কালের চাহিদা পূরণে সব কিছুতেই সংস্কারের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের দেশের পুলিশ এখনও চলছে সেই মান্ধাত্বা আমলের ধারা। আমাদের পুলিশ বিভাগে সংস্কার একেবারে হয়নি তা বলা যাবে না। সংস্কারের নামে বিভিন্ন সময় পুলিশের পদ-পদবিতে পরিবর্তন এসেছে। বেতন কাঠামো বদলেছে। কখনো কখনো পোশাকও বদলেছে। কিন্তু কার্যত: সংস্কার বলতে গুণগত কোনো পরিবর্তন আসেনি আজও। এই ধারাবাহিকতায় বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে পুলিশ বিভাগে সংস্কার প্রশ্নে অনেক কথা চালাচালি চলেছে, হয়েছে চিঠি চালাচালিও। তৎকালীন আইজিপি এ সংক্রান্ত কিছু কথা বলে পুলিশ বাহিনীতে বেশ জনপ্রিয়তাও অর্জন করেন। এ অপরাধে তিনি শোকজেও পড়েন। তিনি সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চেয়েছিলেন বলে অভিযোগ ছিল। নানান কথা চালাচালির একপর্যায়ে পুলিশ সংস্কার ইস্যুটি ধামাচাপা পড়ে যায়। এটি এখন অনেকটা তামাদি বিষয়ের মতো।
পুলিশ সংস্কার প্রস্তাবের সেই খসড়াটিও এখন লালফিতায় বন্দী। এ সংক্রান্ত পর্যালোচনা কমিটি এ বিষয়ে সক্রিয় নয়। এ অবস্থায় প্রস্তাবিত পুলিশ অধ্যাদেশটি আলোর মুখ দেখবে কি না, এ নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশটিতে পুলিশকে সেবাদানকারী সংগঠনে পরিণত করার কথা বলা হয়েছে। তা বাস্তবায়িত হলে পুলিশের ওপর রাজনৈতিক খবরদারির সুযোগ কমবে। রাজনৈতিক চাপে পুলিশকে পরিচালিত বা বদলি করা কঠিন হবে। পুলিশের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে মন্ত্রী-এমপি বা প্রভাবশালীদের সুপারিশ ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে।
আবার ভিন্ন মতাবলম্বীদের মতে, প্রস্তাবিত এ সংস্কার কার্যকর হলে পুলিশ বেশি মাত্রায় ক্ষমতা চর্চা করবে। পুলিশের ওপর মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ কমবে। উল্লেখ্য, আমাদের পুলিশ বাহিনী চলছে ১৮৬১ সালের পুলিশ রেজুলেশন অব বেঙ্গল(পিআরবি) অনুযায়ী। পুলিশকে তখন ঔপনিবেশিক শাসকদের আজ্ঞাবহ লাঠিয়াল বা ঠেঙানো বাহিনীর আদলে একটি বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ওই সময়ের বাস্তবতার সঙ্গে আজকের বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপটে অনেক তফাৎ। এ বাস্তবতার নিরিখে পুলিশকে গণমুখী ও যুগোপযোগী করতে ১৮৬১ সালের আইনে পরিবর্তন জরুরি। এ জরুরি কারণেই সংস্কারের প্রশ্ন? সেই লক্ষ্যে প্রণীত খসড়া আইনে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তা সারিয়ে দ্রুত সংস্কারের কাজটি সম্পন্ন করা বাঞ্ছনীয়। পুলিশের এসব মতামতের সারসংক্ষেপ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়।
এক জরিপে দেখা যায়, পুলিশ সংস্কার নিয়ে সারা দেশের ৫৭৭ টি সভার মাধ্যমে ৬৭ হাজার মানুষের লিখিত মতামত সংগ্রহ করা হয়েছে। মতামত দাতাদের মধ্যে ৬৬ হাজার ৫০০ জন প্রচলিত পুলিশ আইন সংস্কারের পক্ষে বলেছেন। তবে মন্ত্রণালয়ের কমিটি এসব মতামতের সঙ্গে একমত পোষণ করেনি। বরং মন্ত্রণালয় থেকে এর বিরোধিতা করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রসঙ্গত: ১৮৬১ সালে বৃটিশ সরকার উপমহাদেশের মানুষকে শাসন ও শোষণ করার জন্যে একটি আইন তৈরি করে। যে আইনে জনগণের প্রতি পুলিশের কর্তব্য কি তার কোন উল্লেখ নেই। সে সময় থেকে ঐ আইনের মাধ্যমে পুলিশকে সরকারের অত্যাচারের হাতিয়ার হিসেবে করে রাখা হয়েছে যা আজও বলবৎ। ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রণীত সেই পুলিশ আইনের সংস্কার চাচ্ছে আজ পুলিশ নিজেও। ২০১৪ সালের এক হিসেব মতে, বাংলাদেশে পুলিশের সংখ্যা ১ লাখ ৫৪ হাজার ৯২১জন। জনসংখ্যা অনুযায়ী এ সংখ্যা আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও অনেক কম। এছাড়া মান্ধাতা আমলের প্রশিক্ষণ, সেকেলে অস্ত্র এবং যানবাহনের অপ্রতুলতা সবমিলিয়ে এটি একটি পশ্চাদপদ রাষ্ট্রীয় সংগঠন।
বাংলাদেশ পুলিশের কেবলই বদনাম। বাংলাদেশের পুলিশ জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত। পুলিশকে বাংলার জনগণ মনে করে পেটোয়া বাহিনী। পুলিশের উপর ভরসা করার মতো কোন উদাহরণ আমাদের সামনে নেই। দেশের মানুষের দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশা একটি আধুনিক জবাবদিহিতামূলক পুলিশ বাহিনী গড়ে উঠুক। উন্নত দেশের পুলিশের মতো আমাদের দেশের পুলিশেরও থাকবে দক্ষতা, থাকবে গতিশীলতা। পুলিশ যেন এদেশে আর রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত না হয়। পুলিশ আর জনগণের মাঝখানে যে অবিশ্বাসের দেয়াল আছে তা তুলে ফেলতে হবে। পুলিশ যে জনগণের বন্ধু এ বিশ্বাস জনমনে প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরী।
‘বাংলাদেশ পুলিশ অধ্যাদেশ ২০০৭’ নামে যে প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে জনগনের সে আশা-আকাঙ্খারই প্রতিফলন দেখা যায়। খুবই যুগোপযোগী একটি প্রস্তাব। লন্ডন, নিউইয়র্ক কিংবা টরন্টো পুলিশের কাঠামোও একই ধরনের। বোঝাই যায় বহু লোকের সুচিন্তিত মতামত এবং পরিশ্রমের ফসল হচ্ছে এটি। ইতিমধ্যে দেশের প্রধান প্রধান গণমাধ্যমগুলোও এর সপক্ষে তাদের মতামত রেখেছে। অভিজ্ঞমহল মনে করেন, পুলিশ অধ্যাদেশ এ এমন কিছু বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা কার্যকর হলে পুলিশের বিদ্যমান অনেক সমস্যা দূর হবে। যেমন: পুলিশ সদস্যদের ওপর রাজনৈতিক খবরদারি করার সুযোগ থাকবে না, চার স্তরে পুলিশের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকবে, জাতীয় পুলিশ কমিশন, অভিযোগ কমিশন, নীতিনির্ধারণী গ্রুপ গঠন ইত্যাদি বিধান কার্যকর করার মধ্য দিয়ে পুলিশের ব্যাপক সংস্কার সাধিত হবে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কোনো সুযোগ থাকবে না, লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, তদবির ইত্যাদি ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে। মানবাধিকারের দিকটি, বিশেষত নারী ও শিশুদের ব্যাপারে পুলিশের আচরণ সংক্রান্ত দিকনির্দেশনাও প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের খসড়ায় রয়েছে। সর্বোপরি প্রস্তাবিত আইনে পুলিশকে একটি সেবাদানকারী সংগঠনে পরিণত করার ইচ্ছে ব্যক্ত করা হয়েছে।
জানা যায়, ২০০৫ সাল থেকে ইউএনডিপি, ডিএফআইডি ও ইউরোপীয় কমিশনের অর্থায়নে পুলিশের সংস্কার কাজে হাত দেয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই বাছাইয়ের পর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে একটি পরামর্শক কমিটি গঠনের নির্দেশ আসে। ২০০৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সেই পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়; তারপর খসড়া অধ্যাদেশটি সম্পর্কে দেশব্যাপী থানা পর্যায়ে জনমত যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়। সেই কাজটি শেষ হওয়ার পর প্রাপ্ত মতামতের একটি সারসংক্ষেপও তৈরি করা হয়। তারপর এ নিয়ে কেবলই কালক্ষেপণ। নতুন আইনটি যাতে না হয়, সে জন্যে নানান জটিলতা সৃষ্টি করা হয়। আশা করা গিয়েছিল তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ অধ্যাদেশটি বাস্তবায়িত করা হবে। কিন্তু করা হয়নি। ঐ সময় পুলিশের আইজি নূর মোহাম্মদ ক্ষোভ প্রকাশ করে সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমরা বলছি যে আমরা ভালো হবো। আমাদের সংস্কার করে আমাদের ভাল হওয়ার সুযোগ দিন। আপনারা দিচ্ছেন না।’
পুলিশের সাবেক আইজি এ এস এম শাহজাহান বলেছেন, ‘সংস্কারের দ্বারা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তারা কোনদিনই সংস্কারের পথে অগ্রসর হবে না।’ প্রস্তাবিত পুলিশ অধ্যাদেশ মানতে নারাজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করে, পুলিশ অধ্যাদেশ কার্যকর হলে পুলিশ বিভাগের ওপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। আর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে জনপ্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে এবং জনগণ তাদের প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। পুলিশ একটি স্বেচ্ছাচারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে যাবে।
সর্বশেষ পুলিশ অধ্যাদেশ কার্যকর করার পরিবর্তে আধুনিক, দক্ষ, কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে পিআরবি সংশোধনসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৩ দফা প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এ ধরনের একটি সংস্কার প্রস্তাব পাস না হওয়ার কোন যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না। ‘রাজনৈতিক সরকার পুলিশকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়, এ কারণে তারা পুলিশ সংস্কারে আগ্রহী হয় না’ এ ধারণাটা ভাঙতে হবে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজানো দরকার। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য পুলিশ প্রশাসনে সংস্কার প্রয়োজন। পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টিও খুব জরুরি। সেজন্য আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা, যানবাহন ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে। আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন একটি পুলিশ বাহিনী তৈরি করার জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ। পুলিশ যেন সাধারণ মানুষকে শ্রদ্ধা করে, জনগণের অধিকার সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল হয়। পুলিশের সেবাব্রতী মনোভাব গড়ে তোলার জন্য নিয়মিত কর্মশালা চালু রাখা আবশ্যক।
শান্তি ও নিরাপত্তা মানুষকে আত্মবিশ্বাস দেয়, আর আত্মবিশ্বাসী জাতির জন্য সমৃদ্ধি অর্জন সহজতর হয়। পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগ। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে অবশ্যই পুলিশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে এ পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। নিতে হবে যথাপোযুক্ত উদ্যাগ। একটি দক্ষ, গতিশীল, আধুনিক, কর্তব্যপরায়ণ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক পুলিশ সংগঠন প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবী।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)