২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পেশা জীবনের সেই বিশেষ দিনের অভিজ্ঞতা এখনো জ্বলজ্বল করছে ঘটনাস্থলে থাকা সাংবাদিকদের মনে। সেদিন সকালে পিলখানার ভেতর গুলির শব্দে প্রথমে তাদের অনেকেই ভেবেছিলেন ওটা কোন মহড়ার অংশ। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে তাদের ফোনে আসা ঘটনার অস্পষ্ট বর্ণনা, পিলখানা সংলগ্ন এলাকাবাসীর আতঙ্কিত প্রতিক্রিয়ায় তারা বুঝতে পারছিলেন পরিস্থিতি ভয়ংকর। তবে পিলখানার ভেতরে আসলে কী হচ্ছে তা জানার উপায় ছিল না। ভেতর থেকে আসা ফোন কল আর ক্ষুদে বার্তায় তাদের কাছে নানা খবর আসতে থাকলেও সেগুলোর সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার উপায় ছিল না।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ অধিদপ্তর (আইএসপিআর), তথ্য মন্ত্রণালয়, কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাৎক্ষণিক কোন বিবৃতি না আসায় পিলখানা ট্র্যাজেডির প্রথম দিনটা সাংবাদিকরা ছিলেন অন্ধকারে। তাই কোনরকম বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, হেলমেট ছাড়াই সেদিনের ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ ধানমণ্ডির ঝিগাতলা, আজিমপুর, নিউমার্কেট এলাকাগুলোতে দায়িত্বপালন করছিলেন সাংবাদিকরা। বিডিআর জওয়ানদের সঙ্গে কথা বলেই সংবাদ দিতে হচ্ছিল তাদের।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেদিন ঘটনাস্থলে থাকা সাংবাদিক জামিউল আহসান শিপু, মোস্তফা মল্লিক এবং সেলিম বাশার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেছেন আতঙ্কের সেই দিনের কথা। তাদের বর্ণনায় উঠে এসেছে সেদিনের ঘটনা, তথ্য এবং তথ্যের তদারকির সংকটসহ দেশের সাংবাদিকতা পেশার এক চ্যালেঞ্জিং অধ্যায়।
পেশাজীবনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দিনের দৃশ্য বর্ণনা করে দৈনিক ইত্তেফাকের সিনিয়র প্রতিবেদক জামিউল আহসান শিপু চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, গোলাগুলির খবর আসছে জেনে প্রথমে ভেবেছিলাম বিডিআর এর কোন মহড়া এরকম কিছু হতে পারে। কিন্তু যখন এই গোলাগুলির শব্দে বারবার সংলগ্ন এলাকা প্রকম্পিত হতে থাকে তখন আমার একজন পরিচিতজন ফোন দিয়ে জানায় অবস্থা ভয়াবহ।
‘সে জানালো প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে এবং সে পিলখানার ভেতরে লোকজনকে দৌড়াতে দেখছে। এই খবর শুনে আমি নীলক্ষেত এলাকায় চলে আসি। নিউ মার্কেট গেটে কয়েকজন সাংবাদিক দাঁড়িয়েছিল দেখলাম। সেখানে আমাদের চোখের সামনে একজন সেনা সদস্যকে গুলি করে বিদ্রোহীরা। তিনিই বাইরে নিহত সেনাসদস্যদের মধ্যে প্রথম। এরমধ্যেই দেখলাম উৎসুক জনতা বিদ্রোহীদের সমর্থনে মিছিল বের করেছে এবং বিদ্রোহীরা ফাঁকা গুলি ছুড়ছে।’
তখনও শিপুসহ অন্য সাংবাদিকরা জানেন না যে কী হচ্ছে পিলখানার ভেতরে। তাই ভেতরের অবস্থা জানতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। পেশাগত কারণে পূর্ব পরিচিত র্য্যাবের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমেদকে ফোন করে তার মোবাইল বন্ধ পান। শিপু তখনো জানেন না আর কখনো মোবাইলে ‘হ্যালো’ বলবেন না ‘গুলজার ভাই’।
এর পরের ঘটনাক্রম বর্ণনায় তিনি বলেন,‘আনুমানিক সকাল সাড়ে ১১-১২ টার দিকে আমরা এর ওর মুখ থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম কয়েকজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। তবে আইএসপিআর কিংবা সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে স্পষ্ট কোন তথ্য দিচ্ছিল না। ভেতরে কতজন নিহত হয়েছে তা পুরোপুরি জানা না যাওয়ায় ইলেকট্রনিক ও পরদিনের সংবাদপত্রে নিহতের সংখ্যা লেখা হয়েছিলো কোথাও ১০ কোথাও ১২ কিংবা ১৩ জন।’
ঝিগাতলায় বিডিআর সদরদপ্তরের মূল ফটকের সামনে থেকে দেখা দৃশ্য বর্ণনা করে তিনি জানান,‘রাত ৮টা-৯টার দিকে আমরা সেখানে যাই। আমরা খবর পাচ্ছিলাম সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করবে বিদ্রোহীরা।’
সরাসরি বিদ্রোহীদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন,‘আজিমপুর কবরস্থান সংলগ্ন একটি গেট দিয়ে আমি নিউ মার্কেটের গেটের সামনে এসে এটিএন বাংলার মুন্নি সাহাসহ কয়েকজন সাংবাদিককে পেলাম। মুন্নি সাহা তখন বিদ্রোহীদের সাক্ষাতকার নিচ্ছিলেন। আমরাও মুখে কাপড় দেয়া ৫-৬ জন বিদ্রোহীর কথা শুনছিলাম। তারা সেসময় অপারেশন ডাল-ভাত, তাদের ওপর নির্যাতন, বৈষম্য এসব কথা বলছিলো। আমরা ভেতরের অবস্থা জানতে চাইলে তারা জানায়,’সব ঠিক আছে। তখনও ফাঁকা গুলি চলছেই।’
সন্ধ্যার পর থেকে গুলির শব্দ কমে আসতে থাকে। পিলখানার আশেপাশে ছিলো ভারী অস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর অবস্থান। তবে ভেতরে যা হওয়ার হয়ে গেছে এটা তিনি জানতে পারলেন পিলখানার আশপাশে থেকে আসা ফোন কলে।
সেনাসদস্যদের হত্যাযজ্ঞের খবর একজন তাকে ফোন করে জানান, ‘ইত্তেফাক অফিসে ফোন করে ঝিগাতলার একটি ছয় তলা বাড়ির ৫ তলার এক বাসিন্দা তার বারান্দা থেকে দেখা দৃশ্য বর্ণনা করে জানান,“আমি দেখছি পিলখানার মাঠের এক কোণায় একটি গাড়ি থেকে কি যেনো নামানো হচ্ছে, মনে হচ্ছে এসব লাশ এবং মাটি খোঁড়া হচ্ছে।” তবে আমার তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না ১০-১২ জনের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কারণ আলোচনা শেষে সরকারের প্রতিনিধিরাও জানিয়েছিলেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে।’
অবশেষে ২৭ তারিখে আরেকটি ফোন আসায় পিলখানায় নিহতের সংখ্যা নিশ্চিত হন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গেটের বাইরে ছিলাম। পুলিশের এক কর্মকর্তা ফোনে বললেন,“মাটি খুঁড়ছি আর লাশ বের হচ্ছে, দুর্গন্ধে থাকা যাচ্ছে না।”
সামরিক বাহিনীর সংবাদ নিয়মিত কাভার করা চ্যানেল আইয়ের সাংবাদিক মোস্তফা মল্লিক ওই ঘটনা নিয়ে দু’টি বই লিখেছেন। তুলে ধরেছেন নিজের চোখে দেখা পিলখানা ট্র্যজেডির অাদ্যোপান্ত।
সেদিনের চিত্র তুলে ধরে মল্লিক বলেন, ‘ঘটনাস্থলের কাছাকাছি নিউমার্কেটের কাছে আইনশৃংখলা বাহিনী আমাদের আটকে দিয়ে বললো আর যাওয়া যাবে না। সহকর্মী তারিকুল ইসলাম মাসুম ভাই আরেকটি টিম নিয়ে ঢাকা কলেজের কাছাকাছি ছিলেন। ওখান থেকে আমরা বেঁড়িবাধ ঘুরে চলে গেলাম হাজারিবাগ। সেখানে গিয়ে দেখলাম কিছু বিডিআর জওয়ান অস্ত্রহাতে এবং ফাঁকা গুলি ছুড়ছে। আসলে ঘটনাস্থলের মোটামুটি কাছাকাছিও আমরা যেতে পারছিলাম না। সিটি কলেজ, বেক্সিমকো টাওয়ার এবং ঝিগাতলার মোড় এর মাঝখানে আসার কোনো উপায় ছিল না। তাই আমরা প্রথম সরাসরি সম্প্রচার শুরু করলাম ধানমণ্ডি ৩ থেকে। এরইমধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম রাস্তাঘাঁট ফাঁকা, শুধু সেনাবাহিনীর গাড়ি এবং সাঁজোয়া যান ধানমণ্ডি মাঠ পর্যন্ত চলে এসেছে। ওখান থেকে লাইভ চললো সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।’
পিলখানার কাছাকাছি সেদিনের দৃশ্যের বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘আমরা ঝিগাতলায় আম্বালা ইনের সামনে যখন এলাম, তখন আবার মুহুর্মুহু গুলি শুরু হলো। আমরা সেখানে একটা কফি হাউজের ভেতর আশ্রয় নিলাম। তখন মাইকে বিডিআরদের একটা ঘোষণা শুনলাম। তারা বলছিলো “চ্যানেল আইয়ের একটি গাড়ি এখানে আছে, আপনারা দ্রুত চলে আসুন”। আমাদের গাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ দিতে কিছুক্ষণ গুলি বন্ধ করলো তারা। জওয়ানরা বললো, “আপনারা আসেন। মিডিয়ার সাথে আমাদের কোনো শত্রুতা নাই। আমরা শুধু আর্মি ঠেকাবো।”
তো আমরা সেখান থেকে অনেক রাত পর্যন্ত লাইভ করলাম। রাত দেড়টার দিকে তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম চ্যানেল আই এবং এটিএন বাংলার লাইভ সম্প্রচারে সর্বপ্রথম জানালেন তারা অনেক লাশ দেখেছেন এবং এই সংখ্যা ৩৫-৪০ জনেরও বেশি। বিডিআর মহাপরিচালক শাকিলের লাশ তিনি দেখেননি জানালেও শাকিলের নিহত হওয়ার খবর শুনে এসেছেন বলে জানান।’
বিদ্রোহের প্রথম দিন অর্থাৎ ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় আসলে কী ঘটছে তা জানার একমাত্র উপায় ছিলো বিদ্রোহীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা।
অস্ত্রহাতে নেয়া বিদ্রোহীদের সঙ্গে কথোপকথন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রথম দিনের শুরুর দিকে আসলে তাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ হচ্ছিলো না। দুপুর ২টার পর থেকে আমরা বিডিআর জওয়ানদের কাছে গিয়ে তাদের সাক্ষাতকার নেয়া শুরু করি। তখন তারা জানায় ‘অপারেশন ডাল-ভাত’ নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম এবং তাদের বঞ্চিত করার কথা বলে।
তখন কথা বলাও যে মারাত্মক ঝুঁকির ছিলো তা জানিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘ঘটনার দিন রাত সাড়ে তিনটার দিকে বিদ্রোহকারীরা হঠাৎ করে জানতে চাইলো সেখানে গণমাধ্যমের কারা কারা আছে। আমাদের ক্ষতি না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওরা আমাদের কাছে আসতে বললো। দেশি-বিদেশী মিলিয়ে বেশি কিছু সংবাদকর্মী তাদের কাছে যেতেই আবারও ফাঁকা গুলি শুরু করলো তারা। সন্দেহ নিয়ে তারা প্রশ্ন করলো,“এতো সাংবাদিক কেনো?” এই পরিস্থিতিতে আমাদের অনেক সহকর্মী প্রচণ্ড আতঙ্কে কান্না করছিলো।’
শুধু এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিই নয়, সাক্ষাতকার প্রচার নিয়ে সাংবাদিকতার নৈতিকতার দ্বন্দ্বে পড়ার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘তাদের এমন বক্তব্যের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করবে এমন কোনো বিবৃতি আমরা পাচ্ছিলাম না। কারণ দায়িত্বে থাকা উচ্চপদস্থ সেনারা ভেতরে জিম্মি। তাই চ্যানেল আই তা প্রচার করেনি। ’
রাষ্ট্রের জন্য স্পর্শকাতর এমন ঘটনার সংবাদ প্রকাশ-সম্প্রচারে সরকার এবং সংশ্লিষ্টদের নিয়ন্ত্রণ না থাকার আক্ষেপ প্রকাশ করেন মল্লিক। তিনি বলেন, ‘এতোবড় একটা ঘটনায় সরকার, আইএসপিআরসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর একটা ডেস্ক থাকা উচিৎ ছিল। অথচ আমরা দেখলাম ঘটনার ২ দিন পরে একজন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে একটা সেল খোলা হয়। এর আগে আমরা এক ধরণের সেলফ সেন্সরশিপের মধ্যে দিয়ে সংবাদ প্রচার করেছি।’
পেশা জীবনের এই বিভীষিকাময় পরিস্থিতি আজীবন মনে থাকবে জানিয়ে দুঃস্বপ্নের মতো সেই ঘটনা নিয়ে রেডিও টুডে’র সাংবাদিক সেলিম বাশার বলেন, ‘শাহবাগে একটি মেসে থাকতাম তখন। সকালে ওখান থেকেই গুলির শব্দ শুনছিলাম। বেলা গড়াতেই বুঝলাম বড় ধরণের কিছু একটা হচ্ছে। স্পষ্টভাবে কোনো কিছু জানার জন্য যে সংবাদ সূত্র দরকার, তা পাচ্ছিলাম না।
‘প্রথম দিনটা ছিলো অস্পষ্ট। আর দ্বিতীয় দিনটা ছিলো আমার জন্য আরও অন্যরকম। জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর পালাতে থাকা বিদ্রোহীদের সঙ্গে আমি দৌড়াতে দৌড়াতে কথা বলছিলাম। তারাই জানালো অনেককে হত্যা করা হয়েছে।’