চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

পৃথিবীর সব মহাকাব্যই কবিতায় বলা একেকটা দীর্ঘ-বিশাল গল্প: মুক্তাদির

বইমেলা ২০১৯ এ ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদিরের লেখা গল্পের বই ‘বছরের দীর্ঘতম রাত’

গল্প দিয়েই লেখালেখির শুরু আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদিরের। ‘বছরের দীর্ঘতম রাত’ তার প্রথম গল্পের বই। যদিও প্রথম বই কবিতার, ‘অন্য গাঙের গান, সমুদ্রসমান’। গল্পেও কাব্যিক ঘোর তৈরি করেন তিনি। গল্পের ব্যাপ্তি ছোট, নিরীক্ষাপ্রবণ। তার চরিত্ররা বিচিত্র। কখনও গাছ কিংবা মৃত মানুষের আত্মা অথবা আকাশ থেকে নেমে আসা পরী। ইংরেজি শব্দ বা বাক্যের স্মার্ট ব্যবহার চোখে পড়ে তার লেখায়। পাঠকের চোখে পড়বে মিউজিক নিয়ে লেখকের আগ্রহটাও।

আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদিরের জন্ম সিরাজগঞ্জে। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই বিষয়ে পড়ান জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখক তার কবিতা, গল্প, গল্পের ভাষা, তার নিরীক্ষা প্রবণতা, লেখালেখি নিয়ে পরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেছেন চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে:

কেমন আছেন?
এইতো ভালো।

‘বছরের দীর্ঘতম রাত’ আপনার প্রথম গল্পের বই। বইটা নিয়ে বলেন।

বইটা আরও আগেই আসতে পারত। বেশিরভাগ গল্পই দুই হাজার ষোল সনের আগে লেখা। আমি আসলে কনফিউজড ছিলাম আদৌ আমার গল্পের বই করা উচিত কিনা! যখন সিদ্ধান্ত নিলাম করেই দেখি কী হয়, তখন দেখি সব গল্প আমার সংগ্রহে নাই। পুরনো পত্রিকা, বিভিন্ন ওয়েবসাইট, নিজের মেইল- ইত্যাদি জায়গা থেকে উদ্ধার করে শেষমেশ গোটা তিরিশেক গল্প একসাথে করে আমার দুইজন কলিগ, যারা অলরেডি কথাসাহিত্যিক হিসেবে বেশ পরিচিত, উম্মে ফারহানা আর মেহেদী উল্লাহকে পড়তে দিলাম। সত্যি কথা বলতে এই দুইজনের দেয়া সাহসেই অবশেষে বইটি করা। আর ঐতিহ্যের নাঈম ভাইয়ের প্রতি আমি খুব কৃতজ্ঞ। এই রকম দায়িত্বশীল প্রকাশক পাওয়া আমাদের মতন নতুন লেখকদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

পাঁচ ফর্মার বইয়ে ২১ টা গল্প। গল্পগুলো আকারে ছোটই বলা যায়। কেন?
সর্বমোট তিরিশ পয়ত্রিশটা গল্প লিখেছি আমি দুই হাজার দশ থেকে এখন পর্যন্ত। প্রথম পাণ্ডুলিপিতে সবগুলো গল্পই ছিল। বেশিরভাগই আকারে ছোট। পরে ইচ্ছা করেই নিজের কম পছন্দের গল্পগুলো বাদ দিয়েছি। আমার মনে হয়েছে বইয়ের আকার যাই হোক, নিজের অপছন্দ বা কম পছন্দের লেখাগুলোক রাখতে চাইনা।

গল্পগুলো ছোট হওয়ার একাধিক কারণ থাকতে পারে, সবগুলোর ব্যাপারে আমি সচেতন না। একটা কারণ- গল্পগুলো আসলে অনেক বেশি অনুভূতিপ্রবণ। ঘটনার চেয়ে অনুভূতি ঘটে যাওয়ার প্রকাশ বেশি। কবিতায় যেমন হয়- অল্প কথায় ঘন, গাঢ়, অনেক সময় বিশাল বিশাল অনুভবের প্রকাশ পায়। আরেকটা কারণ হতে পারে এই বইয়ের লেখাগুলো হয়তো আকারে-প্র্রকারে পরিপূর্ণ গল্প হয়ে ওঠেনি বা হতে চায়নি।

আপনার গল্পগুলো ঠিক ট্র্যাডিশনাল গল্প না। আখ্যান ধর্মী। লেখক হিসেবে আপনি কেন এমন গল্প লেখতে গেলেন? পাঠকের জন্য কোন চাপ তৈরি করবে না?
গল্পগুলো পড়ে অনেকেই বলছেন ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে লেখা’, ‘প্রচলিত ধারা থেকে আলাদা’ বা ‘এই যুগের সাথে ঠিক যায় না’ ইত্যাদি। কিন্তু আমি আসলে এক্সপেরিমেন্ট করতে চাইনি। লেখালেখিতে আখ্যানধর্মিতা আমার পছন্দ। গল্পগুলোকে সবাই আখ্যানধর্মী বললেই বরং ভালো লাগত। কিন্তু ঠিক কী কারণে এই রকম , অন্য ধারার গল্প লিখলাম আমি বলতে পারব না। খুব বেশি সচেতন ভাবে করিনি। পাঠকের জন্যে এটা হয়তো একটা চাপ তৈরী করে, অপরিচিত একটা জগত, ভাষার ভিন্নতা – হয়তো তাদের দূরে ঠেলে দেয়। কিন্তু আমি এভাবেই সাবলীল।

এই ক্ষেত্রে দুইজন লেখকের স্টাইল দ্বারা আমি প্রচণ্ড অনুপ্রাণিত বা প্রভাবিত হয়েছি- একজন অস্কার ওয়াইল্ড, আরেকজন অরুন্ধতী রায়। তাদের গল্প বলার যে কাব্যিক ধাঁচ, এটার প্রচণ্ড প্রভাব পড়েছে আমার লেখায়। অস্কার ওয়াইল্ড রূপকথার আদলে কিছু গল্প লিখেছিলেন কবিতার ঢঙে। আর অরুন্ধতী রায়কে আমার বরাবরই প্রচণ্ড ঘোরলাগা কবি মনে হয়।

আপনার কবিতার বইয়ে , আমার মনে হয়েছে, আপনি অনেক ন্যারেটিভ। কবিতায় গল্প বলার চেষ্টা আছে। কিন্তু আপনার গল্প পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে আপনার গল্পের ভাষা অনেক বেশি কবিতাধর্মী । এইটা কি আমার বিভ্রম, নাকি এমনটাই? সচেতন ভাবেই করেছেন? কেন?
ওই যে বললাম ঘোরের কথা। কোন অনুভূতি বা ঘটনার প্রকাশের সময় আমি কেমন জানি একটা ঘোরে থাকি, এক ধরণের ফ্যান্টাসি বলতে পারেন। এইটা আমার চরিত্রগত দুর্বলতা। বন্ধুবান্ধব বিরক্ত হয় খুব। লেখার সময়ও আমি এর বাইরে আসতে পারিনা। আর গদ্য থেকে পদ্যকে আমার খুব দূরের কিছু মনে হয়না। কবিতায় গল্প আর গল্পে কবিতা চলে আসলে আমি বরং উপভোগ করি। ভালো লাগে লিখতে ও পড়তে। আর কবিতার ভাষায় গল্প বলা কিন্তু নতুন কিছু না। পৃথিবীর সব মহাকাব্যই আসলে কবিতায় বলা একেকটা দীর্ঘ-বিশাল গল্প।

প্রথম বই করলেন কবিতার। এবার গল্পের, উপন্যাস লিখছেন বলেই জানি। কথাসাহিত্যের দিকে ঘুরে গেলেন কি?
আমার শুরু কিন্তু গল্প দিয়েই, এটা অনেকেই জানে না। দুই হাজার দশে দৈনিক ‘সংবাদে’ আমার গল্প ছাপা হয় প্রথম, পরে কবিতা। যতদূর মনে পড়ে, ছোটবেলায়ও কবিতা লেখার আগেই আমি গল্প লিখেছিলাম। আর ঠিক ঘুরে যাওয়া বা দূরে বলা যাবে না। কারণ আপনিই এরই মধ্যে বলে দিয়েছেন– আমার গল্পে কবিতার দোষ বা গুণ রয়ে গেছে। উপন্যাসেও কবিতা থাকবে বলে আশা বা আশঙ্কা করছি।

আপনার বইয়ের একটা গল্প নিয়ে আমি ব্যক্তিগত আগ্রহবোধ করছি। ‘চাঁদ বহুকাল চাঁদ থাকার পর’ গল্পটা। একই নামে এইটি আপনার কবিতার বইয়ে আছে। আপনি কি কবিতা হিসেবে এইটা অস্বীকার করছেন? বা অন্য কিছু?
‘চাঁদ বহুকাল চাঁদ থাকার পর’, এই কবিতা বা গল্পটা নিয়ে আমি বরাবরই সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলাম। লেখার পরে একবার মনে হয়েছে কবিতা, আবার মনে হয়েছে গল্প। যারা পড়েছেন তাদের মতামতও মিশ্র- কেউ কবিতা ভেবে পড়েছেন, কেউ গল্প হিসেবে। আমার মনে হয়েছে এর পরিচয় দুইই হোক। কেবল কবিতার বইয়ে আটকে রাখলে এর সাথে অন্যায় করা হবে। তাই ইচ্ছা করেই গল্পের বইয়ে যোগ করা। কিন্তু এতে করে আশা রাখি এর আগের পরিচয় নাই হয়ে গেল না।

লেখার ক্ষেত্রে আপনার কাছে কোনটা বেশি গুরুত্ব পায়? ফর্ম কন্টেন্ট না অন্য কোন কিছু?
অন্য কিছু। আমার নিজের জগত। সেই জগতে সবাই আছে, সবকিছু আছে– কিন্তু আমার মতোন করে। সবার রং, রূপ, গন্ধ সেখানে অন্য রকম। যা দেখি, শুনি-আমি হুবুহ লিখতে পারি না। ফর্ম বা কন্টেন্ট নিয়ে আমি সচেতন থাকি কেবল কেবল সাহিত্য পড়ানোর সময়। পাঠক বা লেখক হিসেবে আমি ওইসব ভাবতে চাইনা। ভাবলেও দোষ নাই কোন। আমি আদতে একটু অলস, যেকোন ঘোরে ডুব দিয়ে থাকতে আরাম লাগে।

আপনার বইয়ে নিজের প্রিয় গল্প কোনটি? কেন?
এটা বলা মুশকিল। আমি পক্ষপাতিত্ব করতে চাইনা। তারা সবাই সমান। তবে কোনটা লিখতে পেরে বেশি নির্ভার লেগেছে বলতে পারি। ‘দেশ আমাদের বিষাদ জনক, এই দেশ আমাদের বিষণ্ণ মাতা’ গল্পটা লেখার আগ পর্যন্ত আমি অদ্ভুত একটা অস্থিরতার মধ্যে ছিলাম। দেশে একের পর এক মন খারাপ করা ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল তখন। আমি ভীতু মানুষ, সাহস কম। তাই রূপকের আশ্রয় নিয়ে লেখা। লেখার পর একটু হালকা লাগছিল।

লেখালেখির ভবিষ্যৎ পরিকপল্পনা কী?
এই রকম জগা-খিচুড়ি টাইপ লেখা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রবল। গল্প, কবিতা, উপন্যাস যাই লিখি নিজের মতোন করে লেখার ইচ্ছা। ‘গডেস অব অ্যামনেশিয়া’ নামে যে উপন্যাস শুরু করেছি ওইটা শেষ করব দ্রুত। দুই হাজার বিশের বইমেলায় বা আরও আগে প্রকাশ করার ইচ্ছা। প্রায় আড়াই বছর হয়ে গেল ওইটা নিয়েই আছি মূলত। এরপর আরও একটা উপন্যাসের আউটলাইন দাঁড় করানো আছে, ওইটা শুরু করব সামনের শীতে। নিজের ইংরেজি গল্প, কবিতাগুলোকেও বই আকারে প্রকাশের ইচ্ছা আছে। তবে তাড়াহুড়া নাই কোন। আর, হ্যাঁ, কোনদিন আর অন্য কারও লেখা অনুবাদ না করার ইচ্ছা আছে। কারণটা একেবারেই ব্যক্তিগত। কিন্তু অনুবাদের অনুরোধ এলে আমার ভীষণ বিব্রত লাগে এখন।

সময় দিলেন। ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
আপনাকেও ধন্যবাদ। নিজের পছন্দে জীবন হোক।