দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উজ্জ্বল এক নক্ষত্র লুনা শামসুদ্দোহা অনেকটা আকস্মিকভাবেই চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। ‘দোহাটেক নিউমিডিয়া’ নামক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন। একজন সৃজনশীল সফটওয়্যার এন্টারপ্রেনার হিসেবে দেশে এবং বিদেশে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। শুধু এই নয়, দেশে বিভিন্ন খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে একীভূত করার কৃতিত্বও তাঁর। তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে আরও অনেক উচ্চতায় নেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন সবসময়। একই সাথে এই খাতের সাথে শুধু উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণী নয়, প্রান্তিক পর্যায়ের নারীদের সম্পৃক্ততা বাড়াতেও তিনি ছিলেন এক উদ্যোমী মানুষ।
তথ্যপ্রযুক্তিতে আমাদের নারীরা আসবে, তারা অবদান রাখবে এমনটি বোধ হয় একসময় কারো ভাবনাতেই ছিল না। কিন্তু সেই ভাবনার বৃত্ত ভেঙে লুনা শামসুদ্দোহা অনেক আগেই তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তা ও ব্যবসা করার কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। শুধু এই নয়, একধরনের পেশাদারিত্ব তৈরি করে নিজেদেরকে মর্যাদাপূর্ণ জায়গায় নিতেও সক্ষম হয়েছিলেন। আর তাই মেধা, নেতৃত্ব, দক্ষতা দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনন্য একজন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে অনেক আগেই তিনি আকস্মিক বিদায় নিলেন। গতকাল ১৭ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশে ই গভর্ননেন্স- তৈরির ক্ষেত্রে তাঁর হাতে গড়া ‘দোহাটেক’ বড় ভূমিকা পালন করেছে। মনে করিয়ে দিতে চাই, সর্বশেষ তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে তাঁর নেতৃত্বে ‘দোহাটেক নিউমিডিয়া’ ভোটার এনরোলমেন্ট সফটওয়ার তৈরি করে, যার ধারাবাহিকতায় সবার জন্যে ন্যাশনাল আইডি কার্ড তৈরির বিশাল কর্মযজ্ঞ এ দেশে সম্ভব হয়। ইলেকট্রিক গভর্নমেন্ট প্রক্রিওরমেন্ট বা ইজিপিতেও ‘দোহাটেক’-এর অবদান অসামান্য। বাংলাদেশ সরকারের এমপ্লয়মেন্ট জেনারেশন ফর দ্য পুওররেস্ট (ইজিপিপি) প্রকল্পের এমআইএস সিস্টেমও ‘দোহাটেক’-এর অবদান। এসব কাজের নেতৃত্বেই থেকেছেন একজন লুনা সামসুদ্দোহা। সম্মুখ সারিতে থেকে তিনিই সবসময় নেতৃত্ব দিয়েছন।
নব্বই দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে লেখাপড়া জীবনের পাঠ চুকিয়ে একসময় ব্রিটিশ কাউন্সিলে টিচিং শুরু করেছিলেন লুনা সামসুদ্দোহা। কিন্তু পরবর্তীকালে মনোযোগী হোন তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। এই সেক্টর ঘিরেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। দ্রুত সফলও হন। নিজ কাজের ধারাবাহিকতায় দেশে বিদেশে তথ্য প্রযুক্তি সেক্টরের অনেক প্রতিষ্ঠান ও ফোরামের সাথেও যুক্ত হন। নিজ কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে তাই বিভিন্ন সময় শুধু দেশে নয় আন্তর্জাতিকভাবেও সম্মানিত এবং পুরস্কৃত হন। প্রযুক্তি খাতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ ভূমিকা রাখায় ভারত থেকে উইমেন লিডারশীপ এচিভমেন্ট এওয়ার্ড, সুইডেন থেকে গ্লোবাল উইমেন ইনভেন্টরস অ্যান্ড ইনভেন্টরস নেটওয়ার্ক (গুইন) সম্মাননাসহ আর অনেক পুরস্কার লাভ করেন তিনি। পাক্ষিক অনন্যা এবং ক্যানভাস পত্রিকা কর্তৃক পুরস্কুত হন।
একসময় নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি নানান ধরনের সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সাথেও যুক্ত হন। বাংলাদেশ উইমেন ইন টেকনোলজি’র প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের নির্বাহী সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও এসএমই ফাউন্ডেশনের অন্যতম পরিচালক, অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন একসময়। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ও ইউসেপ বাংলাদেশ-এর অন্যতম ট্রাস্টি ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রয়ত্ব জনতা ব্যাংক-এর চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
নব্বই দশকের প্রারম্ভে লুনা শামসুদ্দোহা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নেমেছিলেন প্রায় শুন্য হাতে। ১৯৯২ সালে ঢাকার পল্টন লেনে মাত্র দু’জন কর্মী নিয়ে তিনি ‘দোহাটেক’-এর যাত্রা শুরু করেছিলেন। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে একশতেরও বেশি শুধু মেধাবি কম্পিউটর ইঞ্জিনিয়ার কাজ করছেন। বুয়েট থেকে লেখাপড়া শেষ করে অনেক মেয়েই কাজ করেন তাঁর প্রতিষ্ঠানে। শুরুতে কন্টেন্ট ম্যানেজমেন্টে’র কাজ শুরু করতো ‘দোহাটেক’। একসময় ডাব্লিউএইচও, ওয়ার্ল্ডব্যাংকের হয়ে এই কাজটি করতেন তারা। আস্তে আস্তে আমেরিকা, কানাডা, জার্মান, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশে তাদের কাজ ছড়িয়ে পড়ে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অন্যতম উদ্যোক্তা লুনা সামসুদ্দোহা সবসময় মনে করতেন, তথ্যপ্রযুক্তির দিক দিয়ে এ দেশের প্রতিটি মেয়ে এগিয়ে যাবে। সবাইকে উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হতে হবে তা নয়, তবে টেকনোলজির টুলসগুলো অবশ্যই জানতে হবে। লুনা সামসুদ্দোহা বলতেন, তথ্যপ্রযুক্তি এ দেশের মেয়েদের জন্যে খুবই ভালো একটি সেক্টর। এই সেক্টরে মেয়েদের সম্পৃক্ততা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। বলতেন, গ্রামীণ মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের যেসব মেয়েরা খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি তাঁদেরকে সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা হলে নির্দ্বিধায় এই সেক্টরে তারা বড় ধরনের অবদান রাখতে সক্ষম হবে। ঘরে বসেই তারা ডাটা এন্ট্রিসহ নানান ধরনের কাজ করে কর্মসংস্থান করতে পারবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে মেয়েদের অবদানকে তিনি সবসময় অন্যভাবে মূল্যায়ন করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন- বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির দিক দিয়ে যতোটা এগিয়েছে সেখানে মেয়েদের বড় ধরনের অবদান রয়েছে। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে রূপান্তরিত করতেও মেয়েদের শ্রমশক্তি বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে বলে তিনি মনে করতেন। তিনি আরও মনে করতেন, নারীর ক্ষমতায়নের বড় একটি টুলস তথ্যপ্রযুক্তি খাত। এখান থেকে কোনোভাবেই পিছিয়ে পড়া চলবে না। টেকনোলজির দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলতেন, ‘সুযোটা আমাদের নিতেই হবে। যদি আউট সোর্সিং প্রক্রিয়ায় আমাদের ফ্রিল্যান্সাররা ঘরে বসে নরওয়ে বা জাপানের কারো কাজ করে দিতে পারে তাহলে বরগুনায় বসে কোনো মেয়ে ঢাকার কারো কাজ কেন করতে পারবে না।
লুনা শামসুদ্দোহা ছিলেন একজন স্বাপ্নিক মানুষ। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন। স্বপ্ন দেখতেন বাংলাদেশ প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে কেবলই এগিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তি খাতে নারীদের সম্পৃক্ততা কেবলই বাড়ছে। নিজের পথচলার কথা স্মরণে এনে প্রায়ই বলতেন, প্রতিটি কাজেই ঝুঁকি এবং চ্যালেঞ্জ আছে। এগুলো থাকবেই। কাজের প্রতি তিনি এতোটাই অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন যে, দিন এবং রাতকে আলাদা করে দেখতেন না। সারাদিনই কাজের মাঝে ডুবে থাকতে ভালবাসতেন। অসম্ভব বিনয়ী মানুষ লুনা শামসুদ্দোহা মনে করতেন, মানুষের শেখার শেষ নেই। তিনিও তাই প্রতিদিনই শিখেছেন। শেখাটাই তার কাছে এক বড় আনন্দ। আড়ালে আবডালে থেকে কাজ করতে ভালবাসতেন। অনেকটাই প্রচার বিমুখ ছিলেন।
সন্দেহ নেই লুনা শামসুদ্দোহার অকাল মৃত্যুতে দেশ এক কৃতি নারীকে হারালো। যিনি ভালবাসতেন দেশ ও দেশের মানুষকে। যিনি তথ্যপ্রযুক্তি খাত দিয়েই বাংলাদেশকে আরও গৌরাবান্বিত করতে চেয়েছিলেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)