বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সংলাপ প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘খুনিদের সঙ্গে সংলাপে বসার কোনো ইচ্ছা তার নেই’ বললেও সংলাপ সম্ভাবনা যে একেবারে নাকচ করে দিয়েছেন এমন কিন্তু নয়। দেশের মানুষ এখন জানতে চাইবে, সংলাপে বসার জন্য খালেদা জিয়াকে ‘যোগ্যতা অর্জনে’ শেখ হাসিনা যে পাল্টা প্রস্তাব দিয়েছেন সে বিষয়ে বেগম জিয়া কী প্রতিক্রিয়া জানান।
নেদারল্যান্ডসে সরকারি সফর শেষে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে বেগম খালেদা জিয়ার ‘সংলাপ প্রস্তাব’ যে অন্যতম আলোচিত বিষয় হবে সেটা আগে থেকেই আঁচ করা গিয়েছিলো। সংবাদ সম্মেলন যখন শুরু হলো তখন টেলিভিশনের পর্দায় মানুষ অপেক্ষায় ছিলেন কখন প্রসঙ্গটি আসে এবং এ ব্যাপারে কী অবস্থান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যখন প্রশ্নটি উত্থাপিত হলো এবং প্রধানমন্ত্রী যে ‘শর্তে’র কথা বলে উত্তর দিলেন তাতে ‘মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের দল’ হিসেবে বিএনপির হতাশ হওয়ার কিছু ঘটেনি।
কেনো হতাশ হওয়া উচিত নয় সেই বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে আরেকবার দেখে নেওয়া যাক যে জিয়ার পারিবারিক এবং রাজনৈতিক উত্তরসূরী হিসেবে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার প্রস্তাবটা আসলে কী? লন্ডন থেকে বেগম জিয়া যে বিবৃতি দিয়েছেন তাতে তিনি আশা প্রকাশ করেন: “সরকার শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে দেশের এই ক্রান্তিকাল ও সঙ্কটজনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে গণতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রকে সংকোচন না করে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব থেকে সরে এসে একটি জাতীয় সংলাপের সূচনার পরিবেশকে উন্মুক্ত করবে।”
জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন:
১. বাংলাদেশ এতো দৈন্য দশায় পড়েনি যে যারা মানুষ পুড়িয়ে মারে তাদের সঙ্গে সংলাপে বসতে হবে। (নির্বাচনের আগে-পরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রসঙ্গে)
২. আমি তাকে ফোন করেছিলাম। তখন কী ধরনের কথা শুনতে হয়েছে। ফোন করে আমার ঝাড়ি খেতে হয়েছে। (নির্বাচনের আগে ফোন প্রসঙ্গে)
৩. আপনি যদি কারও বাড়িতে যান, আর আপনার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়, আপনি কি তার সঙ্গে আলোচনায় বসবেন? (আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রীর গুলশান যাওয়া প্রসঙ্গে)
এই তিনটি পর্যবেক্ষণ শুনলে স্পষ্টত:ই মনে হবে খালেদা জিয়ার সংলাপ প্রস্তাব পুরোপুরি নাকচ হয়ে গেছে। সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এ-ও বলেছেন:
১. জাতীয় সংলাপের জন্যই খালেদা জিয়া মানুষ হত্যা করে পরিস্থিতির সৃষ্টি করছেন।
২. যার হাতে মানুষ পোড়ে, তার সাথে সংলাপের ইচ্ছা আমার নাই।
৩. দয়া করে আমাকে ওই খুনি মানুষের সাথে বসতে অনুরোধ করবেন না। কারণ বসলেই পোড়া গন্ধ পাব।
৪. আগুন দিয়ে মানুষ হত্যার পরও তারা যেহেতু কিছু করতে পারছে না, তাই একটি গ্রুপ নেমেছে গুপ্ত হত্যায়।
এভাবে সংলাপ সম্ভাবনার কথা নাকচ করলেও সংলাপে বসতে ‘যোগ্যতা’ অর্জনে খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী কিছু ‘ইঙ্গিত’ বা ‘শর্ত’ দিয়েছেন। এর মধ্যে আছে:
১. খালেদা জিয়াকে মানুষ পোড়ানোর রাস্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
২. বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে হবে।
৩.বেগম জিয়াকে প্রকাশ্যে জানাতে হবে যে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচারকে সমর্থন করেন।
একটু বিস্তৃত করলে, খালেদা জিয়া সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টিতে যে আহবান জানিয়েছেন তার প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাসিনার বক্তব্যটা এরকম:
১. উনি বলুক যে উনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে সমর্থন করেন। উনি বলুক যে যুদ্ধাপরাধের যে বিচার হচ্ছে, তা সঠিক হচ্ছে।
২. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া যে উচিৎ তা যখন স্বীকার করবেন, তখনই তিনি সংলাপে বসার যোগ্যতা অর্জন করবেন।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিশ্লেষণ করে সহজ করে বললে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে যে কোনো পর্যায়ে একটি সংলাপ বা সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য:
১. বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া ছাড়তে হবে।
২. বিএনপিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে সমর্থন করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী যে এরকম শর্ত দিয়েছেন তার কারণ বোঝা খুব কষ্টকর কিছু নয়:
১. মূলতঃ ২০০৯ সাল থেকে (আসলে আরো আগে থেকেই) বাংলাদেশে রাজনীতির বড় ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়িয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।
২. ওই বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে বিএনপির যেখানে উচিত ছিলো জামায়াতি সঙ্গ ত্যাগ করা সেখানে সে জামায়াতের খুশবুতে আরো বেশি মশগুল হয়ে নিজেদের মধ্যে মুখচুম্বনটাকে প্রগাঢ় করেছে।
৩. যুদ্ধাপরাধীদের বুকে টেনে নিতে গিয়ে নিজেদের আন্দোলনটাকে জামায়াতের নাশকতার মধ্যে বিলীন করেছে বিএনপি। বিএনপির আন্দোলন কখনোই ভিন্ন কোনো চরিত্র নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি। নিজেরাও সেটা প্রমাণ করতে পারেনি।
৪. এখন যে নাশকতা চলছে– ব্লগার থেকে বিদেশী হত্যা, ধর্মীয় নেতা থেকে প্রকাশক হত্যা, কিংবা পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের হত্যা– এ সবই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এবং এখনও তাকে কেন্দ্র করেই চলছে।
বিএনপিকে এটা থেকে বের হয়ে আসতে প্রধানমন্ত্রীর যে প্রস্তাব সেটার বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা বোঝার আগে দেখা যাক বিএনপি কেনো এতো জামায়াত-নির্ভর! বিএনপি যে সবসময় জামায়াতে ভর করে ছিলো তার কারণ তিনটি:
১. আদর্শিকভাবেই বিএনপি জামায়াতের মাতুলগোত্রীয় ‘কাজিন’ যেমন পিতৃকূলে জামায়াতের ‘কাজিন’ হেফাজত, আনসারুল্লাহ কিংবা আইএস বা আল কায়েদা।
২. সরকারের দমনমূলক অবস্থান মোকাবেলা করে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার মতো বিএনপির সাংগঠনিক শক্তিহীনতার বিপরীতে ক্যাডারভিত্তিক দল হওয়ার কারণে জামায়াতের সাংগঠনিক অবস্থান।
৩. বিএনপির আশা ছিলো যে নিজ দলের নেতাদের বিচার বন্ধ করতে জামায়াত-শিবির এমন নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারবে যার মাধ্যমে সরকার টিকতে পারবে না।
জামায়াতের উপর নির্ভর করে শেষ পর্যন্ত বিএনপির যে কোনো লাভ হয়নি সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এখন সে যতো দ্রুত জামায়াতকে ছেড়ে আসতে পারবে ততোই তার জন্য মঙ্গল। না হয় জামায়াতের মাতুলগোত্রীয় কাজিন বিএনপি! কিন্তু, নষ্ট সন্তানকেওতো পিতা-মাতা ত্যাজ্য করতে পারেন। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য বিএনপি এখন যদি জামায়াতকে ত্যাজ্য করে তাহলে আখেরে তারই লাভ হবে।
প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব বা শর্ত অনুসারে জামায়াত ত্যাজ্যতার রাজনীতিতে গেলে সাময়িকভাবে হয়তো মনে হতে পারে তাদের পরাজয় হলো। কিন্তু পরাজয়তো বিএনপির এমনিতেও কম হয়নি। পরাজয়ের বৃত্ত ভাঙার জন্যই তার নতুন এ পরাজয়কে স্বাগত জানানো উচিত। ভিন্নভাবে বরং প্রধানমন্ত্রী বিএনপিকে একটি ‘এক্সিট পয়েন্ট’ দিয়েছেন। এর সর্বোচ্চ ব্যবহারের সুযোগ এখন খালেদা জিয়ার সামনে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)