চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রী নিতে বাংলাদেশ সফরে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির প্রীতিভোজে অংশ নেওয়া একটি ফটোসেশনকে ঘিরে সমালোচনা শুরু হয়েছে। সমালোচনার কারণ, তিনি একটি চেয়ারে বসে আছেন, আর তিনি যখন ভারতের মন্ত্রী ছিলেন তখন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট পদে থাকা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দাঁড়িয়ে আছেন তারই পেছনের সারিতে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের স্পীকার, অর্থমন্ত্রীসহ আরও অনেক মন্ত্রীকে প্রণব মুখার্জির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
যেকোন দেশের সাবেক কিংবা বর্তমান প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী অথবা মন্ত্রীরা যখন বিদেশ সফর করেন, তখন তার নির্দিষ্ট একটা প্রটৌকল থাকে। প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরেও সেটা দরকার ছিল। যদিও তার বাংলাদেশ সফর ছিল ব্যক্তিগত, কিন্তু প্রীতিভোজের অনুষ্ঠান তো ভারতীয় হাইকমিশন করেছিল। হাইকমিশনের এমন প্রীতিভোজে প্রটৌকলের কাণ্ডজ্ঞান থাকবে না, তা কোনভাবেই মানা যায় না।
অনেকে বলছেন, প্রণব বাবু বয়োজ্যেষ্ঠ লোক, তাই তিনি চেয়ারে বসে ছিলেন। অন্যরা দাঁড়িয়ে। কিন্তু উইকিপিডিয়ার তথ্যসূত্র ভিন্ন কথা বলছে। উইকিপিডিয়া বলছে, প্রণব মুখার্জির জন্ম ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর। আর সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৬ অক্টোবর। সেই হিসাবে মি. মুখার্জির চেয়ে এরশাদ ৫ বছরের এবং আবুল মাল আব্দুল মুহিতের ১ বছরের বড়। সুতরাং জ্যেষ্ঠতার কারণে তার চেয়ারে বসে থাকার বিষয়টিও গ্রহণযোগ্য নয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ছবি নিয়ে সমালোচনা তৈরি হওয়ার আরেক কারণ হলো ছবিতে প্রণব বাবুর বসে থাকার ধরণ। তিনি এমন ভঙ্গিতে বসে আছেন, যেন দেখলে মনে হয়- ব্রিটিশ আমলের কোন জমিদার বসে আছেন, আর তার প্রজারা দাঁড়িয়ে আছেন তারই পেছনে! এতে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের দাদাগিরির চেহারা। ভারত হয়তোবা বাংলাদেশকে এভাবেই দেখে থাকে। যা ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতির বসে থাকার ধরণে প্রমাণ হয়েছে।
ভারতীয় হাইকমিশনের ফেসবুক এবং টুইটার পেজে শেয়ার করা ১৭টি ছবিতে দেখা যায়, কোন ছবিতেই ১০ থেকে ১৫ জনের বেশি লোকজন নেই। যদি তাদের কথাই ধরি যে, পালাক্রমে ছবি তোলার জন্য প্রণব বাবু চেয়ারে বসে ছিলেন, তাহলে হাইকমিশন কি পালাক্রমে সবার বসার জন্য ১০ থেকে ১৫টা চেয়ারের ব্যবস্থা করতে পারলো না? এই স্বল্প সংখ্যক চেয়ারের যোগান দেওয়া কি একটি হাইকমিশনের জন্য খুব ঝামেলার বিষয়? হাইকমিশন বিষয়টি মাথায় না রাখলেও প্রণব বাবু মনে করিয়ে দিতে পারতেন! এত বছর রাজনীতি করে প্রাপ্তির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছানো তার মতো বিজ্ঞ রাজনীতিবিদের কাছে এটুকু আশা করা নিশ্চয় অন্যায় না।
এই চেয়ারে বসা ও দাড়িয়ে থাকা ইস্যু নিয়ে দেশের জনগণের মনে যে রাজনীতি এবং কূটনীতিসহ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের উষ্ণতার সৃষ্টি হলো, এর দায় কি প্রণব মুখার্জি এড়াতে পারবেন? মনে হয় দায় এড়াতে পারেন না।
ভারতীয় হাইকমিশন অবশ্য নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ওই ছবিগুলো তাদের ফেসবুক পেজ এবং টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তারা এই বিষয়ে নিজেদের ভুল স্বীকার করেনি। তবে কেউ কেউ এরশাদকে স্বৈরশাসক হিসেবে অপমান করে কথা বলছেন। এরশাদ একজন স্বৈরশাসক এবং তিনি গণ অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এজন্য তাকে যা বলার তা এদেশের মানুষ বলতে পারে, কোনভাবেই বিদেশের সাবেক কোন রাষ্ট্রপতি, কিংবা অন্য কাউকে দিয়ে অপমান করার প্রশ্ন আসে না। বিদেশি কাউকে দিয়ে তার অপমান করা মূলত বাংলাদেশকে অপমান করারই নামান্তর।
এখানে অবশ্য শুধু ভারতের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এরশাদ এবং বিএনপি মহাসচিবসহ অন্য যারা প্রজার মতো ‘দাদাবাবু’ বা ‘জমিদার’ প্রণব বাবুর পেছনে দাঁড়িয়ে রইলেন, তারা কেন বিষয়টি একবারের জন্য ভাবলেন না। নিজেদের সম্মানের কথা কেনো ভাবলেন না। কেন তাদের বোধদয় হলো না, তারা এখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি। এই আত্মসম্মান আর প্রটৌকল বোধটুকু আমাদের রাজনীতিবিদদের কবে হবে? হয়তো নানা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে দৌড়াঝাপ করতে করতে তাদের সেই বোধের জায়গা দুর্বল হয়ে গেছে। জণগণের জন্য কাজ করে যাওয়া রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার রাজনীতিতে হয়তো জনগণের চেয়ে দূতাবাসগুলোর উপরে নির্ভরতার কারণে এই অবস্থা। কী করলে দেশের জনগণের আত্মসম্মানে আঘাত লাগবে না, এই বোধ তাদের কবে হবে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)