দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে বর্তমান সরকার। কিন্তু তারপরও থেমে নেই দুর্নীতি। নিত্যনতুন খবরে জনগণ হিসাব কষে বাজারের চলতি দরে বালিশ-পর্দা-বইয়ের মূল্যের। আর আমলাদের নানা প্রশিক্ষণ বা অন্য কারণে বিদেশ সফরের টাকার অংক দেখে প্রশ্ন জাগে- টাকা কি গাছের পাতা?
সার্বিকভাবে একটি দেশ পরিচালনার দায়িত্ব সরকারের। আর সরকার রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করে আমলারা। দেশ এবং জনগণের সেবক হিসাবে তাদের হাতে ন্যস্ত থাকে সরকারের উন্নয়নের নানা প্রকল্প। যার মাধ্যমে সরকার তার কর্মপরিকল্পনার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।
অন্যভাবে বলা যায়, দেশের প্রশাসন ব্যবস্থাই সরকারের মূল চালিকা শক্তি। আর সে কারণে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থাকা বা না থাকার প্রশ্নটি প্রশাসনিক দুর্নীতির ক্ষেত্রে অবান্তর।
সাম্প্রতিক সময়ে আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতির ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, আমলাদের দুর্নীতির জন্য সরকারকে দায়ী করা যাবে না। কিংবা এটি কোন রাজনৈতিক দলের দুর্নীতি নয়। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, সরকার পরিচালনায় যে দলই, যে সময়ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন; সব সময় প্রশাসনের দায় সরকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে ক্ষমতা আসে রাজনৈতিক দল। সেখানে সরকার জনগণের আস্থা হারালে তার দায়ভার প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ আমলারা নিবে না। আর এ কথাটা মাথায় রেখে প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে রাজনৈতিক সরকারকে। তা না হলে সরকারের উন্নয়নে ব্যত্যয় ঘটবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আওয়ামী সরকারের আমলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতাসহ নানা সুযোগ সুবিধা উচ্চ হারে বৃদ্ধি করার পরেও ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। আর তাই প্রশাসনের কোন স্তরে কিভাবে দুর্নীতি হচ্ছে তা খুঁজে সমাধান করতে হবে সরকারকে ।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রকল্পের নামে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বালিশকাণ্ডের পর স্বাস্থ্য অধিদফতর বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় ৭ কোটি টাকার বই কিনে। যেখানে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দামের বই ৮৫ হাজার ৫০০ টাকায় কেনা হয়েছে। এমন হরিলুট করেছে তারা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় । এখানেই ঘটনার শেষ নয়। ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ৩৭ লাখ টাকার পর্দা কিনেছে তাদের আইসিইউতে ব্যবহারের জন্য। সে সাথে হাসপাতালটি ১১ কোটি ৫৩ লাখ ৪৬৫ টাকার মেডিকেল যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনাকাটায় বিল দেখিয়েছে ৫২ কোটি ৬৬ লাখ ৭১ হাজার ২০০ টাকা।
এ কেবল দুর্নীতি নয়, মহা দুর্নীতি। আর এমন দুর্নীতি আমলাতন্ত্রের কোন পর্যায় থেকে হতে পারে তা অনুমান করার মত সচেতনতা এখন জনগণের আছে। সরকারি সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়, তারা জনগণের সেবক না হয়ে শোষক হয়ে জিম্মি করছে সরকার এবং জনগণকে। ওয়াসার পানি বিশুদ্ধ হয়নি কিন্তু প্রকল্পের ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা পাইপ কেনার নামে হাওয়া।
সাধারণত সরকারি কার্যক্রমে বিভিন্ন সংস্থা দরপত্রের মাধ্যমে দ্রব্যাদি ক্রয় করে থাকে। এ ক্ষেত্রে দরপত্র দাতা প্রতিষ্ঠান আর প্রশাসনের সমঝোতাতে যে অনিয়ম হচ্ছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ বালিশ, পর্দা, ওয়াসার পাইপ। অর্থাৎ ই-টেন্ডার পদ্ধতি কোনো সুফল আনতে পারেনি দুর্নীতিরোধে। যদিও টেন্ডার নিয়ে রাজনৈতিক হানাহানি হ্রাস পেয়েছে ই-টেন্ডারের মাধ্যমে কেবল।
আমলাদের পুকুর চুরির আরেক নিদর্শন হলো প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ সফর। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ‘পুকুর পুনঃখনন ও ভূ-উপরিস্থ পানি উন্নয়নের মাধ্যমে ক্ষুদ্র সেচে ব্যবহার’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের ১৬ জন কর্মকর্তা ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা ব্যয় করে পুকুর খননের প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশ সফর করেছেন। অন্যদিকে ৫ কোটি টাকা ব্যয় করে নিরাপদ পানি বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিতে উগান্ডা সফর করছে চট্রগ্রাম ওয়াসা ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ৪১ জন কর্মকর্তা। এ ধরনের ব্যয়বহুল সফরের যৌক্তিকতা কতটা আছে তা মানুষের বোধের বাইরে। এসব দুর্নীতিকে রাজনৈতিকভাবে তুলনামূলক আলোচনা করা দুর্নীতিবাজদের প্রশয় দেয়া। যা কোনভাবে হিতকর নয়।
দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালিত হয় বিশ্বব্যাংক, ইউএনডিপিসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহায়তায়৷ যার বেশির ভাগ স্বল্পহারে দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ। আর এ ঋণ সরকার পরিশোধ করে জনগণের ট্যাক্সসহ বিবিধ খাত থেকে। অন্যদিকে এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেবলমাত্র অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ঋণ দিয়ে থাকে। তারা ব্যবসা বাণিজ্য বা শিল্পখাতে ঋণ দেয় না। আর তাই অবকাঠামোগত খাতে প্রশাসনের দুর্নীতি আগামী দিনের জন্য নানাভাবে হতাশাজনক।
সুতরাং জনগণের ঘাড়ে ঋণের দায় চাপিয়ে প্রকল্পের নামে প্রশাসনিক নয়-ছয়কে অন্যভাবে ব্যাখ্যা দেবার অবকাশ নেই প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। সেই সাথে প্রশাসনের চেয়ারে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের বসিয়ে রেখে সরকারের পক্ষে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করা হবে দুষ্কর। তাই সরকারের প্রতি আনুগত্যের লেবাসধারী দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক সকল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে সরকারকে। কারণ জনগণের কাছে প্রশাসন সরকারের প্রতিচ্ছবি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)