‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে রেকর্ড ঘাটতির বাজেট প্রস্তাব পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেন তিনি। বিশাল এই বাজেট দেশের মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৬৪ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা বেশি।
বহুল প্রত্যাশিত এই বাজেটে আশানুরূপ তেমন বরাদ্দ নেই প্রবাসীদের জন্য। যদিও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের বিষয়ে প্রশংসা করেছেন অর্থমন্ত্রী। বলা হচ্ছে, করোনার মধ্যে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দাজনিত কারণে রপ্তানি আয় যখন নিম্নমুখি, তখন প্রবাসীদের আয় স্বস্তি দিয়েছে সরকারকে। হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রবাসী আয় এসেছে ২২ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার। যেখানে প্রবৃদ্ধি ৪০ দশমিক ১ শতাংশ। আগামী অর্থবছরেও তাই এ খাতে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। অথচ গুঞ্জন ছিল, চলমান এই দুই শতাংশ রেমিট্যান্স প্রণোদনা বাড়িয়ে চার শতাংশ করার প্রস্তাব আসবে। সেই হিসেবে আশায় বুক বাঁধছিলেন দেশের বাইরে থাকা প্রায় ১ কোটি ৪৮ লাখ প্রবাসী। ৩ জুনের অপেক্ষায় সময় গুণছিলেন তারা। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি! যদিও এখনও বিষয়টি ভেবে দেখার সুযোগ রয়েছে।
করোনার এই মহামারিতেও প্রতি মাসে বেড়েছে রেমিট্যান্স। অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচিত রেমিট্যান্স যোদ্ধারা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে সচল রেখেছেন অর্থনীতির চাকা। এই ধারা অব্যাহত রাখতে এবং রেমিট্যান্সের গতি আরও বাড়াতে বাজেটে প্রবাসীদের সুযোগ সুবিধা দিয়ে বরাদ্দ রাখাও যৌক্তিক ছিল। কারণ, প্রবাসীদের শ্রম ও সেবার বিপরীতে চাহিদা অত্যন্ত সীমিত। তাই, দেশের বাইরে থাকা বৃহৎ এই জনগোষ্ঠী স্বার্থে রেমিট্যান্স প্রণোদনা ৪ শতাংশ করার জোর দাবি থাকলো।
প্রবাসীরা কিছু মৌলিক দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কথা বলে আসছেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রবাস ফেরত কর্মীদের সরকারি পেনশন চালু ও প্রবাসে থাকা কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বীমার প্রকল্প। এই দুটি দাবি যৌক্তিক ও প্রবাসীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা অধিকাংশ প্রবাসী কর্মী জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেন প্রবাসে। কেউ কেউ ২০ থেকে ২৫ বছরেরও অধিক সময় প্রবাসে থেকে রেমিট্যান্স পাঠান। আবার ষাটোর্ধ্ব কর্মীরাও ফিরে আসেন একেবারে শূন্য হাতে। যতদিন তারা প্রবাসে থাকেন ততদিন কোনোরূপ বাড়তি চাহিদার আরজি করেন না এই প্রবাসীরা। কিন্তু শেষ সময়ে যখন তারা দেশে ফিরে যান তখন তাদের করার মতো আর কিছুই থাকে না। পেনশন সুবিধার আওতায় এলে এ সকল প্রবাসীরা শেষ সময়ে অন্তত বেঁচে থাকার ভরসা পাবেন। বিশেষ করে মৌলিক চাহিদা মেটাতে এই পেনশন সুবিধা তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করবে। তাই প্রবাস ফেরত কর্মীদের ক্ষেত্রে নূন্যতম বরাদ্দে পেনশন সুবিধা চালুর বিষয়টি বিবেচনায় আনার দাবি রইল। আবার দেশের বাইরে থাকা অধিকাংশ প্রবাসীই স্বল্প আয়ের শ্রমিক। আয়ের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যে চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শ্রমিকদের মৌলিক বীমাগুলো শুধু জরুরি চিকিৎসা সেবার আওতায় থাকে। এজন্য অনেকেই শরীরের রোগ পুষে রেখে চিকিৎসার উদ্দেশে দেশে পাড়ি দেন। কিন্তু দেশেও বর্তমান চিকিৎসা ব্যয় সামাল দেওয়া অনেকের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। প্রবাসীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যদি একটি স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ রাখা যায় তাহলে স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি মৃত্যু ঝুঁকিও করবে প্রবাসীদের।
এছাড়া প্রবাসে চাকরিচ্যুত কর্মী ও আহত কর্মীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ আনা প্রয়োজন। কারণ প্রতিবছর অসংখ্য প্রবাসী কর্মী এমন সমস্যায় পড়েন। বিশেষ করে দেশের বাইরে আইনি লড়াই করা ব্যয়বহুল ব্যাপার। যে কারণে আর্থিক বিষয়টি চিন্তা করে নিজেরা হার মনের মাথা নিচু করে দেশে ফিরে আসেন ভুক্তভোগী প্রবাসীরা। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে, প্রতিবছর যে ক’টি মামলার নিষ্পত্তি হয় সেগুলোতেও কয়েক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ পান প্রবাসী। যেই অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবেই যোগ হয় সরকারের খাতায়। দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশ মিশনগুলোতে খোঁজ খবর করলে এর একটি সঠিক অঙ্ক কষা সম্ভব। ক্ষতিপূরণ আদায় ও প্রবাসী কর্মীদের দুঃসময়ে পাশে থাকার নিমিত্তে তাই আইনি সহায়তার বিষয়টি বিবেচনায় রাখারও দাবি করছি।
এর বাইরেও প্রবাসীদের আরও কিছু দাবি কালক্রমে সামনে এসেছে। এগুলো হলো- স্বল্প আয়ের প্রবাসীদের জন্য বিশেষ সঞ্চয় প্রকল্প চালু, প্রবাসীর সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য শিক্ষাবৃত্তির পাশাপাশি বিভিন্ন শহরে স্বল্প ব্যয়ের ছাত্রাবাস নির্মাণ, চলমান আয়কর আইন সংশোধন করে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর পরিবারের সদস্যদের আয়কর ও প্রবাসীদের অবসরকালীন সঞ্চয়ের ওপর আয়কর মওফুক, দেশের বাইরে কর্মীদের শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, কমিউনিটির উন্নয়নে মিশন কেন্দ্রিক অডিটরিয়াম ও লাইব্রেরি নির্মাণের দাবি। এসব দাবি পূরণে বাজেটে যথাযথ বরাদ্দ আশা করেন প্রবাসীরা।
পরিশেষে বলব, রেমিট্যান্সের উপর চলমান দুই শতাংশ প্রণোদনা থাকায় করোনার সময়েও ক্রমাগতভাবে রেমিট্যান্স বেড়েছে। বিষয়টি যেমন সরকারের নজরে রয়েছে তেমনই আমার বিশ্বাম উপরোক্ত দাবিগুলোর দিকে সরকার বিশেষ নজর দিলে চলমান এই ধারাকেও টপকে যেতে পারে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)