চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলায় চার কিলোমিটারের একটি কাঁচা রাস্তা পাকা করার মাত্র দুদিন পরেই তা ফাঁকা হয়ে গেল৷
এদিকে রূপপুর প্রকল্পে একটি বালিশ উত্তোলনের ব্যয় বিভিন্ন উন্নয়ন বরাদ্দের ভুয়া বিল ভাউচার ও লুন্টনকে দৃশ্যমান করে দিল৷ উন্নয়ন উন্নয়ন বলে যারা গলা ফাটাচ্ছেন উন্নয়নের আড়ালে এসব ভুয়ামোর কী ব্যাখ্যা দেবেন তারা?
চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার রাস্তাটি পাকা করার জন্য ঢালাই দেওয়া হলো ১৪ মে আর ১৬ মে গ্রামবাসী দেখলো পিচ ঢালাই রাস্তা কার্পেটের মতো উঠে যাচ্ছে। নির্মাণকাজে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার এর জন্য দায়ী নয় কি?
এতবড় অনিয়মটা হয়ে গেল স্থানীয় প্রশাসন তা বুঝলোনা ব্যাপারটা কি তাই? না বুঝেও লুণ্ঠনের ভাগিদার হওয়ার ঘটনা? এর আসল তত্ত্ব বের করবে কে?
কচুয়া-কাশিমপুর সড়কের মনপুরা গ্রামের ভেতরে চার কিলোমিটার রাস্তা পাকা করার টেন্ডার হয়েছিল ২০১৫ সালে। প্রায় তিন কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় এখানে়। রাস্তাটির কাজ ২০১৫ সালে শুরু হলেও দু’বছর ফেলে রাখা হয়। এরপর আবার কাজ শুরু হলে ২০১৯ সালের মে মাসে তা শেষ হয়।
প্রায় দুই বছর রাস্তার কাজ সম্পন্ন না করে ফেলে রেখে দেয়ায় পথচারীদের ঘটে চরম দুর্ভোগ৷ কেন বরাদ্দ দেয়ার পরেও তা ২ বছর ফেলে রাখা হল এর কারণ কি? প্রকল্পটিতে কত টাকার কাজ হল ও কতটাকা লুট হল দেশবাসী তা জানতে চায়। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ-গাগলাজুর সড়কে ১৬ কিলোমিটার জিসি রাস্তা, যা তেতুলিয়া-গাগলাজুর পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার।
এখানেও প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে জিসি উন্নয়ন প্রকল্পে রাস্তাটির সংস্কার কাজ গত বছর শুরু হয়। কাজ সমাপ্তির একমাস যেতে না যেতেই চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়ল সড়কটি? এখানে কত টাকার কাজ হল ও কত টাকা লুট হল তা বের করবে কে?
সড়কটির বিভিন্ন অংশ ভেঙে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় খানাখন্দের। মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে সড়কটি। এখানের সাড়ে তিন কোটি টাকার হিসেব কি পাবে মানুষ? নাকি তা বের না করে আরও নতুন বরাদ্দ দেবে?
মোহন গঞ্জের চরহাইজদা বাঁধে কৃষককে ইস্যু করে প্রতিবছর বাঁধের কাজে বরাদ্দের পর বরাদ্দ আসে আর হরিলুট হয়৷ একবরাদ্দ লুণ্ঠন হলে দেয়া হয় আবার নতুন বরাদ্দ। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের চরহাইজদা বাঁধে এ পর্যন্ত কত টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে আর কত টাকা লুন্ঠিত হয়েছে দেশবাসীকে কি জানাবে কেউ?লুণ্ঠিত অর্থ উদ্ধার করবে কি কেউ?
চরহাইজদা ফসল রক্ষা বাঁধটি সংবাদ পত্রে বারবার শিরোনাম হয়েছে৷ ৭ এপ্রিল/২০১০ তারিখের দৈনিক জনতা শিরোনাম করেছিলঃ মোহনগঞ্জের হাইজদা বাঁধ রক্ষায় শতসহস্র কৃষক/৩৫ ফাটল বন্ধে ২২ লাখের কাজ ৩ লাখ সাবকন্ট্রাক্ট/জনরোষে পালিয়েছে তারা৷
একই দিনে দৈনিক সংবাদ লিখেছিল লরি উল্টে ৪০ জন স্বেচ্ছাশ্রমিক আহত/যাদের মধ্যে ৭ জনকে আশংকাজনক অবস্থায় ময়মনসিংহ হাসপাতালে প্রেরণ। ৮ এপ্রিল,২০১০ দৈনিক জনকন্ঠ লিখেছিলঃ জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে এ পর্যন্ত ৫২ মেঃ টন চাউল ৯৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। লুণ্ঠিত বরাদ্দ উদ্ধার না করে এভাবে নতুন নতুন বরাদ্দ দেয়া আর কতদিন? এগুলোতে কি আরো লুণ্ঠনের সুযোগ হচ্ছেনা? দেশের অন্যতম মেগা প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে কী ঘটলো? এর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসবাসের জন্য নির্মিত গ্রিনসিটিতে আসবাবপত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র ক্রয়ে লাগামছাড়া দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হল।
এখানে একটি বালিশের ব্যয় দেখানো হল ৬ হাজার ৭১৭ টাকা। এর মধ্যে এর দাম বাবদ ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা আর সেই বালিশ নিচ থেকে ফ্ল্যাটে ওঠানোর খরচ ৭৬০ টাকা উল্লেখ করা হল৷ শুধু আসবাবপত্র কেনা ও ফ্ল্যাটে ওঠাতে ব্যয় হয়েছে ২৫ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ২৯২ টাকা।ব্যয় করা এই টাকা জনতার। বাংলাদেশের কয়জন মানুষ এমন বালিশ ব্যবহার করে?
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে কর্মরতদের ফ্ল্যাটের জন্য বিভিন্ন জিনিসপত্র ক্রয় করেছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের পাবনা পূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা। প্রতিটি বিছানা কেনায় ব্যয় দেখানো হয়েছে ৫৯৮৬ টাকা। আর ফ্ল্যাটে ওঠানোর ব্যয় দেখানো হয়েছে ৯৩১ টাকা।
চাদর ও বালিশ কেনা হয়েছে ৩৩০টি করে। প্রতিটি খাট কেনায় খরচ হয়েছে ৪৩৩৫৭ টাকা। আর ওঠানোর ব্যয় ১০৭৭৩ টাকা। সর্বমোট খাট কেনা হয়েছে ১১০টি। একটি বৈদ্যুতিক চুলা কেনার খরচ পড়েছে ৭৭৪৭ টাকা। আর ওই চুলা ওঠাতে ব্যয় হয়েছে ৬৬৫০ টাকা। প্রতিটি বৈদ্যুতিক কেটলি কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ৫৩১৩ টাকা।আর ওঠানোর খরচ ২৯৪৫ টাকা।
রুম পরিষ্কারের একটি মেশিন কিনতে খরচ দেখিয়েছে ১২০১৮ টাকা। আর ওঠানোর খরচ দেখিয়েছে ৬৬৫০ টাকা। প্রতিটি ইলেকট্রিক আয়রন কিনতে খরচ পড়েছে ৪১৫৪ টাকা। আর ওঠানোর খরচ ২৯৪৫ টাকা। টেলিভিশন প্রতিটির দাম ৮৬৯৬০ টাকা।
আর ওঠানোর খরচ ৭৬৩৮ টাকা। টেলিভিশন কেনা হয়েছে ১১০টি। সেগুলো রাখার জন্য আবার কেবিনেট করা হয়েছে ৫২ হাজার ৩৭৮ টাকা করে। ফ্রিজের দাম দেখানো হয়েছে প্রতিটি ৯৪২৫০ টাকা। আর ওঠাতে খরচ পড়েছে ১২৫২১ টাকা। ওয়ারড্রোব প্রতিটি কেনায় খরচ দেখানো হয়েছে ৫৯৮৫৮ টাকা। ওঠানোর খরচ পড়েছে ১৭৪৯৯ টাকা।
মাইক্রোওয়েভ প্রতিটি কেনায় ব্যয় ৩৮২৭৪ টাকা। খরচ হয়েছে ৬৮৪০ টাকা। প্রতিটি সোফা কেনা হয়েছে ৭৪ হাজার ৫০৯ টাকায়, ভবনে ওঠাতে খরচ হয়েছে ২৪ হাজার ২৪৪ টাকা করে। ১৪ হাজার ৫৬১ টাকা করে কেনা সেন্টার টেবিলের প্রত্যেকটি ভবনে তুলতে লেগেছে ২ হাজার ৪৮৯ টাকা। ছয়টি চেয়ারসহ ডাইনিং টেবিলের প্রতিটি সেট কেনা হয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ৬৭৪ টাকায়। ভবনে তুলতে লেগেছে ২১ হাজার ৩৭৫ টাকা করে।
এ ছাড়াও প্রকল্পের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সব পদেই অস্বাভাবিক বেতন-ভাতা নির্ধারন করা হয়েছে। এ প্রকল্পের প্রকল্প-পরিচালকের বেতন ধরা হয়েছে চার লাখ ৯৬ হাজার টাকা। পাশাপাশি প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করবেন, এজন্য আরও দুই লাখ টাকা পাবেন। সব মিলিয়ে প্রকল্প পরিচালক পাবেন ছয় লাখ ৯৬ হাজার টাকা।
এ ছাড়া গাড়ি চালকের বেতন ধরা হয়েছে ৭৩ হাজার ৭০৮ টাকা, রাঁধুনি আর মালির বেতন ৬৩ হাজার ৭০৮ টাকা৷ এই বেতনটা কে ঠিক করে দিল?এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রীর ব্যাখ্যা কী?জনতার অর্থ নিয়ে এমন যাচ্ছেতাই করার অধিকার তাদের কে দিয়েছে?
এই মহা অনিয়মের বিচার হবে কি? না তা ঢাকতে আরও নতুন বরাদ্দ দেয়া হবে? অনিয়মকারীরা কোন অনিয়মের বিচার হয়না বলেই এমন বেপরোয়া হয়ে উঠছেন৷ জনগণকে তারা ভেবে চলেছেন বোকা৷ রূপপুর পারমাণিক প্রকল্পের এই ভুয়া বিল ভাউচারকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই ও লুণ্ঠিত বরাদ্দ উদ্ধার চাই৷
প্রয়োজনে দায়ীদের সম্পত্তি নিলামে বেচে তা আদায় করা হোক। জনতার দাবী উন্নয়ন বরাদ্দের লুণ্ঠিত অর্থ উদ্ধার নতুন বরাদ্দ দিয়ে আরও নতুন লুণ্ঠনের সুযোগ নয়৷ কারণ এটা একটি দেশ। কোন মগের মুল্লুক নয়৷ তাই সকল উন্নয়ন বরাদ্ধের লুণ্ঠিত অর্থ উদ্ধার হোক৷
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)