ইউক্রেনে রাশিয়ার চলমান হামলার অষ্টম দিন চলছে আজ। রাশিয়ার সৈন্যদের বিশাল ঝুঁকিতে ফেলে দিয়ে পুতিন নিজ দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেও এক অনির্দিষ্ট অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে বলে মন্তব্য অনেক বিশ্লেষকদের।
এই হামলার পেছনে প্রেসিডেন্ট পুতিনকে কারা সহায়তা করছে বা কাদের সিদ্ধান্ত তিনি মেনে চলেন সে নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা।
বিবিসির প্রতিবেদনে, রাশিয়ান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও লেখক আন্দ্রেই সোলদাটভ তার এবং কয়েকজনের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে তুলে ধরেছেন পুতিনকে সিদ্ধান্ত দিতে পারে এমন কয়েকজন ঘনিষ্ট আস্থাভাজনদের কথা।
সের্গেই শোইগু:
ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরণ থেকে শুরু করে পশ্চিমাদের মিলিটারি হুমকি থেকে রাশিয়াকে নিরাপদ রাখতে পুতিনের রেখাঙ্কিত পথে হাঁটছেন তার দীর্ঘদিনের আস্থাভাজন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু।
তিনি পুতিনের অবসর সময়ের সঙ্গী ছিলেন যার কারণে এক সময় শোইগুকে তার উত্তরসূরি বিবেচনা করা হতো।
কিন্তু একটা ছবিতে দেখা যায়, তিনি একটি টেবিলে বসে আছেন পুতিনের সাথে কিন্তু তাদের মাঝখানে অনেক দূরত্ব।
সশস্ত্র যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ ভেরা মিরোনোভা বলে, শোইগু’র কিয়েভে যাওয়ার কথা ছিলো এবং এ যুদ্ধে জয় হওয়ারও কথা ছিলো। তিনি ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ায় সামরিক দখলের জন্য কৃতিত্ব লাভ করেন। এছাড়া ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যের সালিসবারিতে হামলা, ২০২০ সালে সাইবেরিয়ার নাভালনিতে বিরোধী নেতা অ্যাকেক্সেই’র ওপর মারাত্মক হামলার অভিযোগে অভিযুক্ত তিনি।
বিভিন্ন ছবিতে তাদের তার চেহারাই বিরক্তি প্রকাশিত হলেও রাশিয়ান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও লেখক আন্দ্রেই সোলদাটভ বিশ্বাস করেন যে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী এখনো অবধি সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি যার কথা প্রেসিডেন্ট সবচেয়ে বেশি শোনেন।
শোইগু শুধুমাত্র একজন মিলিটার ইনচার্জই নয়, তিনি একজন আইডিওলজিকাল ইনচার্জও। আর রাশিয়ার মতাদর্শ ইতিহাস নির্ভর, যে ইতিহাসের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তার হাতে।
ভ্যালেরি গেরাসিমভ:
রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অফ জেনারেল স্টাফ হিসেবে ইউক্রেনে হামলা করা এবং দ্রুত কাজটি সম্পন্ন করার দায়িত্বে তার কাঁধেই কিন্তু সে তুলনায় খুব কম ভূমিকায় দেখা গেছে তাকে।
তিনি ইউক্রেনে সামরিক হামলার পরিকল্পনায় প্রথম সারির একজন এছাড়া গতমাসে বেলারুশে সামরিক মহড়ার তত্ত্বাবধানেও ছিলেন তিনি। ক্রিমিয়া দখলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তার।
তবে বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করা এবং সৈন্যদের মধ্যে দুর্বল মনোভাবের কারণে তিনি কিছুটা দূরে সরে আছেন।
নিকোলাই পাত্রুশেভ:
নিরাপত্তা কাউন্সিলের সচিব পুতিনের তিনজন অনুগতদের একজন নিকোলাই। যারা ১৯৭০ সাল থেকে তার সাথে কাজ করে আসছেন।
অন্য দুজন হলেন নিরাপত্তা সেবা প্রধান আলেকজেন্ডার বোর্টনিকভ এবং বিদেশী গোয়েন্দা প্রধান সের্গেই নারিশকিন। রাষ্ট্রপতির এই ত্রয়ী দলকে সিলোভিকি বা এনফোর্সারস হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।
তবে পুতিনের ওপর নিকোলাই’র প্রভাব বেশি দেখা যায়। তারা কেবল কেজিবি-তেই একসাথে কাজ করেননি তিনি পুতিনের উত্তরাধিকার সংগঠন এফএসবি-এ প্রধান হিসেবে কাজ করেছে ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত।
আক্রমণের তিনদিন আগের রাশিয়ার নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় লক্ষ্যই হলো রাশিয়াকে ভেঙে ফেলা।
এই বৈঠকে রাশিয়া সমর্থিত বিদ্রোহীদের স্বাধীনতা দেয়ার মতামত ব্যক্ত করা হয়।
আলেকজান্ডার বোর্টনিকভ:
ক্রেমেলিনের পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন অন্য যেকোনো উৎসের চেয়ে সিকিউরিটি সার্ভিসের তথ্যের উপর বেশি বিশ্বাস করেন।
বোর্টনিকভ কেজিবি’র আরেকজন পুরোনো সদস্য। নিকোলাই এফএসবি থেকে সরে গেলে তিনিই এই দায়িত্বপ্রাপ্ত হোন।
দুজনেই পুতিনের ঘনিষ্ট হলেও আন্দ্রেই বলছেন, এখনও কে সব পরিকল্পনা করছে বা কে সিদ্ধান্ত দিচ্ছে তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না।
আন্দ্রেই’র মতে বোর্টনিকভ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেও পুতিনকে পরামর্শ দেয়ার মত নন।
সের্গেই নারিশকিন:
লেনিনগ্রাদ ত্রয়ী ব্যতীত সের্গেই নারিশকিন তার ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময় প্রেসিডেন্টের কাছাকাছি থেকেছে।
তবে নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকের প্রেক্ষিতে ক্রেমলিনের টিভি শো তে এখনকার পরিস্থিতি নিয়ে তার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি প্রেসিডেন্টের শেখানো কথায় বলেন যে, এটা এখনকার আলোচনার বিষয় নয়।
আন্দ্রে মনে করেন, পুতিন তার এই অভ্যন্তরীণ দলের সদস্যদের নিজের ইচ্ছে মতো কাজ করাতে পছন্দ করেন। যা নারিশকিন করে চলেছেন।
নারিশকিন ১৯৯০ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে তারপর ২০০৪ সালে পুতিনের অফিসে এবং অবশেষে পার্লামেন্টে স্পিকার হয়ে দীর্ঘ সময় পুতিনের ছায়া হয়ে পাশে ছিলেন। নারিশকিন রাশিয়ান হিস্টোরিক্যাল সোসাইটিরও প্রধান এবং আন্দ্রেই’র দৃষ্টিতে তিনি প্রেসিডেন্টকে তার কাজের আদর্শিক ভিত্তি তুলে ধরতে সাহায্য করেন।
সের্গেই ল্যাভরভ:
দীর্ঘ ১৮ বছর যাবৎ তিনি রাশিয়ার সবচেয়ে সিনিয়র কূটনীতিক। যিনি রাশিয়া সম্পর্কিত যেকোনো বিষয় উপস্থাপন এবং সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকেন।
সের্গেই ল্যাভরভ প্রমাণ করেন যে পুতিন অতীতের সকলের ওপর বেশি ভরসা করেন। লাভরভ তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিলেন।
তবে ইউক্রেন ইস্যুতে কূটনৈতিক সমাধানে তার কিছুটা আগ্রহ দেখা যায় যা পুতিন এড়িয়ে যান।
ভ্যালেন্টিনা ম্যাটভিয়েনকো:
পুতিনের দলের বিরল নারীমুখ হলেন ভ্যালেন্টিনা ম্যাটভিয়েনকো। যিনি ইউক্রেনে রাশিয়ান হামলার বিষয়টিতে সমর্থন দিয়েছেন।
ভ্যালেন্টিনা পুতিনের বিশ্বস্ত সকলের মধ্যে অন্যতম একজন। তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে ২০১৪ সালের ক্রেমেলিন দখল করা পর্যন্ত তার পাশে ছিলেন। যদিও বিশ্লেষকদের মতে, তাকে প্রাথমিক সিদ্ধান্তগ্রহণকারী হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।
ভিক্টর জলোটোভ:
ভিক্টর প্রেসিডেন্টের সাবেক দেহরক্ষী, যিনি এখন ন্যাশনাল গার্ডের পরিচালক। পুতিন ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী হিসেবে ৬ বছর আগে এই গার্ড প্রতিষ্ঠা করেন।
গার্ডের দায়িত্ব প্রদান করার মাধ্যমে বোঝা যায় ভিক্টর পুতিনের বিশ্বস্তদের একজন।
মিরোনোভার মতে, রাশিয়ার মূল পরিকল্পনা ছিলো, কয়েকদিনের মধ্যে ইউক্রেন হামলার কয়েকদিনে সামরিক বাহিনী ব্যর্থ হলে ন্যাশনাল গার্ড’র দায়িত্ব দেয়।
তবে তাদের মিলিটারি প্রশিক্ষণ এবং ট্যাঙ্ক না থাকায় আক্রমণ করাও ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্টিনের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও যুদ্ধ বিষয়ে তার মতামত নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইয়েভজেনি মিনচেনকোর মতে, মস্কোর মেয়র সার্গেই সোবিয়ানিন, রোসনেফ স্টেট ওয়েল জায়ান্টের প্রধান ইগর সেচিন ও প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ট।
এছাড়া ধনকুবের বরিস এবং আর্কাডি রোটেনবার্গ ভাতৃদ্বয়ও প্রেসিডেন্টের ছোটবেলার বন্ধু এবং দীর্ঘ সময়ের ঘনিষ্ট আস্থাভাজন।