চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন: ঘুনেধরা সমাজের বলি

একেবারে সাম্প্রতিক সময় থেকেই শুরু করি। সরকারি চাকরি ছেড়ে বিদেশে এসেছি শুনে সবাই কেমন জানি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় আমাদের দিকে তাও আবার একজন না আমাদের দুজনেরই সরকারি চাকরি ছিলো। তখন সন্দেহটা আরো ঘনীভূত হয়। নিশ্চয় দেশে আমরা বড় ধরণের কোন দুর্নীতি করে এদেশে এসে লুকিয়েছি। মানুষের গলার স্বরের বিষয় আমি ঠিকই টের পাই আর চোখের চাহনিতে সেটা আরো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। অনেকে আবার এতোটাই বিস্মিত হন যে জিজ্ঞেস করেই ফেলেন কেন আমরা দুজন সরকারি চাকরি ছেড়ে বিদেশে এসে কামলা দিচ্ছি। একবার একজন যখন জানতে পারলেন আমরা সরকারি চাকরি ছেড়ে বিদেশে এসেছি তখন বলেই বসলেন বিদেশের মাটিতে মানুষ যে কি মধু পায় যে সরকারি চাকরি ফেলে বিদেশে পাড়ি জমায়। সরকারি চাকরি নিয়ে সাধারণের মনের ধারণাটা এমনই।

অন্য একদিন আড্ডায় একজন নেতাগোছের বড় ভাই দেশে তার একজন সরকারি চাকুরীজীবি বন্ধুকে নিয়ে অনেক গর্ব করে গল্প করছেন। একবার দেশে গিয়ে উনি ওনার সেই বন্ধুর কর্মক্ষেত্র সিলেটের একটা জায়গায় বেড়াতে গেছেন। সেখানে ওনার বন্ধু উনাকে সিলেটের সবরকমের ভালো ভালো খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করেছেন। কথায় কথায় বলেই ফেললেন, বাংলাদেশে যে এতো প্রজাতির মাছ পাওয়া যায় উনি এর আগে জানতেন না। কি সুন্দর দেখতে আর কি তার বাহারি স্বাদ। এখনও না কি উনার ঠোঁটে লেগে আছে। এটা শুনে আমি নরমভাবে জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি একবারও আপনার বন্ধুর অতগুলো মাছ কেনার সামর্থ্য আছে কি না যাচাই করেছেন। আমার প্রশ্ন শুনে উনি আমার দিকে তির্যক দৃষ্টি দিলেন। আমি বললাম: এই মাছ সরবরাহের জন্য আপনার বন্ধুকে হয়তোবা কারো একটা অন্যায় প্রস্তাব মেনে নিতে হয়েছে।

এমন আরও হাজারটা উদাহরণ দেয়া যাবে সরকারি চাকরিজীবীদের নিয়ে। আমি এখানে শুধু প্রবাস জীবনের দুটো উদাহরণ দিলাম। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আপনি যদি একটা মোটামুটি মানের জীবন নিশ্চিন্তে এবং নির্ভাবনায় পার করে দিতে চান তাহলে সরকারি চাকরির বিকল্প নেই তাই তো বিসিএস পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে। যে যে বিষয় নিয়েই পড়ুক না কেন দিনশেষে সবাই বিসিএস দেয়ার জন্য পড়াশোনা করছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের টেকনিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষের দুর্দশা দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে তাই সবাই এখন বিসিএসে প্রশাসনকেই সর্বোচ্চে অগ্রাধিকার দেয় কারণ সবাই জেনে গেছে দেশটা আদতে জনগণের বা রাজীনীতিবিদদের হলেও দিনশেষে শেষে প্রশাসনের আমলাদের দেশ। আর বিসিএস এমন একটা পরীক্ষা যে সেখানে কোন একজন পরীক্ষার্থীর মেধাকে আলাদাভাবে যাচাই করার উপায় নেই। সবাইকেই একই রকম পরীক্ষা দিতে প্রিলিমিনারী পাস করতে হয় আর তার জন্য মুখস্থ বিদ্যার কোন বিকল্প নেই তাই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন কলেজ থেকে সামান্য অনার্স পাস করা পরীক্ষার্থীও প্রথম হয়ে যান কারণ সে নিজের পড়াশোনার বাইরে পুরোটা সময় বিসিএসের জন্য পড়েছেন।

বিসিএসএরপর আসে বিসিএস লিখিত পরীক্ষা। সেখানেও নয়টি বিষয় সবার জন্য নির্ধারিত আর টেকনিক্যাল ক্যাডারদের দিতে হয় নিজের বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত বাড়তি আরো দুটো পরীক্ষা। সবশেষে আসে মৌখিক পরীক্ষা।এ গুলোতে উত্তীর্ণ হতে পারলেই যে একজন সরকারি চাকরি করতে পারবেন ব্যাপারটা কিন্তু তা না কারণ পুলিশ ভেরিফিকেশনে অনেকেই বাদ পরে যান। প্রিলিমিনারি পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে বাংলাদেশে বহু গল্প প্রচলিত আছে আমি সেদিকে যাচ্ছি না। আমি ধরে নিচ্ছি এগুলোর সবই নিয়ম অনুযায়ী হয় এবং একজন যোগ্য প্রার্থীই দিনশেষে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। একবার সরকারি চাকরিতে যোগদানের পর জীবন হয়ে যায় একেবারে স্থবির। বাংলাদেশের সরকারি চাকরির বিধিমালা এখন পর্যন্ত বৃটিশদের রেখে যাওয়া ১৯২১ সালের সরকারি চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী। অবশ্য চাকরি স্থায়ীকরণের তিনটা শর্ত আছে। প্রথমত অন্ততঃপক্ষে দুবছর চাকরি করতে হবে, বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ শেষ করতে হবে আর বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এই তিনটি শর্ত পূরণের পর আর চাকরি যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এরপর আপনি যতই দুর্নীতি করেন না কেন আপনাকে বিভিন্নভাবে শাস্তি পেতে হতে পারে কিন্তু চাকরি যাওয়ার সুযোগ একেবারে নেই বললেই চলে কারণ চাকরির বিধিমালা আপনাকে সুরক্ষা দিবে। আমি তাই বলি সরকারি চাকরি পাওয়া অনেক কিন্তু যাওয়া মোটামুটি অসম্ভব।

আমি ঠিক জানিনা বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে দুর্নীতির সূত্রপাত কবে কিন্তু দুর্নীতি যে আছে সেটা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন তবে দুর্নীতির এই চর্চা বহুবছর ধরে চলার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে আমার কাছে প্রধান কারণ বলে মনেহয় সরকারি চাকরির স্থায়িত্ব। আপনি কোন একটা দুর্নীতি করলে আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে। এর চেয়ে বেশি কিছু হলে আপনাকে ও এস ডি (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) করা হবে। আর যদি প্রাথমিক তদন্তে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে বিভাগীয় নীতিমালা অনুযায়ী মামলা চলবে কিন্তু চাকরির যাওয়া এগুলোর একেবারে শেষ ধাপ। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় কাউকে দুর্নীতির দায়ে শেষ পর্যন্ত সরকারি চাকরি অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সরকারি চাকরিতে ঢোকার আগেই আপনার মানসিকতাকে তৈরি করতে হবে দুর্নীতি সহ্য করে নেয়ার। যুগযুগ ধরে সরকারি ব্যবস্থায় দুর্নীতি এমনভাবে ঢুকেছে যে এখন আর সেটাকে অস্বাভাবিক মনেহয় না বরং কোথাও দুর্নীতি নেই জানলেই ব্যাপারটা কেমন জানি বেখাপ্পা মনেহয় এখন।

দিনে দিনে এই সকল দুর্নীতি বিভিন্ন রকমের খেতাবও পেয়েছে। এইবার সেদিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক। একটা কথা প্রায়শই শোনা যায় সেটা হচ্ছে সহনীয় দুর্নীতি আর অসহনীয় দুর্নীতি আমি অবশ্য নিজের সরকারি চাকুরীর অভিজ্ঞতা থেকে দুর্নীতিকে তিন ভাগে ভাগ করি হালাল ঘুষ, জায়েজ ঘুষ এবং হারাম ঘুষ। হাল, জায়েজ এবং হারাম শব্দগুলো ব্যবহার করার জন্য ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি কিন্তু এই টার্মগুলো ছাড়া আসলে দুর্নীতির প্রকটতা বুঝানো সম্ভব না। হালাল দুর্নীতি হচ্ছে সেই সকল দুর্নীতি যেটা সবাই মেনে নিয়েছে। যেকোন একটা প্রজেক্ট পাস হবার প্রাক্কালে বা সামান্য পরেই এই দুর্নীতিগুলো হয়ে থাকে। প্রোজেক্টের মূল্যমানের উপর উপর ভিত্তি করে সরকারি লোকজনের ব্যাংক একাউন্টে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ চলে যায় যারযার পদাধিকার অনুযায়ী। সেই প্রোজেক্টের সাথে যুক্ত মন্ত্রী থেকে শুরু করে, সচিব, প্রজেক্ট ডিরেক্টর এবং তার অধীনে যুক্ত প্রত্যেকেরই তাতে ভাগ থাকে। এই দুর্নীতি বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটা প্রোজেক্টের ক্ষেত্রেই আছে। এই দুর্নীতি বাংলাদেশের মানুষের মানসিকতায় এমনভাবে ঢুকে গেছে যে সেটা সরকারি পরিধি ছাড়িয়ে বেসরকারি, বহুজাতিক কোম্পানি এমনকি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। এই দুর্নীতির একটা গালভরা নামও আছে “পার্সেন্টেজ” যেটাকে সংক্ষিপ্ত করে বলা হয় পিসি। কোন সরকারি কাজ কেউ পেয়েছেন কিন্তু তাকে পিসি দিতে হয়নি একথা কেউ হলফ করতে বলতে পারবেন না বলেই আমার বিশ্বাস।

এরপরের ক্যাটেগরিকে আমি নাম দিয়েছি জায়েজ দুর্নীতি। এই দুর্নীতিটাও এখন মোটামুটি সহনীয় হয়ে গেছেন। কোন একটা প্রজেক্ট চলছে তখন যারা এই প্রজোক্টের সাথে সংশ্লিষ্ট থেকে তত্ত্বাবধান করেন তাদেরকে নিয়মিত একটা টাকা দিতে হয়। একটু বিস্তারিত বলা যাক। প্রজোক্টের সাথে সম্পর্কিত কোন ব্যক্তি যদি মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শণে যান তখন সেই ব্যক্তির খাওয়া দাওয়া চলাফেরা খরচ দেয়া হয়। সেই ব্যক্তির সাথে আগত ড্রাইভার, মাঠ পর্যায়ের কর্মী সবারই যত্ন নেয়া হয় এবং দিনশেষে ফিরে যাবার সময় প্রত্যেকের পদাধিকার অনুযায়ী একটা অর্থ তাদেরকে দেয়া হয় কষ্ট করে প্রজেক্টের অগ্রগতি দেখতে আসার জন্য। যদিও সেই সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী অফিস থেকে বা প্রজেক্টের অর্থ থেকেও দৈনিক ভাতা পাবেন মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শনের জন্য। আর তৃতীয় প্রকারের দুর্নীতি হচ্ছে হারাম দুর্নীতি। প্রজেক্টের কাজ শেষ হয়ে শেষ হয়ে গেছে এবং সেই মোতাবেক বিল সাবমিট করা হয়েছে অনুমোদনের জন্য কিন্তু তখনও অনেক সরকারি কর্মকর্তার মনে ক্ষিধে রয়ে গেছে। তখন এই হারাম দুর্নীতির অবতারণা হয়। বিল অনুমোদনের আগে তখন সরকারি কর্মকর্তা শর্ত জুড়ে দেন। এই শর্ত জুড়ে দেয়াটাও এখন শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিল সাবমিট করার পর বলা হলো আপনার ভাবি গতকাল অমুক মার্কেটের অমুক দোকানে একটা ভালো টেলিভিশন বা ফ্রিজার দেখে এসেছেন। পরেরদিন সেই নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের পণ্য সেই কর্মকর্তার বাড়িতে শোভা বর্ধন করলেই কেবল বিল অনুমোদন দেয়া হয় অন্যথায় অহেতুক ঝামেলা তৈরি করে বিল আটকে রাখা হয়।

এমন আরো বহু দুর্নীতির প্রকার বলা যাবে। অফিস ভেদে এগুলোর শুধু আকার এবং প্রকার বদলে যায় কিন্তু দুর্নীতি বাংলাদেশের সবগুলো সরকারি খাতে বিদ্যমান। মৌলিক চাহিদাগুলোর ডিপার্টমেন্টে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় কারণ সেখানে বাজেটের অনেক বড় অংশ ব্যয় হয়। আগেই বলেছি দুর্নীতির এই চিত্র বাংলাদেশের সরকারি খাত ছাড়িয়ে বেসরকারি, বহুজাতিক এমনকি বিশ্বময় ছড়িয়ে গেছে তবুও কেন বাংলাদেশের সরকারি ব্যবস্থা ভেঙে পরে না এর অনেকগুলো কারণের একটি হলো একেবারে হাতেগোণা কিছু শতভাগ সরকারি কর্মকর্তা এখনও সব বিভাগেই সততার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন তবে তাঁদের জীবনযাপন হয় একেবারে অনাড়ম্বর সোজা বাংলায় তথৈবচঃ। ঠিক তেমনই একজন কর্মকর্তা ছিলেন প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন। উনি সরকারি একটি দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীর পদে চাকরি করা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত একটা নয়শ স্কয়ার ফুটের একটা ভাড়া বাসায় থাকতেন যেখানে আমি হলফ করে বলতে পারি উনার সমান পদমর্যাদার ব্যক্তিদের ঢাকা শহরে একাধিক ফ্ল্যাট, বাড়ি এবং গাড়ি আছে। বাসাতে আছে একটা বিশ বছরের পুরোনো ফ্রিজার। আসলে ২০১৪ সালে সরকারি নতুন বেতন কাঠামোর আগ পর্যন্ত সরকারি বেতন এমন পর্যায়ের ছিলো যে একজন সরকারি চাকুরীজীবির জন্য যেকোন শহরে সৎভাবে জীবনযাপন মোটামুটি অসম্ভব ছিলো। এরপর বেতন বেড়েছে কিন্তু সরকারি লোকজন তাদের পুরোনো দুর্নীতির অভ্যাস রাতারাতি ত্যাগ করতে পারেনি।

সরকারি দপ্তরে অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে গেছে যে আপনি চাইলেই দুর্নীতি না করে থাকতে পারবেন না। আপনি হয়তোবা আপনার দর্শন নিয়ে থাকতে চাইলেন কিন্তু সেখানেই বাঁধ সাজবে একটা পুরোপুরি আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে থাকা সিস্টেম। আপনি দুর্নীতি না করলে আপনার উছিলাতে আপনার অধিনস্তরাও বঞ্চিত হতে থাকবে তাদের এতোদিনের পাওনা অংশ থেকে আর তারা সেটা কোনভাবেই বরদাস্ত করবে না। আর একটা ব্যাপার হচ্ছে আপনি হয়তোবা টাকা পয়সার দুর্নীতি করছেন না কিন্তু আপনি কাজের গুণাগুণও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবেন না কারণ আপনার একার পক্ষে শুধু এটা করা সম্ভব না। আর আপনি যদি পরবর্তিতে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে জানতেও পারেন যে কাজের গুণাগুণ খারাপ তবুও আপনাকে বিল ছেড়ে দিতে হবে কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রায় সবাই আগে থেকেই ব্যাপারটা জানেন এবং ইতোমধ্যেই ম্যানেজ হয়ে গেছেন। দেলোয়ার ভাইয়ের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। আর উনার হত্যাকারী হিসেবে যে সহকারী প্রকৌশলীকে ধরা হয়েছে আমার বিশ্বাস সে শুধুমাত্র দাবার গুটি কিন্তু তাকে পরিচালনা করেছে কোন রাঘব বোয়াল হতে পারে সে সরকারের কোন মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, এমপি বা কোন জনপ্রতিধি বা সরকারের বড় কোন আমলা।

এইবার আসি যারা দুর্নীতি করেন তাদের মানসিকতার বিষয়ে। সরকারি ট্যাক্স অফিসে টিন সার্টিফিকেট আনতে গেলে যে মহিলা কর্মকর্তা টিন সার্টিফিকেটে দস্তখত করেন উনার একটা কথা এখনও মনে আছে। উনি বলেছিলেন উনার দুইটা মেয়ে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। আমরা যদি উনাকে এই বাড়তি টাকাগুলো না দে তাহলে তাদের বেতন দিবেন কিভাবে। ব্যক্তিগত দুবছর সরকারি চাকরী করতে যেয়ে দেখেছি উনাদেরও মাইন্ড সেট আছে দুর্নীতি করার ব্যাপারে। আমার অধঃস্তন একজন আমাকে বলেছিলেনঃ স্যার আপনি তো ইচ্ছে করেই এই বাড়তি টাকাগুলো নিচ্ছেন না। আপনার চলার মতো টাকা সরকার বেতন হিসেবে দেয় না তাই আপনাকে এই টাকাগুলো নিতে হয়। উনারা কথাটা একেবারে অসত্য না। আমরা দুজন সরকারি চাকুরী করে যা আয় করতাম সেটা বাসা ভাড়া আর খরচ বাদ দিয়ে যা থাকতো তা দিয়ে আমাদের চলতো না। অর্ধেক মাস পার হবার আগেই আমাদেরকে অফিসে যাবার বাস ভাড়া বাবদ অর্থ ধার করতে হতো প্রতিবেশীর কাছ থেকে।

বাংলাদেশের প্রতিটা খাতের দুর্নীতি এটাই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থা পুরোপুরি দূষিত তাই একটা একটা করে আলাদাভাবে দুর্নীতির বিচার করে আসলে লাভ নেই। পুরো সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার বিশেষকরে মানুষের মনজগতে বিশাল পরিবর্তন আনা দরকার। দুর্নীতির টাকায় আলগা ফুটানি দেখিয়ে সমাজে চলাফেরা করলে যেখানে মানুষের সামাজিক অবস্থান বা স্ট্যাটাস উঁচুতে উঠে যায় সেখানে রাতারাতি দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব না তবে এক একজন দেলোয়ার হোসেন জীবন দিয়ে আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে যান আমাদের করণীয় কি কিন্তু আমরা আমাদের গোল্ড ফিশ মেমোরিতে বেশিক্ষণ সেটা ধরে রাখি না। কয়েকদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গরম করে আবারও আগের জীবনেই ফিরে ফিরে যায় আর দুর্নীতিও তার আগের অবস্থানে ফিরে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা সবাই দুর্নীতিমুক্ত সমাজ চেয়ে গলা ফাটায় কিন্তু আমরা কেউই নিজের সামান্যতম স্বার্থটুকু হাসিল করার জন্য দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পিছপা হয় না।

আমাদের সমাজে আরো একটা ব্যাপার লক্ষণীয় সেটা হলো আমরা ছোট মাস্তান বা সন্ত্রাসীকে খারাপ বলি কিন্তু তাদেরকে লালন করা জনপ্রতিনিধি সকাল বিকাল তৈল মর্দন করি। আমরা যতদিন না এইসব মানুষকে সামাজিকভাবে বয়কট না করবো ততদিন পর্যন্ত মানুষ দুর্নীতি করতে নিরুৎসাহিত হবে না। আরো একটা ব্যাপার হচ্ছে সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারির ক্ষমতা বা যায় কতটুকু। সরকারি চাকরি করে এলাকায় বড় বড় উপাসনালয় আর এতিমখানা বানালেই তাকে সমাজের মাথা ভাবার কোন কারণ নেই কিন্তু আমরা তাদেরকেই সম্মানের আসন দিই। অন্যদিকে একজন সৎ সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী নীরবে নিভৃতে থাকেন আর আমরা তাকে গোণার মধ্যেও রাখি না অবশ্য উনারা এগুলোর ধার না ধেরেই সৎ জীবন যাপন করেন নিজের মানসিক শান্তির জন্য। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় উনাদের এই সততাকে সাধারণ মানুষ দেখে দুর্বলতা হিসেবে।

এতো এতো দুর্নীতির পরও বাংলাদেশ যে টিকে আছে আমার মতে তার ভিত হচ্ছে তিনটি। প্রথমতঃ বাংলাদেশের কৃষক। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে বাংলাদেশের মানুষের মুখে অন্ন জুগিয়ে যাচ্ছেন কোন প্রকার প্রতিদানের আশা না করেই। দ্বিতীয়ঃ বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প যেটা টিকে আছে তাদের শ্রমিকের ঘামের উপর। বছর বছর কারখানার মালিকের বাড়ি গাড়ির সংখ্যা বাড়তে থাকে কিন্তু শ্রমিকের ভাগ্যের চাকা আর ঘুরে না। তৃতীয়ঃ প্রবাসী বাংলাদেশিরা যারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তারা সারাদিন কাজ করে সেই টাকা জমিয়ে দেশে পাঠান আর সেই টাকায় বাংলাদেশের সরকারি লোকজন নতুন নতুন প্রবৃদ্ধির অংক কষেন। দুঃখের বিষয় এই তিন শ্রেণীর মানুষেরই বাংলাদেশে সামাজিক অবস্থান খুবই ভঙ্গুর। আমরা কথায় কথায় এক অপরকে খাটো করতে চাষা বলে গালি দিই, রাস্তায় হাঁটার সময় এমনভাবে গা বাঁচিয়ে চলি যেন গার্মেন্টস কর্মীরা কোন অচ্ছুৎ প্রাণীবিশেষ আর কথায় কথায় প্রবাসী মানুষগুলোকে আমরা ডিসি (ডিশ ক্লিনার), এসপি (সুইপার), ওসি (অনিয়ন কাটার) বলে সম্বোধন করি। তবে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহান প্রবাসীরা কারণ বাংলাদেশ এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন তাঁদের সাথে এমন ব্যবহার করেন যেন তাদের গা দিয়ে বিষ্ঠার গন্ধ আসছে। বিভিন্ন অজুহাতে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন। আবার নিয়মের সামান্য এদিক ওদিক হলেই কপালে জুটে লাথি, কিল এবং ঘুষি। অতি সম্প্রতি এক বড় সরকারি কর্মকর্তা তাদের নাম দিয়েছেন নবাবজাদা।

এইসব মানুষদের টাকাতেই সরকারি সকল শ্রেণীর মানুষের বেতন, ভোগ বিলাসিতা পালন হয় কিন্তু সেদিকে তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই বরং তারা আরো আরো টাকা আয়ের জন্য বেছে নেন দুর্নীতির রাস্তা। সেখানে প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেনের মত দু একজন যখন সততার সাথে দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেন তখন তাদেরকে মনেকরা হয় পথের কাঁটা। পুরো সিস্টেম তখন সেই কাঁটা উপড়ে ফেলতে লেগে যান যদিও দেলোয়ারের তাতে পিছপা হন না। তারা জীবন দিয়ে প্রমাণ করে যান যে বাংলাদেশের পুরো সমাজ ব্যবস্থা কতটা দূষিত আর আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুধু দুর্নীতি নিয়ে খিস্তি করেই দায়িত্ব শেষ করি। সময় এসেছে সবাই মিলে একবারে রুখে দাঁড়ানোর। ছেলেমেয়েরা তাদের বিলাসিতাকে সীমাবদ্ধ রাখেন এবং বাবা মায়ের আয়ের উৎস অনুসন্ধানা করেন। স্ত্রীরা নিজেদের গহনা, শাড়ি, বাড়ি, গাড়ি দিয়ে অন্যের চেয়ে শ্রেয়তর হওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসেন। সর্বস্তরে শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি ও সম্মান নিশ্চিত করেন। নিজের শিক্ষাটাকে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেন তাহলেই দেখবেন একদিন সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)