চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

প্রতিবাদের আরেক নাম রজনী

রজনী স্কুলে যেতে পছন্দ করে। বয়সে ছোট হলেও সে বড় বড় স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে। ভারতের আর দশটা মেয়ে যেভাবে জীবন পার করে; সেও ঠিক সেভাবে তার জীবনকে চালাতে চায় না।

রজনীর বয়স যখন মাত্র ১৪ বছর, তখন তার মা বিয়ের কথা বলে। কিন্তু এক কথায়, সে ওই প্রস্তাবকে না বলে দেয়। স্কুল চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সে অনড়। এই বয়সে সে বিয়েও করতে চায় না। যদিও ভারতের প্রান্তিক জনপদে পরিবারের বিপক্ষে মত দেয়া সোজা কথা নয়।

ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বেশী বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটে ভারতে। সেদেশে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী এক কোটি ৭০ লাখ মেয়ে বিবাহিত। যদিও ২০০৬ সালে ভারতে বাল্যবিয়েকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়।

তাছাড়ও এ বছরের শুরুতে মেয়ে শিশুদের রক্ষায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছেন, মেয়ে শিশুর সঙ্গে যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবেই বিবেচনা করা হবে। তবে আইনের এসব বাধা-নিষেধ পেরিয়ে সমাজ এবং পরিবারগুলো বাল্য বিয়ে থেকে পিছপা হচ্ছে না দারিদ্র, নিরাপত্তাহীনতা এবং কুসংস্কারের কারণে।

সমাজ বিশ্লেষকরা বাল্যবিয়ের পরিস্থিতিকে এভাবেই দেখছেন। কিন্তু বৈরি সমাজের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে রজনী। এ লড়াই ছোটখাট লড়াই না। দিনের পর দিন তাকে পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হয়েছে। তার এক কথা, মরে যাবে তবু বিয়ে করবে না। নিজের মাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে তার দুর্ভোগের কথা, কিশোরী বয়সে মা হয়ে পড়ার কষ্টের কথা। শেষ পর্যন্ত রজনীর পরিবার হার মেনেছে।

মা-বাবার সঙ্গে রজনী

রজনীর লড়াইয়ের তখন সবে শুরু। নিজের কাছে রজনীর প্রতিজ্ঞা, কেবল নিজের বিয়ে বন্ধ করেই থামবে না, আশেপাশের আরো দশজন কিশোরীর বিয়ে প্রতিহত করবে। সেই চিন্তা থেকে গত কয়েক মাসে উত্তর প্রদেশে নিজ গ্রামের ৫ জন কিশোরীর বিয়ে বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে রজনী। ছোট্ট গ্রামের মেয়েদের নিয়মিত কাউন্সেলিং করে সে। নিজের পরিবারের কর্তাদের কীভাবে মানাতে হবে সেই কৌশল শেখানোর চেষ্টা করে। মেয়েদের বোঝানোর চেষ্টা করে, বিয়ে না করে পড়াশোনা করলে বিয়ের তুলনায় আরো বড় বড় সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হবে মেয়েরা।

রজনী মনে করে, নিজের বিয়ে বন্ধ করতে পেরে তার সাহস আরো বেড়ে যায়। এখন রজনীর বয়স ১৮ বছর। গত কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রজনী যাতে করে মেয়েরা স্কুল চালিয়ে যেতে পারে। এ ধরণের প্রচেষ্টার কারণে আশেপাশের ছোট-বড় নারীদের মনে এখন রজনীর জন্য শ্রদ্ধাবোধের জন্ম হয়েছে। তাকে তারা যথেষ্ট সমীহ করে চলে।

নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য সম্প্রতি ‘গার্ল আইকন ফেলোশিপ’ অর্জন করেছে রজনী। মিলান ফাউন্ডেশন তাকে এই ফেলোশিপ দিয়েছে। এই ফেলোশিপ রজনীর কাজকে আরো ত্বরান্বিত করতে বলে বিশ্বাস করে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান মিলান ফাউন্ডেশন।

স্বনির্ভরতা এবং ক্ষমতায়নের স্বংকল্প রজনী ও তার দলের

রজনী যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে সে সময় তার বাবা-মা তাকে বিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে। যে ছেলেটির সঙ্গে বিয়ে ঠিক করা হয়েছিলো তাকে কখনো দেখেওনি রজনী। তার মা বাল্যবিয়েকে মেনে নিয়েছেন কারণ তিনি জানেনই না সারা বিশ্ব বিষয়টিকে কীভাবে দেখছে, দুনিয়া কীভাবে চলছে, বলেছে রজনী। তার মায়ের বিয়ে হয়েছিলো মাত্র ১১ বছর বয়সে। তাদের গ্রামের বেশীরভাগ বয়জ্যেষ্ঠ নারী বিশ্বাস করেন, ঋতুমতী হবার আগেই মেয়েদের বিয়ে দিতে হবে।

মূলত দারিদ্রের কারণেই রজনীর পরিবার তাকে অল্প বয়সে বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। তাদের সমাজে মেয়েদের বয়স যত বেশী হয় তাদের বিয়েতে তাদেরকে ততো বেশী যৌতুক দিতে হয়। ভারতে যৌতুক দেয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। বেআইনী হলেও যৌতুক প্রথা চলছেই।

রজনী এখন নিজ গ্রামের ২০ জন মেয়ের দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। যাদের লক্ষ্য মেয়েদের স্বনির্ভরতা এবং ক্ষমতায়ন।

বাল্য বিয়ের ঠেকাতে মাঠে নেমেছে রজনী

বিশ্বের কোথাও না কোথাও প্রতি ২ সেকেন্ডে একটি মেয়ে শিশু বাল্য বিয়ের শিকার হচ্ছে। ভারতের মতো দেশে একটি দরিদ্র পরিবারে মেয়ে শিশুর বিয়ে দেয়া হয় কারণ, পরিবারে খাওয়ার লোক একজন কমলো।
দারিদ্র ছাড়াও রয়েছে নানা সঙ্কট। ঘরে বাইরে মেয়েরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। যার কারণে পরিবার মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিতে চায়।

প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক গ্রামে উচ্চমাধ্যমিক স্কুল নেই। রজনী বিশ্বাস করে নিজের গ্রামে বা পাশের গ্রামে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল থাকলে, যাতায়াতের সুব্যবস্থা থাকলে পরিবারগুলো এতো দ্রুত মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিতো না।
কলেজে যাতায়াতের জন্য রজনী প্রতিদিন সাইকেলে করে ৪০ মাইল পাড়ি দেয়।