গলায় বেগুনি রঙের পাথরের মালা, হাতে হীরার ব্রেসলেট। পশমী কাপড়ের গাউন পড়া কোনো এক অলস সন্ধ্যায় সোফায় হেলান দিয়ে আধো-শোয়া এই রমনীকে দেখে প্রথমেই মাথায় আসবে তিনি কোনো ধন-কুবেরের স্ত্রী। কিন্তু তার পিছনে থাকা দু’টি পোট্রেট আবার অন্য কছু নির্দেশ করছে সবাইকে। একটি পোট্রেট হচ্ছে মা ও মেয়ের।
আরেকটি পোট্রেটে দেখা যাচ্ছে সুন্দরী ওই রমনী বসে মালা গাঁথছেন। তার পিছনে বিভিন্ন ধরণের আসবাবপত্র চমৎকার করে গুছানো। সেগুলো কোনো সাধারণ আসবাবপত্র নয়। তার দু’টি পোট্রেট ও ঘরের সাজসজ্জা আসলে তুলে ধরছে কীভাবে একজন ব্যবসায়ী নারী তার সফলতার পথ তৈরি করেছে। তিনি আর কেউ নন, ইউকের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের শাশুড়ী, অ্যানাবেল অ্যাস্টোর।
বিশ্ব বিখ্যাত ফার্নিচার কোম্পানি ‘ওকেএ’ সহ প্রতিষ্ঠাতা অ্যানাবেল ১৯ বছর বয়সে নাইটব্রিজে প্রথম হীরার ব্যবসা শুরু করেন। সেই থেকে ৬৭ বছর বয়সী অ্যানাবেলের সংগ্রামের জীবন শুরু হয়েছে। খুব মসৃন ছিলো না তার রাস্তা।
অ্যানাবেল বলেন, একদম নিচ থেকে ওপরে ওঠেছেন তিনি। ফার্নিচারের কোম্পানিটিকে শীর্ষে পৌঁছানোর জন্য কষ্ট করে অনেক টাকা জোগাড় করতে হয় তাকে। ব্যবসার প্রথম দিকে তার ওই ব্যবসায় অর্থাৎ এক পিস ফার্নিচার কেনার বিষয়ে কেউ কোনো আগ্রহ দেখাতো না।
ভেনেটি ফেয়ার ম্যাগাজিনে নিজের জীবন ও লাইফস্টাইল নিয়ে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় অ্যানাবেল মৃদু হেসে বলেন, যখনই আমি কাউকে আমার ব্যবসার পরিকল্পনার কথা বলেছি, সেই আমাকে বলেছে, সে এজন্য মোটেও আগ্রহী নয়। কখনো কখনো ব্যবসায়ীদের অফিসের বাইরে দেখা করার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তখন আমার চোখের পানির দিকে কেউ ফিরেও তাকাতো না।
‘তবে আমি মনে মনে বলতাম, এসব কিছুই আমাকে দমাতে পারবে না, আমি হাল ছাড়বো না, পিছিয়ে পড়বো না।’
অতীতের কথা স্মরণ করে দৃঢ় কণ্ঠে অ্যানাবেল বলেন, আমি রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে অর্থ উপার্জন করেছি। আমার ফার্নিচারের কোম্পানিকে অন্যতম শীর্ষ কোম্পানিতে পরিণত করেছি। প্রমাণ করে দিয়েছি, তারা সবাই ভুল ছিলো, আমি ঠিক ছিলাম।
‘ওকেএ’ কোম্পানির পিছনে ১৫ বছর পরিশ্রম করেছেন অ্যানাবেল। কোম্পানির গত মাসের রির্পোট অনুযায়ী, ২০১৪ সালে লাভের পরিমাণ ১.৭ পাউন্ড থেকে ৬ শতাংশ বেড়ে ২১.১ পাউন্ড হয়েছে।
তার কোম্পানির হীরা কিনতে ফিলিপািইনের তৎকালীন প্রেসিডেন্টের স্ত্রী ইমেলডা মারকোসসহ ইরাক-ইরানের অনেক মহারাণীরা আসতেন। পরে তার হীরা লেডি ডায়নার কাছেও অনেক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাদের কাছ থেকে ধীরে ধীরে সবার কাছে অনেক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অ্যানাবেলের ডিজাইন করা হীরা।
৫ সন্তানের মা ও ১০ জনের নানী-দাদী অ্যানাবেলের এখন নিজেরই আছে ৪টি বাড়ি ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোম্পানিটির ১২টি শোরুম। ধারণা করা হচ্ছে আগামী বছর ইউএস’তেও আরেকটি শোরুম খুলবেন অ্যানাবেল।
বিলাসী জীবন-যাপনে অভ্যস্থ অ্যানাবেলের ব্যক্তিগত জীবনও খুব একটা সুখকর ছিলো না। ১৯৬৯ সালে ল্যাঙ্কাশরের ভূপতি স্যার রেজিন্যাল্ড সেফেল্ড এর নাতি রেজি সেফেল্ড এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের দুই বছরের মধ্যে ডেভিড ক্যামেরনের স্ত্রী সামান্তা ক্যামেরনের জন্ম হয়।
রক্ষণশীল পরিবারের বউ হওয়ায় বাইরে কাজ করার অনুমতি পাননি অ্যানাবেল। তবুও তিনি থেমে থাকেন নি। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর অ্যানাবেলের দ্বিতীয় মেয়ের জন্মের পর বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে ১৯৭৪ সালে। আর এই বিচ্ছেদের জন্য তাকেই দোষী করেন অ্যানাবেলের নিজের বাবা-মা-পরিবার। তারা অভিযোগ করেছিলো ‘তোমার সবচেয়ে বড় অন্যায় ছিলো তোমার স্বামী রেজি যখন বাসায় ফিরতো তখন তুমি রেডওয়াইনের গ্লাস নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে না।’
অ্যাস্টোর জানান, এই ধরণের কথাও তার বাবাকে তাকে বলেছেন। কম কটু কথা শোনায়নি তার মা। আমার মা আমাকে বলতেন, আমি কখনো আদর্শ মা হতে পারবো না।
বিচ্ছেদের পর অ্যানাবেল ৬ সপ্তাহের জন্য নিউইয়র্কে চলে যান। ফিরে এসে তার সঙ্গে পরিচয় হয় উইলিয়াম অ্যাস্টোরের। অ্যানাবেলের বাবা তাদের নিয়ে পরিবারে অনেক কুৎসা ছড়ালেও ১৯৭৬ সালে তারা বিয়ে করেন এবং এই বছরের জানুয়ারিতে অ্যাস্টোর দম্পতি বিয়ের ৪০ বছর উদযাপন করেন। প্রাক্তন স্বামী রেজি’র মতো অ্যানাবেলের কাজ করায় কোনো বাধা দেন নি উইলিয়াম। তাদের ঘরে ৩ টি সন্তান জন্ম নেয়।
অ্যানাবেল বলেন, উইলিয়াম আমার আগের ঘরের দুই মেয়ে সামান্তা ও এমিলিকেও অনেক আদর করতো। বাবার আদর স্নেহ দিয়েই ওদের বড় করেছে। ঘোড়া চালানো শিখিয়েছে।
মেয়ে জামাই ডেভিড ক্যামেরনকে নিয়ে অ্যানাবেল বলেন, আমি ক্যামেরনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয় বরং আমার পরিবারের সদস্য হিসেবেই দেখি।