর পর পরীক্ষা দিতে হয়। শিশুর কোমল মনে এটা আরো বেশি ভীতি সৃষ্টি করে। কেন এত চাপ, কেন স্কুলে এত দীর্ঘ সময়সূচি। তবে সাম্প্রতিক যে পরিপত্র বিদ্যালয়ে এসেছে সেটাতে সময়সূচি কমেনি । শুধু সমাবেশ দুই শিফটের স্কুলে একবার হবে, সেটাই উল্লেখ আছে।
৯টা থেকে সোয়া ৪টা পর্যন্ত একবার বিরতি থাকে, ৩০ মিনিট সময় দেওয়া হয় দুপুরের খাবারের জন্য। এই সময়ের মধ্যে শিক্ষকদের হাত মুখ ধোয়া, কারো কারো অজু করে নামাজ কায়েম করা এবং দুপুরের খাবার খাওয়া। এত স্বল্প সময়ের মধ্যে নামাজ ও খাওয়া শেষ করতে হিম শিম খেতে হয়। ক্লাসের ফাঁকে কোন রকম বিরতি নেই, একজন শিক্ষক দিনে কতটা ক্লাস নিতে পারে। তবে শিক্ষকদের ক্লাস নিতে হয় আরও বেশি। সারাদিনে ৮টা ক্লাসও নিতে হয়।
এতে শেষের দিকে এসে শতভাগ মনোযোগ থাকে না। মস্তিষ্কও কাজ করে না। আদর্শক্লাসে ৩৫-৪০জন ছাত্রছাত্রী থাকার কথা, কিন্তু ক্লাস আদর্শ হোক বা না হোক ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশি থাকে এবং শিক্ষক পর্যাপ্ত না থাকার কারণে শাখা করাও যায় না। এমন স্কুলও আছে যে স্কুলে একজন শিক্ষক হয়তো ডিপিএড করছেন, একজন মাতৃত্ব ছুটিতে আছেন, স্কুল চলছে তিনজন শিক্ষক দিয়ে। সেক্ষেত্রে কতটা চাপ নিয়ে শিক্ষকতা করতে হয় ভেবে দেখার বিষয়। তার উপর যদি ঘড়ির কাটার এত ছুঁই ছুঁই অবস্থা হয় তাহলে তো কোন কথাই নাই।
প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও যদি এসির (এয়ার কন্ডিশন) পাওয়ার প্রয়োজনের তুলনায় বাড়িয়ে দেওয়া হয় ঠান্ডা লেগে যায়। মন চায় স্বাভাবিক গতিতে চলুক তাপমাত্রা। এ থেকে বোঝা যায় মানুষ কোনকিছু বেশি ভোগ করতে পারে না। উদাহরণটা ঠিক নিম্ন পর্যায়েও একই রকম। বলছি না স্কুলে এসে ঘণ্টা ঘণ্টা বিরতি থাক। তবে মস্তিষ্ক সতেজ রাখার জন্য সামান্য বিরতি ভালো ছাড়া মন্দ নয়। যে কাজে আনন্দ নেই সেই কাজকে কাজ না, ‘মাটি দিয়ে পাথর কাটা মনে হয়।’ সোয়া ৯ টায় প্রথম শ্রেণিতে যে আনন্দঘন শ্রম দেওয়া হয় সাড়ে ৩টায় ক্লাসে আনন্দটা ঠিক ম্লান হয়ে যায়। শ্রমটা থাকে বটে।
আমাদের তো মানব মস্তিষ্ক, এটাতো যন্ত্র নয়। শিশুদের ক্লাস নেওয়ার মাঝে একবার চা বিরতি প্রয়োজন। শুধু শিক্ষক না, ছাত্রছাত্রীদেরও বিরতি প্রয়োজন। ৩টার ক্লাসে অনেক ছাত্রছাত্রীর চোখে ঘুম ঘুম ভাব দেখা যায় এবং ক্ষুধার ভাব দেখা যায়। বাড়িতে থাকলে যে শিশু কিছু সময় পর পর এটা সেটা খায়, স্কুলের এই দীর্ঘ সময়ে তার খাবার খাওয়া খুব কম। পঞ্চম শ্রেণির একজন ছাত্র স্কুলে আসে ৯টায় খাবার খায় দেড়টায়। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তার খাবারের প্রয়োজন অবশ্যই আছে মনে হয়। পেটে ক্ষুধা থাকলে পাঠে মনোযোগ আসে না।
ঘরোয়াভাবে শিক্ষক হিসেবে আমি যতই বলি বাড়ি থেকে হালকা কিছু খাবার আনবে যখন ক্লাস থেকে শিক্ষক বের হবে সাথে সাথে খাবার খেয়ে পানি খাবে, তাহলে আর ক্লান্ত লাগবে না। এটা শিক্ষক হিসেবে করতে বললেও সময়সূচি তা বলে না। এই ক্ষোভগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝে দেখতে পাওয়া যায়। তবে শিশুরাও এই ক্ষোভ থেকে দূরে নয়। ঘড়ির কাটার ৯টায় স্কুলে উপস্থিত হবার পর ক্লাস ছাড়া তাকে কিছু করতে দেখা যায় না। সব আনন্দ কিন্তু তার ক্লাসে থাকে না। কিছু আনন্দ খেলার মাঠেও থাকে।
খেলা শিশুর সময় অপচয় নয়। খেলার মাধ্যেমে শিশুর পেশী শক্তিশালী হয়। ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত সনদ অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু। আমাদের জাতীয় শিশুনীতিতে কেবল ১৪ বছরের কম বয়সীদের শিশু ধরা হচ্ছে। সেই হিসাবে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির ছেলে মেয়েরা শিশুর মধ্যে পরে। কিন্তু ওদের খেলার সময় কোথায় স্কুলে আসার পর? স্কুলে আসার পর শিশুদের খেলার সময়সূচি থাকলেও চোখে পরছে না। একেবারে গৎবাঁধা নিয়মে ক্লাস করে যাচ্ছে। বিদ্যালয়ের মাঠ শুধু জানুয়ারি মাসে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য নয়, নিত্যদিন শিশু কেলাধুলা করবে, ক্লাস করবে।
কিন্তু সে সুযোগ তাদের নেই। তবে টিফিনের সময়ে দেখা যায় খেলার জন্য কোন কোন শিশু খুব দ্রুত খাবার খেয়েই খেলতে নামে, ৩০ মিনিট সময়ের মধ্যে। কারণ খেলার সময় সে পায় না। স্কুলেও সময় নেই, অনেক শিশুর বাড়ি দূরে হওয়াতে বাড়ি ফিরেও খেলার সময় থাকে না।
ওদিকে পাঠ্যপুস্তক অনুচ্ছেদে বর্ণনা করা মিতা স্কুলের উদ্দেশে যায় ৯টায়, তার স্কুল চলে ৩টা পর্যন্ত, সাগরের ক্লাস শুরু হয় ১০টা থেকে। শিশুরা শ্রেণিতে এই প্রশ্ন করে থাকে, তাদের বইয়ের সাথে তাদের স্কুলের সময়ের মিল নেই। তারা ক্লাস করে সোয়া ৪টা পর্যন্ত। অধিক সময় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অতিবাহিত করার চাইতে, স্বল্প সময় আনন্দ ও শিক্ষণীয়ভাবে কাটানো কি যুক্তি যুক্ত নয়, প্রশ্ন রইল।
শিক্ষা হতে হবে ছাত্র এবং শিক্ষক উভয়ের জন্য আনন্দদায়ক। মনের সাথে মস্তিষ্কের যোগ আছে। যার কারণে বিদ্যালয়ে ছুটির বেল বাজলে যতো ভালো ক্লাস নেওয়া হোক না কেন, কারো সাধ্য নাই ছুটির ঘণ্টা বাজার পর ছাত্রছাত্রীদের দুই মিনিট পাঠে শতভাগ মনোনিবেশ করানো। সোয়া ৯টা থেকে সোয়া ৪টা পর্যন্ত ক্লাসরুমে থেকে শিশুমন পুরাই ক্লান্ত। পাঠ যেন নিরস, ক্লাসরুম যেন বদ্ধ ঘর। কারণ একটাই, শিশুরা ক্লাসরুম ছাড়া কোথাও সময় নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলতে মহাবিচারক আছেন। তার পদার্পণ হয়ে থাকে বিদ্যালয় পর্যবেক্ষণ করার জন্য, ক্লাস টাইমে শিক্ষক ক্লাসে আছেন কিনা। আর স্কুল মানেই ক্লাস টাইম, সেখানে খেলাধুলা বলে কিছু নাই। আর তাই শিক্ষকরা নিজেদের হাল ঠিক রাখতে ছাত্রছাত্রীদের মাঠে যেতে দিতে নারাজ। ভয়ে ভয়ে পাঠদান আর ভয়ে ভয়ে পাঠ গ্রহণ, সে পাঠে নেই কোন আনন্দ আয়োজন।
স্কুল হোক আনন্দঘন পরিবেশ, এত গৎবাঁধা নিয়ম কেন। যে নিয়ম মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা মানে না, সেই ধারাবাহিক প্রক্রিয়া চালানো হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শিক্ষা প্রদানে থাকুক রস, আর শিক্ষা গ্রহণে যেন মনে হয় সেই রস আস্বাদন করছি। এ কথা যেন মনে না হয় ঘণ্টা বাজার অপেক্ষা করছি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচির উপর এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উপর শিশুর সারাদিনের খাদ্য চাহিদার পুষ্টিমান বজায় রেখে আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি করা হোক। বিদ্যালয়কে শিশু যেন প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় ‘জোর করে গলধকরণ’ মনে না করে, বিদ্যালয়কে যেন পাঠশালা ও আনন্দশালা দুটোই মনে হয়। শিক্ষা হোক শিশু সহায়ক। শিশু মানসিকভাবে বেড়ে ওঠার বয়সের কথা চিন্তা করে তার বিদ্যালয়ের সময়সূচি, খাদ্য, পুষ্টি ব্যবস্থা, খেলাধুলা এবং পরীক্ষার ব্যবস্থা হোক শিশুর বয়স উপযোগী যা শিশুর পাঠকে তরান্বিত করবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)