পুলিশি হেফাজতে বা রিমান্ডে নিয়ে নাগরিকদের নির্যাতন নতুন কোনো খবর নয়। পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যুও পুরনো সংবাদ। শুধু অপরাধী নয়, নিরপরাধ লোকও এ জাতীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং এখনও হয়।
প্রতিপক্ষের কাছ থেকে টাকা খেয়ে আটক, মিথ্যা মামলায় চালান করে দেয়া এমনকি গুম করে দেয়ার অভিযোগও ভুরি ভুরি। কিন্তু এসব ঘটনার কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকে না। ভিডিও থাকে না। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা বাদ দিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা মানুষ মারার দায়ে শাস্তি পেয়েছে, সেই সংখ্যা অতি নগণ্য। কিন্তু এবার এক ভয়াবহ ভিডিও আমাদের সামনে হাজির। যা থানা হেফাজতে নিয়ে লোকজনকে কী বেধড়ক পেটানো হয়, তার এক জ্বলজ্বলে উদাহরণ।
গা শিউরে ওঠা সেই ভিডিও প্রচারিত হয়েছে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া থানায় আটকে রেখে মোশারফ নামে এক পোল্ট্রি ব্যবসায়ীর কাছে দুই লাখ টাকা ‘মুক্তিপণ’ চেয়ে নির্মমভাবে তাকে পেটানো হয়। দুজন পুলিশ তার বুকের উপরে দাঁড়িয়ে এবং আরেকজন (এসআই সোহেল রানা) লাঠি দিয়ে বেদম মারছেন। মারের যন্ত্রণায় কাৎরাচ্ছেন আর বলছেন, ‘টাকা দেব টাকা দেব…।’
যদিও টাকা দিয়েও মুক্তি মেলেনি তার। রাতভর নির্যাতনের শিকার মোশারফের পরিবার পরদিন ভোরে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে থানায় গেলেও তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঠানো হয় আদালতে। চাওয়া হয় রিমান্ড। রিমান্ডে কী হয়, তা দেশের মানুষ জানে।
এই ঘটনার বিষয়টি যথারীতি অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা। ভিডিও ফুটেজে তার চেহারা স্পষ্ট। কিন্তু তারপরও তিনি বলছেন, এ জাতীয় ঘটনা ঘটেনি। আর থানার ওসি বলছেন, তিনি ঘটনা জানেন না। তার থানার ভেতরে নিয়ে একজন যুবককে রাতভর পেটানো হলো, অথচ তিনি জানেন না। প্রশ্ন ওঠে, তিনি তাহলে কোথায় ছিলেন অথবা তার থানার ভেতরে কী হয়, তা যদি তিনি না জানেন, তাহলে তাকে এই পদে অযোগ্য ঘোষণা করা উচিত কি না? এটি যে থানা হেফাজতেই ঘটেছে, ভিডিও তা স্পষ্ট। তবে কিছুটা আশার বাণী শুনিয়েছেন কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার। বলেছেন, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সাধারণত পুলিশের কর্মকর্তারা যে ভাষায় কথা বলেন, তিনিও তার ব্যতিক্রম নন। দেখা যাক, আসলেই তদন্ত হয় কি না বা অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় কি না?
পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া কঠিন। কারণ আইনই তাদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে রেখেছে। বলা আছে, সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধ হলে তিনি দায়মুক্তি পাবেন। ফলে অনেক সময়ই তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হলেও সেটি এই কথিত সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধ বলে চালানো হয়।
দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সাথে কেউ তর্কে গেলে, সেটি যুক্তিপূর্ণ তর্ক হলেও তারা বলেন, ‘পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেয়া হয়েছে।’ যেকোনো নাগরিককে ‘সাইজ’ করার জন্য এই একটি অজুহাতই যথেষ্ট।
পাকুন্দিয়া থানায় নিয়ে মোশারফ নামে যে যুবককে পেটানো হয়েছে, তার বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযোগ, তিনি মোটরসাইকেল চুরি করেছেন। যদিও পরিবারের দাবি, রাতে তাকে পুলিশ বাজার থেকে ধরে নিয়ে গেছে, সেদিনই মোশারফ ওই পুরানো মোটর সাইকেলটি তার ব্যবসায়িক কাজের জন্য কেনেন। কিন্তু পুলিশকে কাগজপত্র দেখাতে না পারায় তারা মোশারফকে ধরে নিয়ে যায় এবং জানায়, দুই লাখ টাকা দিলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। তার পরিবার সাংবাদিকের কাছে বলেছে, তারা দুই লাখ টাকা জোগাড় করতে পারেনি।৬০ হাজার টাকা জোগাড় করে পুলিশকে দিয়েছে। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি।
ধরা যাক পুলিশের হাতে আটক মোশারফ সত্যিই মোটর সাইকেল চুরি করেছেন। অথবা তার কাছে মোটর সাইকেলের বৈধ কাগজপত্র নেই।তাহলেও পুলিশ তাকে এভাবে মারতে পারে কি না? যদি তাই হয়, তাহলে দেশে আর আইন-আদালত থাকার প্রয়োজন কী? পুলিশ যে শুধু পয়সার জন্যই লোকজনকে এভাবে আটকে রেখে পেটায়, তা কারো অজানা নয়। আবার বড় বড় অপরাধীও থানা হেফাজতে জামাই আদরে থাকে, শুধুমাত্র পুলিশকে মোটা অংকের পয়সা দেয়া হয় বলে। অর্থাৎ বিচারের বাণী এখন পয়সার বৃত্তে কাঁদে।
কিশোরগঞ্জের এই ঘটনাটিও হয়তো পুলিশের অপরাপর ঘটনাগুলোর মতো একসময় গুরুত্ব হারাবে। আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আসবেন মোশারফ। কিন্তু তার উপরে যে নির্মম নির্যাতন চললো, সামাজিকভাবে তিনি ও তার পরিবার যেভাবে নাজেহাল আর হয়রানির শিকার হলেন, তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে? যে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এবং যে অভিযোগের প্রমাণও রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে? সন্দেহটা এ কারণে যে, পুলিশের বিরুদ্ধে এরকম বড় কোনো অভিযোগ এলে তাকে বদলি করা হয় কিংবা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়। অসংখ্য ঘটনার মধ্যে খুব কদাচিৎ তাদের জেল হয় বা চূড়ান্তভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়।কারণ তারা যত অপরাধই করুক, তাদের আইনি রক্ষাকবচ অত্যন্ত শক্তিশালী, যতটা শক্তিশালী নয় সাধারণ মানুষের রক্ষাকবচ। অথচ এই সাধারণ মানুষের করের পয়সায়ই ওই পুলিশ সদস্যদের বেতন হয়।
নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু রোধে দেশে একটি আইন আছে। যেখানে বলা হয়েছে,হেফাজতে কাউকে নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি অন্যূন পাঁচ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং তার অতিরিক্ত পঁচিশ হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্ত/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেবেন।
আইনে আরও বলা হয়েছে, কাউকে হেফাজতে নির্যাতনের ফলে যদি তার মৃত্যু হয় তাহলে নির্যাতনকারী অন্যূন যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং তার অতিরিক্ত দুই লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত/সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি/ব্যক্তিদেরকে ক্ষতিপূরণ দেবেন।
২০১৩ সালে এই আইনটি প্রণীত হয়েছে। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী বিলটি এনেছিলেন। এটি ছিল বেসরকারি বিল। বাংলাদেশের সংসদে বেসরকারি বিল পাসের রেকর্ড অতি সামান্য।
সেই সামান্য সংখ্যক আইনের একটি এই হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ বিল। কিন্তু বিলটি পাস হবার পরেও এই ৫ বছরে হেফাজতে নির্যানের অসংখ্য ঘটনা ঘটলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতজন সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বা বিচার হয়েছে, তা নিয়ে বোধ হয় প্রশ্ন তোলার সময় হয়েছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)