আমি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গল্প তথা কার্যক্রম বিশেষ করে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সার্বিক বিষয়াদি দিয়ে আজকের নিবন্ধটি শুরু করছি। সঙ্গত কারণেই প্রতিষ্ঠানটির নাম উল্লেখ করছি না, তবে প্রতিষ্ঠানটি মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রে এখনো স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছে এবং দীর্ঘদিন ধরে সফলতার সঙ্গে টিকেও আছে। সাধারণত বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো দাতা সংস্থা ও ক্ষেত্র বিশেষে দাতাদের অর্থে পরিচালিত হয়ে থাকে যদিও প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি পরিচালনা বোর্ড কিংবা ট্রাস্টি বোর্ড থাকে। বিনিময়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যে কোন একটি গবেষণার রিপোর্ট কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উক্ত সংস্থার নিকট রিপোর্ট প্রদান করে থাকে টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ পাওয়া গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি। টেন্ডার প্রক্রিয়ার মধ্যে যথার্থ গবেষণা প্রকল্প জমাদানের ভিত্তিতে কাজ করার সুযোগ পায় প্রতিষ্ঠানগুলো। আমি যে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কথা বলছি সেখানে স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার অর্থায়নে বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রকল্প সারা বছরব্যাপী পরিচালিত হতো এবং তাদের গবেষণার রিপোর্টের মানও বেশ ভাল।
এক একটি গবেষণা প্রকল্পের জন্য সুনির্দিষ্ট একটি টিম দায়িত্ব পালন করে (প্রশ্নমালা প্রস্তুতকরণ, টিম প্রস্তুতকরণ, তথ্য সংগ্রাহকের প্রশিক্ষণ, তথ্য সংগ্রহ শেষে যাচাই বাছাই এবং সর্বশেষ উপাত্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে রিপোর্ট প্রস্তুতকরণ)। যে টিমটি রিপোর্ট প্রদানের সুনির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের চাহিদা মোতাবেক কাজ শেষ করে জমা দিতে পারেন উক্ত টিমকে পুরস্কারস্বরূপ গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে বছর শেষে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হতো। বিপরীত পক্ষে কোন টিম যদি যথার্থ সময়ে তাদের কাছে প্রদানকৃত কাজ জমা দিতে ব্যর্থ হয় তিরস্কারস্বরূপ প্রতিষ্ঠান থেকে তাদেরকে শোকজ করা হয় যার প্রভাব পরে বৎসরভিত্তিক ইনক্রিমেন্ট এর উপর এবং প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অন্যান্য সুযোগ সুবিধার উপর। তবে এ ক্ষেত্রে পারিপার্বিইনকতা ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পুরষ্কার ও তিরস্কার প্রদান করা হতো। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে ক্ষেত্রে সফলতার জন্য পুরষ্কারের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে বিপরীত পক্ষে ব্যর্থতার জন্য তিরস্কারের ব্যবস্থা রয়েছে এবং থাকাটাও সমীচিন।
পুরস্কারের পাশাপাশি তিরস্কারের ব্যবস্থা থাকলে কাজের প্রতি সকলের আগ্রহ ও মনোযোগ বৃদ্ধি পায় সেটি যে কোন সেক্টরেই হোক না কেন। আমি ক্রিকেটবোদ্ধা নই তবে ক্রিকেটকে খুব ভালবাসি এবং নিজেও সুযোগ পেলে মাঠে নেমে যাই। যখন ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিল না আবার সব খেলা টেলিভিশনে সম্প্রচার হতো না তখন রেডিওতে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলার ধারাবিবরণী শুনে আপ্লুত হতাম। শ্রদ্ধেয় খোদা বক্স মৃধা, মঞ্জুর হাসান মিন্টু, চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাতের ধারা বিবরণীতে বাংলাদেশ দলের যাচ্ছেতাই (কালে ভদ্রে বিজয়ের স্বাদ পাওয়া যেত) পারফরমেন্স আবেগের সহিত মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। ভিন্ন দলের সঙ্গে সামান্য লড়াকু মানসিকতা দেখা গেলেও ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশান্বিত হতাম। ভাবতাম বাংলাদেশ ক্রিকেট একদিন সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণ করবে, বিশ্বসেরা ৩-৪ টি দলের মধ্যে একটিতে পরিণত হবে। কিন্তু আজকের দিনেও যদি সেই পুরনো দিনের মত আশাবাদী হতে হয় তাহলে পরিবর্তন আসবে কিভাবে? বিপরীত দিকে দেখা যায় বিশ্ব ক্রিকেটে নতুন আসা বেশ কয়েকটি দল চমৎকার পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে একের পর এক জয় ছিনিয়ে আনছে, এমনকি সিরিজ জয়ও শুরু করে দিয়েছে নতুন করে ক্রিকেটে আসা দলগুলো যেখানে আমাদের সিরিজ জয়ের চিন্তা এখনো দুষ্প্রাপ্যই বটে।
বাংলাদেশে ক্রিকেটই একমাত্র খেলা যেখানে দল-মত, পেশা-শ্রেণি, বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলেই একাত্ম হয়ে ক্রিকেট দলের বিজয়ে আনন্দ উল্লাস করে। পরাজয়ে ব্যথিত হয়, বাংলাদেশ সরকারও ক্রিকেট দলের উন্নয়নের জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে এবং ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ সুবিধা প্রদান করে থাকে। তদুপরি বাংলাদেশের ক্রিকেট এবং ক্রিকেটারদের যে ধরনের উন্নতির প্রয়োজন ছিল তার ছিঁটেফাটাও কিন্তু লক্ষ্য করা যায়নি। প্রতিনিয়ত পেশাদারিত্বের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে ক্রিকেটারদের মধ্যে। সম্প্রতি ভারত সফরে ক্রিকেটারদের চরম ব্যর্থতা এ দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে মারাত্মক বেদনার সৃষ্টি করেছে। বারবার ব্যর্থতা ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখাবে ক্রিকেট প্রশাসনকে।
ক্রিকেটবোদ্ধা এবং সাংবাদিকরা প্রত্যেকটা সিরিজ শেষ হবার পরে উক্ত সিরিজের সফলতা বা উন্নতির ছোটখাট বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকেন। যেমন: এই সিরিজে প্রাপ্তি অমুকের সেঞ্চুরী, তমুকের পাঁচ উইকেট। কিন্তু দল হিসেবে যে প্রতিনিয়ত আমরা ব্যর্থ হচ্ছি সেটার পিছনের কারণ কেউই কখনো অনুসন্ধান করার তাগিদ অনুভব করিনি। ভারতের বিরুদ্ধে টি টোয়েন্টি সিরিজে যেভাবে সিরিজ হেরেছি আমরা, একটি প্রাপ্ত বয়স্ক দল (দীর্ঘ দিন ধরে ক্রিকেট খেলে আসছে) কখনোই এমন অপেশাদারিত্ব মনোভাবের পরিচয় দিতে পারেনা। এখনো যদি ছোট দল হিসেবে খেলার মাঠে বিচরণ করি তাহলে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল আর কবে বড় হবে? সিরিজ শুরুর পূর্বে প্রতিপক্ষ অধিনায়কের মুখে বাংলাদেশকে সমীহ করা শুনলে এ দেশীয় সাংবাদিকরা খুশিতে গদগদ হয়ে নিউজ করে দেয়। সমীহ করা যে প্রতিপক্ষের কৌশল মাত্র সেটা অনেকেই বুঝেন না। আবার দেখা যায়, ২০-২৫ টি ম্যাচের পর ২-১ টি জয়ের পর সবাই বাহবা দিয়ে ক্রিকেটারদের পয়মত্ত করে থাকে।
ক্রিকেটারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, মোটা অংকের বেতন প্রদান করা সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে। সুতরাং তাদের কাজই হচ্ছে সার্বক্ষণিক ক্রিকেটের সঙ্গে লেগে থাকা এবং দেশের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে জয় ছিনিয়ে এনে দেশের মানুষকে আনন্দের আতিশয্যে অভিভূত করা। এটাই তাদের কাজ এবং এ কাজের জন্যই তাদেরকে রিক্রুট করা হয়। এ জিনিসটা যেন সকলেই ভুলে যায় নিমিষেই। ক্রিকেটারদের মনোযোগের ঘাটতি, ২০-৩০ রান করে দলে টিকে থাকার প্রবণতা, পেশাদারিত্বের অভাব, দলের জন্য না খেলে নিজের জন্য খেলা ইত্যাদি বিষয়গুলো বড় দল হিসেবে গড়ে উঠার অন্তরায় হিসেবে কাজ করে।
কিন্তু দেখা যায়, মাঝে মধ্যে ২-১টি ম্যাচ জয়লাভের পর রাষ্ট্রীয়ভাবে ফ্ল্যাট, প্লট এবং নগদ মোটা অংকের টাকা প্রদান করা হয়ে থাকে। বিষয়টা ব্যক্তিগতভাবে আমরা কাছে প্রশ্নেরই উদ্রেক করে থাকে। কেননা আপনি ১০-১৫টি ম্যাচ টানা খেললে ২-১টিতে জয়লাভ করতে পারেন। সেখানেই সমস্যা না, সমস্যা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে যারা টানা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে তাদেরকে কেন তিরস্কার করা হবে না। পুরস্কার যেখানে দেওয়া হয় সেখানে তিরস্কারের ব্যবস্থা রাখা উচিত। তাহলে তাদের মধ্যে কর্তব্যবোধ, পেশাদারিত্ব এবং নিজেদের সর্বোচ্চ শ্রম ও নিষ্ঠার প্রয়োগবিধি ঘটতে পারে। বিষয়টা বাংলাদেশ ক্রিকেটের নীতি নির্ধারকদের জন্য ভাবনার বিষয় হয়ে উঠা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। কেননা, মাসের পর মাস আপনারা বাজে ক্রিকেট খেলে যাবেন এবং পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনা এবং পরিস্থিতির অজুহাত তুলে ধরবেন সেটা কোনভাবেই মানানসই নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ভারতের বিরুদ্ধে যে পারফরমেন্স সে জন্য তাদেরকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে করণীয় নিয়ে যাতে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ পথ সুগম হয়। কিছুদিন পূর্বে একজন ক্রিকেটার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নিয়মিত সুযোগ না পাওয়ায় তিনি তাঁর ব্যাটিং সামর্থকে তুলে ধরতে পারছেন না। অথচ ভারতের বিরুদ্ধে দু টেস্টের চার ইনিংসের একটিতেও তিনি ১০ রান করতে পারেনি। আমাদের বোঝা উচিত ঘরোয়া ক্রিকেট আর আন্তর্জাতিক ম্যাচ এক নয়। পরপর দুটি টেস্টে যাচ্ছেতাইভাবে, যেনতেনভাবে হেরে ঘরে ফিরছে ক্রিকেটাররা সেটা কোনভাবেই মানা যায় না। দু টেস্টেই ইনিংস ব্যবধানে হার, টেস্টে অভিষেকের এত দিন পর এমন বাজে অবস্থা সহজে মেনে নেওয়ার মতো নয়। আর কত দিন পরে বাংলাদেশ পরিপক্ক দল হয়ে উঠবে সেটা কিন্তু কেউই আমরা হলফ করে বলতে পারি না। কাজেই সময় এসেছে সবকিছুকে ঢেলে সাজানোর। আবেগ দিয়ে জীবন চলে না, বাস্তবতাকে সামনে রেখে ক্রিকেট দলকে ঢেলে সাজানো সময়ের দাবি। প্রয়োজনে খেলোয়াড়দের ছাঁটাই করে নতুন করে টি-টোয়েন্টি, ওয়ান-ডে ও টেষ্ট দলের জন্য দল গঠন করা যেতে পারে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)