বার্সেলোনার বিমানবন্দর থেকে সপরিবারে ব্যক্তিগত বিমানে ওঠা। বিমানে বসে স্ত্রী আন্তোনেল্লা রোকুজ্জোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাস্যোজ্জ্বল ফ্রান্স যাত্রার পোস্ট। একই সময়ে বন্ধু নেইমারের উল্লাসমাখা আমন্ত্রণ পোস্ট। প্যারিসে পৌঁছে লাল গালিচা অভ্যর্থনা। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে মেসির প্রতিটি গন্তব্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষারত সমর্থকদের উচ্ছ্বাস-উল্লাস। এরমাঝেই পিএসজির পক্ষ থেকে কিংবদন্তিকে বরণ করে নেয়ার একটি স্বাগতম ভিডিও।
এইসব ডামাডোল চলতে থাকার কয়েকঘণ্টা আগেই বার্সেলোনায় দাঁড়িয়ে ভারাক্রান্ত আর শ্লেষমাখা কণ্ঠে মেসির বাবা ও এজেন্ট হোর্হে মেসির উচ্চারণ, হ্যাঁ, আজই পিএসজিতে সই করতে চলেছেন মেসি। তাতে চাউর হওয়া খবরটা নিশ্চিত হয়ে যায় ততক্ষণে।
আসলে মেসি যে পিএসজিতে খেলতে যাচ্ছেন সেটা অনেকটা ঠিক হয়ে যায় গত সপ্তাহে বার্সা তাকে নতুন চুক্তি না দেয়ার পরপরই। কিন্তু সেই যাওয়াটা কবে, কীভাবে সম্পন্ন হবে, সেটা নিয়ে আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। মঙ্গলবার যার সবটুকুর দেখা মিলেছে। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনও আসেনি। তাতে কীইবা আসে-যায় আর! মেসি তো পিএসজির হয়েই গেছেন। যেখানে ৩৫ মিলিয়ন ইউরো বেতন পাবেন প্রতিবছরে।
আর্জেন্টাইন মহাতারকা মেসিকে আসছে দুই মৌসুমে পিএসজির জার্সিতে খেলতে দেখার প্রস্তুতি এখন নেয়াই যায়। দুপক্ষ চাইলে সেটি আরও একবছর বাড়ানো সম্ভব। ফ্রেঞ্চ লিগ ওয়ান জায়ান্ট ক্লাবটির সঙ্গে এমন চুক্তিতে বসেছেন বার্সেলোনায় সাবেক হয়ে যাওয়া এলএম টেন।
ফরাসি সংবাদমাধ্যম লে’কিপে ও স্প্যানিশ পত্রিকা মার্কা মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বিকেলেই খবরটি চাউর করে দেয়। জানিয়ে দেয়, দুই বছরের চুক্তির সমঝোতা হয়ে গেছে মেসি ও পিএসজির। তৃতীয় বছরে চুক্তি বর্ধিত হতে পারে দুপক্ষের মধ্যে আলোচনায়। কয়েকঘণ্টার মধ্যেই প্যারিসে পৌঁছে নতুন ক্লাবের মেডিকেল পরীক্ষার মুখোমুখি হবেন মেসি। সারবেন চুক্তিতে কলম চালানোর সব আনুষ্ঠানিকতাও।
ক্লাব পিএসজি বা মেসির দিক থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি বা দৃশ্যমান প্রকাশ তখনও মেলেনি। তবে ফুটবলের নির্ভরযোগ্য সংবাদ দিতে ওস্তাদ পত্রিকা দুটি নিশ্চিত করে বলে দেয়, সমঝোতা ও চুক্তির ব্যাপারে সব অগ্রগতি সাফল্যবিন্দুতে এসে ঠেকেছে।
হাঁড়ির খবর দিতে ওস্তাদ ক্রীড়া সাংবাদিক ফ্যাব্রিজিও রোমানো টুইট করেন বাংলাদেশ সময় বিকাল সোয়া ৫টায়, জানিয়ে দেন লিও মেসি মাত্রই বার্সেলোনা বিমানবন্দরে পা রেখেছেন। খানিক বাদে আবারও টুইট তার, প্যারিসগামী বিমানে বসেছেন মেসি। সঙ্গে আছেন বাবা ও এজেন্ট হোর্হে মেসিও।
প্যারিস পৌঁছে অপেক্ষমাণ সমর্থকদের ‘মেসি, মেসি’ ধ্বনির সামনে অনেকটা নির্ভরতার ছোঁয়া মাখানো ঢংয়ে হাত নেড়ে জবাব দেন মেসিও। এসময় তার পরনে ছিল সাদা টি-শার্ট, যাতে ‘দিস ইজ প্যারিস’ লেখা, যা পিএসজির স্লোগানও।
এতক্ষণে মেসির মেডিকেল হয়ে যাওয়ার কথা। বুধবার তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হবে পিএসজির একজন হিসেবে। হবে আনুষ্ঠানিক প্রেস মিটও। সেজন্য বুধবার বিকেল ৩টায় চোখ রাখতে হবে পিএসজির মিলনকক্ষে।
তার আগেই যদিও পিএসজি তাদের ড্রেসিংরুমের ছবি যোগ করেছে মেসিকে স্বাগতম জানানো ভিডিওতে। যেখানে নেইমার ও এমবাপের মাঝের একটি লকার ফাঁকা। বুঝতে বাকি থাকে না কার জন্য। পিএসজির ভাষায় যেটি- নিউ ডায়মন্ড ইন প্যারিস।
সঙ্গে আইফেল টাওয়ারের সামনে মেসির ছয় ব্যালন ডি’অরের ছবি তো আছেই। ঐতিহাসিক দর্শনীয় জায়গাটিতেই মেসিকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কথা। যেখানে আনুষ্ঠানিকতা সারা হয়েছিল নেইমারেরও।
সামনে ৩৪ বছরের মেসিকে যে বার্সার জার্সিতে দেখা যাবে না সেটির ষোলোকলা পূর্ণ হয়ে যায় গত সপ্তাহে। ক্লাব ও ফুটবল ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা খেলোয়াড়টিকে ন্যু ক্যাম্পে ধরে রাখতে পারেনি কাতালানরা।
ক্লাব সভাপতি লাপোর্তা জানিয়েছেন, বার্সা ও লিও মেসির মধ্যে সমঝোতা হয়েছিল, দুপক্ষ চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মত ছিল, কিন্তু শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও লা লিগার আর্থিক নিয়ম-কাঠামোর কারণে চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা সম্ভব হল না।
সেটি বৃহস্পতিবারের ঘটনা। রোববার মেসিও বিদায়ী সংবাদ সম্মেলন সেরে ফেলেন বার্সেলোনায়। যার মাধ্যমে ন্যু ক্যাম্পে ২১ বছরের পথচলার ইতি নিশ্চিত হয়ে যায় তার।
১৩ বছর বয়সে ন্যু ক্যাম্পে এসেছিলেন মেসি। যুব দল ঘুরে দ্রুতই মূল দলের প্রাণভোমড়া হয়ে ওঠেন। এনেছেন অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত ও অবিশ্বাস্য সব সাফল্য। বার্সার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি, রেকর্ড ৩৫ শিরোপা জিতেছেন। হয়েছেন রেকর্ড গোলদাতা। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৭৭৮ ম্যাচে ৬৭২ গোল রেখে গেলেন বার্সার অনার্স বোর্ডে।
গত ৩০ জুন বার্সেলোনার সঙ্গে মেসির চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর ফ্রি-এজেন্ট হয়ে যান এলএম টেন। সেসময় দেশের জার্সিতে কোপা আমেরিকা খেলায় ব্যস্ত ছিলেন। আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম কোনো ট্রফি, মানে এবারের কোপা জিতে পরিবার নিয়ে ছুটি কাটাতে বেড়িয়ে পড়েন মেসি।
জলে-জঙ্গলে আনন্দঘন সময় কাটিয়ে মেসি বার্সেলোনায় ফিরেছিলেন পাঁচ বছরের নতুন চুক্তি করতে। নতুন চুক্তিতে বসতে বেতনের ৫০ শতাংশ কমিয়ে নিতে রাজি হয়েছিলেন। এরপরও ক্লাব তাকে চুক্তি দিতে পারেনি। বলে দিয়েছে, লা লিগার ঠিক করে দেয়া বেতনসীমার মধ্যে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারছে না বার্সা। শেষে চোখের জলে বিদায় বলে গেলেন মেসি।