নারী মানেই বাধার পাহাড়। আর বিজ্ঞান! অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এই বিজ্ঞানেও নারীর প্রতিকূলতার শেষ নেই। নারীদের দিয়ে বিজ্ঞানের মতো বিষয়ে কিছুই হতে পারে না, এমন মনোভাব অনেকাংশে দেখা যায়। অথচ উচ্চশিক্ষার সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে নারীরা খুব একটা পিছিয়ে নেই। নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াসেই গড়ে উঠতে পারে দেশ তথা বিশ্বের সামগ্রিক বিজ্ঞান ভিত্তিক উন্নয়ন।
গোড়া থেকে দেশের উন্নয়ন করতে হলে এবং সেটাকে স্থায়ী করতে হলে দরকার মৌলিক বিজ্ঞান চর্চার। আর পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যদি বিজ্ঞানচর্চায় অংশ নেয় তাহলেই সম্ভব সামগ্রিক উন্নতি। সেদিকেই মূলত জোর দিচ্ছেন দেশের নারী বিজ্ঞানীরা।
২৫ বছর যাবত গবেষণার সঙ্গেই আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জেবা ইসলাম সেরাজ। কিন্তু এতটা সময়ে নারীদের অগ্রযাত্রায় বাধাতো তিনি কম দেখেন নি।
তিনি বলেন, রিসার্চ করতে আমরা সবাই কিছু না কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। কেউই উপলব্ধি করেনা একটি দেশের জন্য গবেষণা কতটা দরকারি।অনেকে আছেন যারা বিজ্ঞান বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে কোনো নারীকণ্ঠ শুনলেই যেন অবাক হয়ে যান। বিজ্ঞানে কাজ করতে গেলে যে পরিমাণ মনোযোগ দেওয়া দরকার সেই পরিমাণ মনোযোগওতো নারীরা দিতে পারেন না অনেক ক্ষেত্রেই।
তবে দেশে বিজ্ঞানচর্চার যে অবস্থা তার মূলে নানান অব্যবস্থাপনাও রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, হয়তো আমরা যারা বিজ্ঞানচর্চা করছি তারা বুঝতে পারছি একটি ল্যাব চালাতে কত কত টাকা দরকার হয়। সেখানে থাকা ছোট ছোট জিনিসপত্রগুলোও কতটা জরুরি। কিন্তু এই বিষয়ে অনুদান দেবে যে মন্ত্রণালয় সেখানে যারা বসে আছে তারা হয়তো সেসব ঠিকভাবে বোঝেই না। ফলে, বলে এত টাকা দিয়ে কী হবে? আমাদের বিষয়টাই এমন যে এই সম্পর্কিত কোনো কিছু নিয়ে গবেষণা করতে গেলে সেটাকে সঠিক টেম্পারেচারে রাখতে হয়। সেক্ষেত্রে হয়তো বিদেশ থেকে কিছু উপকরণ আমি আনালাম কিন্তু সেটা নিজেদের কাছে নিয়ে আসা পর্যন্ত নানান জনের সাক্ষর নিতে নিতে অনেক সময় পার হয়ে যায়। ফলে জিনিসগুলোও প্রায় নষ্ট হয়ে যায়।
সমস্যার সমাধানে শিক্ষার্থীদের আরো বেশি প্রশ্ন করার মানসিকতা গড়ে দেওয়ার উপরই জোর দিলেন দেশের এই নারী বিজ্ঞানী। সেরা শিক্ষক নির্বাচনের এক জরিপের কথা জানান তিনি, সেখানে সেসব শিক্ষককেই ভালো শিক্ষক বলা হয়েছে যারা সব প্রশ্নের উত্তর দেন না। এবছর গুগল পুরস্কার পেয়েছে সাউথ আফ্রিকার এক ১৬ বছরের কিশোরী মেয়ে যে কিনা কমলার খোসা আর অ্যাভোকাডো দিয়ে একটা পাউডার তৈরি করেছে যেটা শস্যের গোড়ায় পানি ধরে রাখতে সাহায্য করে। সেতো চিন্তা করেই এই পদ্ধতিটা বের করেছে। ভালো শিক্ষকরা বাচ্চাদের কোনো কিছু নিয়ে ভাবার সুযোগ করে দেয়। শিক্ষার্থীর মনে প্রশ্ন তৈরি করতে পারলেই তাদের মধ্যে বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. তাপসী ঘোষ রায় অবশ্য মনে করেন, নারীদের বিজ্ঞান চর্চা বাড়াতে সবচেয়ে বেশি সহায়তা দরকার পরিবারের। পরিবার থেকে যদি একটি মেয়ে যথাযথ সহায়তা পায় তাহলে এই সমস্যাটা কমবে অনেকাংশেই। তবে সবথেকে বেশি যেটা দরকার সেটা হলো বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা। বিজ্ঞানের প্রতি মনোপ্রাণ নিবেদিত না হলে কেউ নিজেকে বিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে না। বিজ্ঞানচর্চা করতে হলে একজন মানুষকে যে পরিমাণ সময় ও সুযোগ দিতে হবে তা দেওয়া কখনোই সম্ভব হবে না ভালোবাসা না থাকলে।
বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে নারীদের প্রধান সমস্যা সুযোগের অভাব বলেই মনে করেন তিনি।
তবে ঢাকা সিটি কলেজের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক আফরোজা জামান অবশ্য মনে করেন, সমস্যাটা মেয়ে বা ছেলেকে নিয়ে নয়। মূল সমস্যাটা বিজ্ঞানচর্চা নিয়েই। কারণ বিজ্ঞান আর ঠিক সেই মৌলিক বিজ্ঞান চর্চার জায়গায় নাই। আজকাল অনেকেই বিজ্ঞান পড়ে এই জন্য যে বিজ্ঞান পড়লে ভালো নাম্বার পাওয়া যায়। ফলে চিন্তার বিকাশের সুযোগ সেভাবে গড়ে উঠছে কোথায়। সত্যি সত্যি মৌলিক বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে চায় কজন ছেলেমেয়ে? সবাই হয় ডাক্তার হতে চায় নয়তো ইঞ্জিনিয়ার। সেজন্যই বিজ্ঞান পড়ে।
তবে নারীদের বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হিসেবে তিনি মনে করেন নিরাপত্তার সমস্যাকে, আমি যখন পড়াশোনা করতাম তখন কোনো কাজ থেকে ফিরতে রাত হয়ে গেলেই আমার একজন সহপাঠীকে আমার সঙ্গে থাকতে হতো, যেন সে আমার নিরাপত্তা দেয় সেজন্য। একটা ছেলেকেতো এমন সমস্যায় পড়তে হয় না। যতদিন সবার সুস্থ নিরাপত্তা দেওয়া না যাবে, ততদিন দুশ্চিন্তামুক্তভাবে নারীদের কাজ করা হয়ে উঠবে না। বিজ্ঞানে গবেষণা করলে ১২ ঘণ্টা-২৪ ঘণ্টা সেটার পেছনে সময় দিতে হবে। কিন্তু এদেশে রাত হলেই গ্রাস করে নিরাপত্তার চিন্তা। তাছাড়া একটি মেয়ে যদি সংসারে ঢুকে পড়ে তাহলে আগে তাকে ছেলেমেয়ের খবর রাখতে হবে, রান্নাবান্নার খবর রাখতে হবে, বাজারের খবর রাখতে হবে, সংসারের খবর রাখতে হবে, তারপর সে বিজ্ঞানচর্চায় মন দিতে পারবে। এই অবস্থা থেকে কি মৌলিক বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব?
এই সমস্যাগুলোর সমাধান করলেই একটু একটু করে এগিয়ে যাবে দেশের নারী বিজ্ঞানীরা। অন্যান্য সবক্ষেত্রেই এখন নারীর সরব পদচারণা থাকলেও কেবল বিজ্ঞানেই পিছিয়ে। তারপরেও বিজ্ঞান বিষয়ক উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় দেশের নারী বিজ্ঞানীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অবদান উল্লেখ করার মতো। এই অবস্থার উন্নয়নে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার উপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রতিকূলতা মাথায় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন দেশের নারী বিজ্ঞানীরা।