চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

পোস্টারে চলচ্চিত্রের ইতিহাস

চলচ্চিত্রের ইতিহাস সংরক্ষিত হয়েছে নানাভাবেই। ১৯৫৬ সালে আগে বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার পর থেকে মূলত চলচ্চিত্রের  ইতিহাস গণনা শুরু হয়। নানাভাবে এই ইতিহাস লেখা হলেও ইতিপূর্বে  পোস্টারে চলচ্চিত্রের ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি। বাংলাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যতগুলো ছবি মুক্তি পেয়েছে, তা যদি দশক অনুসারে ভাগ করে তুলে ধরা যায়, তবে সহজেই পোস্টারে চলচ্চিত্রের শিঁকড় খুজে পাওয়া যাবে। তেমনি উল্লেখযোগ্য কিছু চলচ্চিত্রের পোস্টার ও তার ইতিহাস তুলে ধরা হলো।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বলতে পূর্ব পাকিস্তান (১৯৪৭- ১৯৭১) এবং ১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে বোঝায়।

চলচ্চিত্রের উৎপত্তি গত শতকের ১০-এর দশকে হলেও এখানে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহের সৃষ্টি হয় ৫০-এর দশকে। এখানকার সাংস্কৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খেতে চলচ্চিত্রের প্রায় ৫০ বছর । ৯০-এর দশকে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৮০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুক্তি পায়।

১৯৫৪ সালে ইকবাল ফিল্মসের ব্যানারে এই ভূখন্ডের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’-এর কাজ শুরু করেন আবদুল জব্বার খান। ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট আবদুল জব্বার খান পরিচালিত বাংলাদেশের প্রথম সবাক বাংলা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পায়। পরিচালক নিজেই নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন। নায়িকা চরিত্রে ছিলেন চট্টগ্রামের পূর্ণিমা সেন। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন ইনাম আহমেদ, নাজমা (পিয়ারী), জহরত আরা, আলী মনসুর, রফিক, নুরুল আনাম খান, সাইফুদ্দীন, বিলকিস বারী প্রমুখ। চিত্রগ্রাহক কিউ.এম জামান, সুরকার সমর দাস, কণ্ঠশিল্পী আবদুল আলীম ও মাহবুবা হাসানাত এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

১৯৫৯ সালে ফতেহ লোহানীর ‘আকাশ আর মাটি’, ‘মহিউদ্দিনের মাটির পাহাড়, এহতেশামের এদেশ তোমার আমার এই তিনটি বাংলা চলচ্চিত্র ছাড়াও এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ উর্দু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।

ষাটের দশকে বেবী ইসলামের ‘তানহা’ও উর্দু ভাষার নির্মিত ছবি। এটি ১৯৬০ সালে সেন্সর সার্টিফিকেট পায় কিন্তু মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালে।

‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ছবির পোস্টার
‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবির পোস্টার
‘ওরা ১১ জন’ ছবির পোস্টার
সারেং বউ’ ছবির পোস্টার

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত সত্তরের দশক শুরুর প্রথম ছবি ‘জীবন থেকে নেয়া’। আমজাদ হোসেনের চিত্রনাট্যে ও জহির রায়হান পরিচালনায় এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন খান আতাউর রহমান, রওশন জামিল, শওকত আকবর, রাজ্জাক, রোজি আফসারী, সুচন্দা, আমজাদ হোসেন প্রমূখ। ১৭৭২ সালের ছবি ‘ওরা ১১ জন’। চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালনায় এই ছবিতে অভিনয় করেন খসরু, রাজ্জাক, শাবানা, সৈয়দ হাসান ইমাম, আলতাফ, মুরাদ, নান্টু, বেবী, আবু প্রমূখ। কালজয়ী ত্রিভুজ প্রেমের ছবি ‘অবুঝ মন’। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন রাজ্জাক, শাবানা, সুজাতা, শওকত আকবর, খান জয়নুল , হাসমত প্রমুখ। পরিচালনায় কাজী জহির। সঙ্গীত পরিচালনায় শহীদ আলতাফ মাহমুদ এবং চিত্রগ্রহণে আব্দুল লতিফ বাচ্চু।

ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনার একটি অসাধারণ বাণিজ্যিক ছবি এহতেশাম পরিচালিত ‘দূরদেশ’। ছবিতে অভিনয় করেছেন নাদিম, শর্মীলা ঠাকুর, ববিতা প্রমূখ।

ওয়াসিম, ববিতা , জাভেদ , সুচরিতা ও মিজু আহমেদ এর একটি দুর্দান্ত ছবি ছিল ‘নিশান’।

নন্দিত সাহিত্যিক শহীদ শহিদুল্লাহ কায়সারের একটি উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন ‘সারেং বউ’। পরিচালনা করেছেন আবদুল্লাহ আল মামুন। অভিনয়ে ফারুক , কবরী, গোলাম মোস্তফা, আরিফুল হক, নার্গিস , বাবর, দারাশিকো ও শিশুশিল্পী অনু প্রমূখ। চিত্রগ্রহণ করেছেন রফিকুল বারী।

কবির আনোয়ারের পরিচালনায় ‘সুপ্রভাত’ ছবিটি দারুণ জনপ্রিয় হয়।

দেওয়ান নজরুলের একটি সুপারহিট অ্যাকশন ছবি ‘দোস্ত দুশমন’। যা ছিল হিন্দি ‘শোলে’র রিমেক। এই ছবিতে জসীম খলনায়ক হিসেবে দুর্দান্ত অভিনয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন ।

পরিচালক শিবলি সাদিকের প্রথম পরিচালিত ছবি ছিল ‘নোলক’। এই ছবিটির সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন ফেরদৌসী রহমান। ১৯৮৯ সালে মুক্তি পায় কাজী হায়াতের প্রথম ছবি ‘দি ফাদার’।

১৯৮০ সালে চলচ্চিত্রের সফল ও নান্দনিক ছবি ‘ছুটির ঘণ্টা’। পরিচালক আজিজুর রহমানের একটি কালজয়ী সিনেমা।

‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’
‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবির পোস্টার
‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ ছবির পোস্টার

প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’। বাদল রহমানের পরিচালনায় এ ছবিতে অভিনয় করেছেন মা. পার্থ, মুস্তাফা, এটিএম শাসুজ্জামান, শর্মিলী আহমেদ, মা. শিপলু, সারা যাকের প্রমূখ।

আশির দশকে মুক্তিপ্রাপ্ত বাণিজ্যিক ছবিগুলোর মাঝে একটি অসাধারন ছবির নাম ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ ছবিটি। আমজাদ হোসেনের কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ, গীত ও পরিচালনায় এবং আলাউদ্দিন আলীর সংগীত পরিচালনায় অসাধারন সব গানের ছবি ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’। রফিকুল বারীর চিত্রগ্রহণে এতে অভিনয় করেছেন বুলবুল আহমেদ , ববিতা, আশীষ কুমার লৌহ, আনোয়ারা ও মাস্টার শহীদ প্রমূখ।

সামাজিক অ্যাকশন ছবির নাম ‘জীবন নৌকা’। ছবির প্রযোজক, পরিচালক ও মূখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন মাসুদ পারভেজ নিজেই অর্থাৎ সোহেল রানা। সবগুলো গানের সুর করেছিলেন আলম খান।

শরৎচন্দ্রের কালজয়ী উপন্যাস ‘দেবদাস’ নিয়ে বাংলাদেশে প্রথম ছবি নির্মাণ করেন চাষী নজরুল ইসলাম। ছবিতে অভিনয় করেছেন বুলবুল আহমেদ, কবরীসহ আরও অনেকে।

রমলা সাহা প্রযোজিত ও বানীচিত্রের পরিবেশনায় ছবি ‘পুরস্কার’ । এটি পরিচালনা করেছেন সি বি জামান। সংগীত পরিচালনায় ছিলেন সত্য সাহা।

সামাজিক অ্যাকশন ছবির জনপ্রিয় পরিচালক মমতাজ আলী পরিচালিত সুপারহিট ছবি ‘নসীব’। ছবিতে অভিনয় করেন উজ্জ্বল, শাবানা, ইলিয়াস কাঞ্চন, রোজিনা , টেলিসামাদ, দারাশিকো প্রমুখ। এই ছবির সংগীত পরিচালনায় ছিলেন আলাউদ্দিন আলী। ছবিটির পরিবেশনায় ছিল অ্যাঞ্জেল ফিল্মস ।

‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ ছবির পোস্টার
‘নসীব’ ছবির পোস্টার

বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ব্যবসা সফল ছবি ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’। তোজাম্মেল হক বকুলের প্রথম পরিচালিত ছবি ছিল এটি । শুধু কলকাতার একটি প্রেক্ষাগৃহে চলেছিল টানা ৫২ সপ্তাহ যা বাংলা চলচ্চিত্রের একটি বিরল রেকর্ড । ছবিতে প্রধান দুই ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ইলিয়াস কাঞ্চণ ও অঞ্জু ঘোষ।

নব্বই দশকে  ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিটি দেশীয় চলচ্চিত্রে সুপারহিট ছবির তালিকায় স্থান পায়। কাজী হায়াতের নির্মাণে অন্যতম ছবি ‘দাঙ্গা’। এতে অভিনয় করেছেন মান্না, সুচরিতা, রাজিব প্রমূখ।

বিংশ শতাব্দির শুরুতে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ছবি ‘মাটির ময়না’। তারেক মাসুদের এ ছবিটি তার একটি অনবদ্য নির্মাণ। এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে বেশ কয়েকটি ছবির পুরস্কার অর্জন করেছে। বিশেষ করে বিশ্বের মর্যাদাশীল পুরস্কার আসর কান চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা ছবির পুরস্কার জিতেছে।

লালন ফকিরকে নিয়ে গুণী নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেলের ‘লালন’ (২০০৪) প্রশংসা পেয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়।

মোরশেদুল ইসলামের ‘দুখাই’, ‘লালসালু’, আখতারুজ্জামানের  ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ বাংলা চলচ্চিত্রের প্রশংসিত ছবি।

গিয়াস উদ্দিন সেলিমের পরিচালনায় ‘মনপুরা’ ছবিটি চলচ্চিত্রের সফলতার অন্যতম একটি মাইল ফলক। এতে অভিনয় করেছেন ফারহানা মিলি, চঞ্চল চৌধুরী, মামুনুর রশীদ, শিমুল প্রমূখ।

হুমাযূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’, আবু সাইয়্যিদের ‘নিরন্তর এবং গোলাম রাব্বানী বিপ্লবের ‘স্বপ্নডানায়’ ছবিগুলোর প্রশংসিত হয়েছে।

‘মাটির ময়না’ ছবির পোস্টার
‘মনপুরা’ ছবির পোস্টার
‘গেরিলা’ ছবির পোস্টার

একবিংশ শতাব্দির শুরুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত বাংলাদেশি ছবির মধ্যে রয়েছে নাসিরউদ্দিন ইউসুফের ‘গেরিলা’। ফেরদৌস, জয়া আহসান, শম্পা রেজা, শতাব্দী ওয়াদুদসহ আরো অনেকেই এ ছবিতে অভিনয় করেছেন। এই দশকের এখন পর্যন্ত আলোচিত ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘টেলিভিশন’, অমিত আশরাফের ‘উধাও’ ও রুবাইয়াত হোসেনের ‘মেহেরজান’ ও ফাখরুল আরেফিন খানের ‘ভুবন মাঝি’।

তবে সবচেয়ে ব্যবসায় সফল ছবি হিসেবে এ দশকের সবচেয়ে আলোচিত ছবি হচ্ছে অমিতাভ রেজা পরিচালিত ‘আয়নারবাজী’ ছবিটি। এটি একই দশকের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবিও।

বাংলা চলচ্চিত্রের এই ক্রমধারায় এখন পর্যন্ত সর্বশেষ ছবি হিসেবে মুক্তি পেয়েছে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ছবি ‘হঠাৎ দেখা’। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার এ ছবিটি পরিচালনা করেছেন রেশমী মিত্র (ভারত) এবং সাহাদাত হোসেন (বাংলাদেশ)। এ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের শিল্পী ইলিয়াস কাঞ্চন, সুমাইয়া জান্নাতুল হিমি, মুনিরা ইউসুফ মেমি, ওয়াসেক ইমাদ, মনি তালুকদার ও মোহাম্মদ রাজিউল ইসলাম খান এবং ভারতের শিল্পীদের মধ্যে অভিনয় করেছেন দেবশ্রী  রায়, দ্বীপ ভট্টাচার্য, কার্ত্তিক দাস বাউল, শঙ্কর চক্রবর্তী, তুলিকা বসু ও সাধন বাগচি। ৩১ মার্চ ছবিটি সারাদেশে মুক্তি পায়।

ছবি : সংগৃহীত