হঠাৎ করেই ফেসবুকে একটি ভিডিও চোখে পড়লো। আল জাজিরা ভিডিওটি শেয়ার করেছে, যা দেখে আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু পছন্দ করেছে। ভিডিওটি ফেসবুকের কর্ণধার মার্ক জাকারবার্গ গত বুধবার মার্কিন কংগ্রেসে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন তার সংক্ষিপ্ত রূপ। মাত্র সাড়ে তিন মিনিটের এই ভিডিওতে দেখা যায় কংগ্রেসনাল কমিটির একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে জাকারবার্গ নাস্তানাবুদ হয়েছেন।
আমার কাছে মনে হয়েছে প্রশ্নগুলো একদম সরাসরি, খুবই প্রাসঙ্গিক, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও কোথায় শুধু হা বা না বলে এর উত্তর দেয়া যায় না। কেননা বিষয়টা বেশ টেকনিক্যাল এবং প্রশ্নকারীরা বেশিরভাগ টেকনিক্যাল নয়।
ফেসবুক ইন্টারনেটের কয়েকটি জনপ্রিয় সাইটের একটি। বলা বাহুল্য, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ইন্টারনেটের প্রসার, ব্যবহার বাণিজ্যিকিরণ এবং মনের ভাব প্রকাশের একটি মাধ্যম তৈরীর জন্য ফেসবুকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন ফেসবুক কীভাবে এতো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করে?
গত ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালে ফেসবুকের আয় ছয় গুণ বেড়ে এখন ৪০ বিলিয়ন ডলার এর বেশি। ফেসবুক গুগলের মতোই মূলত একটি বিজ্ঞাপানী সংস্থা। অন্যান্য গতানুগতিক বিজ্ঞাপনী সংস্থার সাথে ফেসবুকের একটি পার্থক্য হচ্ছে এই প্ল্যাটফর্ম এ বিজ্ঞাপনটি আসল কাস্টমারের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া যায় একদম ঠিক সময়ে। ধরা যাক, আমার একটি গাড়ি কিনতে হবে। এই খবরটি যদি কোনো গাড়ির কোম্পানি জানতে পারে এবং তারা যদি আমার কাছে দ্রুত তাদের গাড়ির বিভিন্ন মডেলের বিজ্ঞাপন সহ হাজির হতে পারে তাহলে আমি তাদের গাড়িটি কিনে ফেলতে পারি।
এমনি করে যদি সঠিক কাস্টমারের কাছে বিজ্ঞাপন পৌছে দেয়া যায় তাহলে বিজ্ঞাপনের খরচ অনেক কম হবে এবং গাড়ির কোম্পানি এই পয়সা দিয়ে অন্যকিছু করতে পারবে। ফেসবুক এ আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের মনের ইচ্ছা, কী করতে যাচ্ছি, কোনটা পছন্দ করি, কোথায় চেক-ইন করলাম এবং কার সাথে
বন্ধুত্ব করলাম এই তথ্যগুলো দিয়ে যাচ্ছি। ফেসবুক এই তথ্যগুলো প্রতিনিয়ত সংগ্রহ করে এবং এই তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপনের সঠিক ক্রেতা খুঁজে বের করে। গুগলও এ কাজটি করে থাকে, কিন্তু ফেসবুক যেহেতু সামাজিক যোগাযোগের একটি মাধ্যম, ফেসবুকে আরও বেশি পার্সোনাল ডাটা থাকে।
মূলত ইন্টারনেটে বেশিরভাগ কোম্পানি কম বেশি ডাটা সংগ্রহ করে বা ডাটা থেকে থার্ড পার্টির মাধ্যমে আয় করে থাকে। ধরা যাক, আমার একটি ওয়েবপেজ আছে যাতে প্রতিদিন ১০ হাজার ভিজিটর আসে। এখন, আমি ইচ্ছা করলে আমার সাইটটি গুগলের বিজ্ঞাপন নেটওয়ার্ক এ সংযুক্ত করতে পারি। সেক্ষেত্রে ভিজিটরের
লোকেশন, ভাষা, রেফেরার ইত্যাদি তথ্য দেখে গুগল উপযুক্ত বিজ্ঞাপনটি আমার ওয়েবসাইটের ফাঁকা/নির্ধারিত স্থানে বসিয়ে দিবে এবং এর বিনিময়ে যত বেশি ভিজিটর ওই বিজ্ঞাপনটি দেখবে অথবা ক্লিক করবে ততো বেশি আয় করবো আমি ।
মজার ব্যাপার হলো থার্ড পার্টি অনেক বিজ্ঞাপনী সংস্থা আছে যাদের কাজ আপনি যে যে সাইট এ ব্রাউজ করছেন তা মনিটর করা এবং বিভিন্ন সাইটের তথ্য একত্রিত করে আপনার একটি নির্ভুল প্রোফাইল তৈরী করা যেটা দেখে বলা যাবে আপনি কোন পণ্যটি কিনতে চান বা ভবিষ্যতে কিনবেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই তথ্য সংগ্রহের কাজটি আপনার অগোচরে হয় এবং এখন পর্যন্ত ইন্টারনেট তেমন কোনো বেস্ট প্র্যাকটিস নাই যাতে করে আপনার ব্যক্তিগত তথ্যকে কীভাবে ব্যবহার করছে তা জানা যায় বা জানানো হয়।
এককভাবে শুধু ফেসবুককে দায়ী করে যাবে না, কিন্তু সম্প্রতি যে বিষয়টির জন্য ফেসবুক নিয়ে মিডিয়াতে ঝড় উঠেছে এবং জাকারবার্গকে কংগ্রেসে হাজিরা দিতে হলো তার প্রেক্ষাপটটি জানা দরকার। ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনের সময় ফেসবুকের প্লাটফর্ম/ডাটা ব্যবহার করে ক্যামব্রিজ এনালিটিক্স নামের একটি বিতর্কিত কোম্পানি। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলোজির অধ্যাপক আলেক্সান্ডার কুগান গবেষণার কথা বলে একটি সার্ভে করার জন্য ফেসবুক ব্যবহারকারীদের একটি অ্যাপ ডাউনলোড করতে বলে যেটি তাদের অগোচরে বেশকিছু পার্সোনাল ডাটা যেমন জন্ম তারিখ, লোকেশন, ধর্ম, পলিটিক্যাল সাপোর্ট, পছন্দ, বন্ধুদের লিস্ট সংগ্রহ করে।
পরবর্তীতে ড. কুগান এই ৫০ মিলিয়ন ফেসবুক ব্যবহারকারীর প্রোফাইল ডাটা দিয়ে ক্যামব্রিজ এনালিটিক্স কোম্পানি প্রতিষ্টা করে। ড. কুগান গবেষণার মাধ্যমে একটা এলগোরিদম উদ্ভাবন করেছে যাতে যদি কোনো ব্যক্তির ৫০টি লাইক ইনপুট হিসেবে দেয়া যায় তা হলে জানা যাবে সে কোন পলিটিক্যাল পার্টিকে ভোট দিবে, ১৫০টি লাইক থেকে তার সম্পর্কে তার একান্ত আপন জন থেকে বেশি তথ্য জানা যাবে।
এই কারণে ক্যামব্রিজ এনালিটিক্স পলিটিক্যাল ক্যাম্পেইনের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, কেননা এতে করে ভোটারের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া যায় এবং তাদেরকে এমন কথা বলা যায় যেটা শুনলে তারা ভোটের সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনতে পারে। শুধু তাই না, এই মেসেজগুলা তৈরী করার জন্য কম্পিউটার প্রোগ্রামই যথেষ্ট। আমরা যে এতো ফেক নিউজের কথা শুনছি, তার জন্ম এখান থেকেই। লক্ষ্য করার বিষয় গত ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনের বছরে ফেসবুকের আয় ১৭ থেকে ২৭ বিলিয়নে গিয়ে দাঁড়ায়।
এখন যে কারণে ফেসবুককে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে, তা হচ্ছে ফেসবুক কীভাবে ব্যক্তিগত তথ্য থার্ড পার্টি অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে ক্যামব্রিজ এনালিটিক্সকে ব্যবহার করতে দিলো। তারা কি জানতো না এরকম একটি ঘটনা ঘটছে? জানলে কেন তারা ক্যামব্রিজ এনালিটিক্সকে প্লাটফর্ম ব্যবহার করতে দিলো? ফেসবুক ইতোমধ্যে ২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন, ডিলিট ফেসবুক নামের একটি আন্দোলন বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। কিন্তু শুধু কি ফেসবুক দায়ী?
কংগ্রেসের একটি প্রশ্ন ছিল জাকারবার্গের কাছে ‘আর ইউ উইলিং টু চেঞ্জ ইওর বিজনেস মডেল ইন্টারেস্ট অফ প্রোটেকটিং ইন্ডিভিজুয়াল প্রাইভেসী?’ গোটা ইন্টারনেটের বিজনেস মডেল যেখানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর তথ্য নিয়ে বিজ্ঞাপনের আয়, সেখানে ফেসবুকের একার কী করার আছে?
আমরা যদি প্রাইভেসি নিয়ে আসলেই উদ্বিগ্ন হই তাহলে আমাদের দরকার হবে সচেতনতার। কোনো কিছু ডাউনলোড করার আগেই দেখা উচিত অ্যাপ্লিকেশন বা সাইটটি কী করতে চাচ্ছে, কোথায় ডাটা রাখছে, এনক্রিপ্ট করছে কিনা অথবা অন্য কারো সাথে ডাটা শেয়ার করছে। সর্বোপরি, আমরা https এনাবল্ড সাইট এ যাচ্ছি কিনা। বলতে খারাপ লাগে, গত দুনিয়ার বেশির ভাগ সাইট এখন https এনাবল্ড, কিন্তু এই দিক দিয়ে বাংলাদেশ একদম পিছিয়ে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)