রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় আহতদের উদ্ধারের চেষ্টায় ঘটনাস্থলে অনেকগুলো অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হলেও উৎসুক জনতার ভিড়ে ভেতরে ঢুকতে বেশ বেগ হতে হয়।
ঘটনাস্থল থেকে সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে উদ্ধার চেষ্টায় সহযোগিতা করতে স্থানীয় লোকজনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিসসহ উদ্ধারকারী দল।
এর আগেও পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সময় উৎসুক জনতার ভিড়ে উদ্ধার কাজে ব্যঘাত ঘটে। এই ধরণের অবস্থায় সাধারণ জনগণ কাজের সহায়তা না করে বরং উদ্ধারকাজে বিঘ্ন ঘটানোর সমালোচনা করে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরণের অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
মাইনউদ্দিন রিয়াদ নামের একজন ফেসবুকে লিখেন: ‘নির্বোধের মতো শুধু পানি দিয়ে আগুন নিভানোই ফায়ার সার্ভিসের কাজ না!
জীবন বাঁচাতে ভবন থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে আহত হচ্ছে মর্মান্তিক ভাবে। তাদের উচিত ছিলো নিচে সেফটি নেটের ব্যবস্থা করা অন্তত মানুষগুলো যেনো আহত না হয়, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচে!
অমানবিক ভাবে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় দাড়িয়ে দৃশ্য দেখছে আর কাজের বিঘ্নতা ঘটাচ্ছে, কমন সেন্স বিলুপ্ত প্রায়! আল্লাহ সবাইকে হেফাজত করুন, আপনি দয়াশীল।’
রাহাত মুস্তাফিজ তার ফেসবুকে উৎসুক জনতার ছবি পোস্ট করে লিখেন:
‘হাজার হাজার উৎসুক জনতা হা করে তাকিয়ে দেখছে, ছবি তুলছে। যেনো এক উৎসবমুখর পরিস্থিতি! রাস্তা ব্লক করে দেখার কিংবা ছবি তোলার সময় এটা নয়, এইবোধটুকু আজও হলো না আমাদের।
ঠিক এরকম দৃশ্য তাজমহল দেখতে গিয়েও দেখেছি। তা মমতাজের ওই কবরটি দেখার জিনিস বটে। এবং ওই দেখাকে স্মৃতি হিসেবে তুলে রাখতেও দোষ নেই।
কিন্তু আগুন ও ধোঁয়ার সাথে যুদ্ধরত, মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখতে পাওয়া মানুষের বাঁচার শেষ চেষ্টায় আপনার আমার দাঁড়িয়ে থাকা কেবল তামাশা উৎপাদন করে না, বরং ওই মানুষগুলোকে রক্ষা করতে যাওয়া প্রশিক্ষিত বাহিনীর কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
সমস্যাটা আসলে বোধের। বোধের এই সঙ্কট দক্ষিণ এশিয়ার মানুষেরই সম্ভবত। কখন জমায়েত হতে হয়, কখন অন্যকে জমায়েত হওয়ার সুযোগ করে দিতে হয় এই সিভিক সেন্স নেই কারও।
সাংবাদিক রোফিকুল্লাহ রমেল তার ফেসবুক পোস্টে লিখেন: শেষ পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ২০ টি পর্যন্ত ইউনিট যেতে পেরেছে। প্রথম সাত আটটি ছাড়া কেউ সিদা রাস্তায় এক টানে যেতে পারেনি। গুলশান থেকে বনানী পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ। এখন পুলিশকেও নামতে হয়েছে মানুষ সরাতে। যেখান থেকে মোবাইল দিয়ে ফটো তুলবার মত আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, এমনকি সেইখানেও শ শ মানুষ। ভিতরে আটকে পড়েছেন, ফোন বন্ধ – এমন মানুষের আত্মীয় ও এখন আর ভিড় ঠেলে যেতে পারছে না……..
ঢাকায় যথেষ্ট বিনোদনের ব্যবস্থা নেই তো। তাই বিশ্বজিৎ কে কোপানো থেকে শুরু করে আগুনে দম বন্ধ হয়ে লাফ দিয়ে পড়া মানুষ – সবই আমাদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে বেশ লাগে।
শ্রাবণ প্রকাশনীর প্রকাশক রবিন আহসান তার স্ট্যাটানে লিখেন: ‘মানুষ রোবট হয়ে যাচ্ছে, মানুষ বাঁচানর চেয়ে তাদের কাজ, হোচ্ছে আগুনের ধোয়া প্রচার! আগে এরকম মানুষ ছিলনা’।
আরেকজন ফেসবুক ব্যবহারকারী রোমা মোদক তার পোস্টে লিখেন: ‘হাতের মোবাইলে ভিডিও করার চেয়ে বন্দী মানুষগুলোর জীবনের মূল্য অনেক বেশি।
হে মানব সন্তানগণ মানুষকে বাঁচতে দিন। সরে দাঁড়ান’
হেলাল উদ্দিন আহমেদ লিখেন: আপনি কথায় কথায় বলেন এদেশের পুলিশ কেনো সিংগাপুর বা উন্নত দেশের মত নয়; নাক সিটকে বলেন এদেশের ডাক্তাররা সিংগাপুর / থাইল্যান্ড এর চাইতে কত নিকৃষ্ট; এদেশের ফায়ার ফাইটারদের দক্ষতার সাথে অস্ট্রেলিয়ার ফায়ার ফাইটারদের তুলনা করে আমাদের দমকল বাহিনীর চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেন
ভাই এবং বোনেরা, আপনি নিজে কি সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের মত সভ্য হয়েছেন? আগে নিজে সভ্য হন, এরপর সেবাদাতাদের সমালোচনা করেন।’
তবে আবার অনেকে আবার উৎসুক জনতার উপস্থিতিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেছেন। আরিফ জেবতিক তার ফেসবুক পোস্টে লিখেন, ‘উৎসুক জনতার জন্য আগুন বিস্তৃত হয়েছে এমন না, হয়েছে ক্যাপাসিটির অভাবে। ফায়ারবৃগেড পানি মারে ৩ তলায় তো আগুন আসলে জ্বলছিল সপ্তম তলায় । একটা মইওয়ালা গাড়ি আসতে এক ঘন্টা লেগেছে ! উৎসুক জনতা ঠিকই রাস্তা ক্লিয়ার রেখেছে, এই ছবি তার প্রমান । এটা শুরুর দিকের ছবি, আমার তোলা ।ছাত্রদের করা লাইন ।উৎসুক জনতার জন্য গাড়ি ঢুকতে সমস্যা হয়েছে বলে মনে হয়নি ।’
মাসকাওয়াথ আহসান লিখেছেন: ‘মানুষ প্রবল আগ্রহ নিয়ে অগ্নিকাণ্ড দেখে; মৃত্যুর আহাজারি দেখে; কারণ সে জানে ভঙ্গুর নগর-ব্যবস্থাপনা আর অতিদ্রুত ধনী হবার এই গেম অফ থ্রোণস-এ দিনবদলের বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই; এমনিতর কোন আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ছাড়া; তার সামনে আর কোন বিকল্প নেই।
নিজের আসন্ন মৃত্যুকে সহজভাবে নিতে শিখতেই যে কোন দুর্ঘটনা-স্থলে ভিড় করে তারা। সাধারণ মানুষ এ-ও জানে,এইসব অব্যবস্থা সৃষ্ট দুর্ঘটনার দায় অসভ্য-অব্যবস্থাপক ও তাদের স্তাবকেরা কেউ নেবেনা; বরং সাধারণ মানুষকে অসভ্য বলে গালি দেবে অন্ধ-অক্ষম ক্ষমতার নেকড়েরা।’
এফ আর টাওয়ার থেকে আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ইতোমধ্যে প্রায় ৩০টি অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিট। শেষ খবর পর্যন্ত উদ্ধারকাজে যোগ দিয়েছে বিমান বাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার এবং নৌবাহিনীর রেসকিউ টিম।