‘এবং তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করো এবং পিতামাতার সাথে করো সদ্ব্যবহার। তাদের মধ্যে কেউ কিংবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উহ্’ শব্দ বলিও না এবং তাদেরকে ধমক দিও না। আর তাদের সাথে বলো শিষ্টাচারপূর্ণ কথা।’ (আল-কুরআন, সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৩)। পিতা-মাতার প্রতি আমাদের কী দায়িত্ব-কর্তব্য; তা পাক-কালামের এ আয়াত থেকে দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার।
মহিয়ান আল্লাহর অপার সৌন্দর্যময় এ শ্যামল পৃথিবী। অপরূপ তার দৃশ্যকলা। অনিন্দ্য সুন্দর ও মনোরম এ পৃথিবীর চিত্রপট দেখার ক্ষেত্রে যাদের অবদান, তারা হলেন আমাদের পিতা-মাতা। তাদের মাধ্যমেই আমাদের পৃথিবীতে আসা। শৈশব-কৈশরের অসহায়ত্বের সময় পার করে সবল-সুস্থ মানুষে রূপায়িত হওয়ার পেছনে যে মানুষগুলোর অক্লান্ত পরিশ্রম, তারাইতো আমাদের মা-বাবা।
জন্মের পর থেকে অননুমেয় কষ্টের বিনিময়ে তিলেতিলে বড় করেছেন আমাদেরকে। নিজেরা সুযোগ না নিয়ে দিয়েছেন অন্নবস্ত্র। করেছেন শিক্ষাদান। দেখিয়েছেন আলোর পথ। গড়েছেন সচলপূর্ণ মানুষে। নিঃস্বার্থ এ মানুষগুলোর অপার স্নেহ-ভালোবাসায় আমাদের এতটুকু পথচলা। তাদের প্রতি আমাদের তরফ থেকে দায়িত্ব-কর্তব্যগুলো দুটি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করা যায়। যথা:
এক. জীবিত অবস্থায়।
দুই. ইন্তিকালের পরে।
জীবিত অবস্থায় পিতামাতার প্রতি আমাদের করণীয়সমূহ হলো-
(ক) সর্বোত্তম সেবা নিশ্চিতকরণ। মহান আল্লাহর নির্দেশ, ‘তাদের সামনে ভালোবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলো : হে আমার প্রতিপালক! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। (আল-কুরআন, সুরা বনি ইসরাইল: ২৪)
(খ) নম্রভাষায় উত্তম ব্যবহার করা : কর্কশ, উচ্চবাক্য এবং ধমক দিয়ে তাদের সাথে কথা বলার স্থলে মাধুর্যপূর্ণ ভাষায় কথা বলা। যথাসাধ্য সর্বোচ্চ সম্মানসূচক শব্দ ব্যবহার করা। রব্বুল ‘ইজ্জাত ইরশাদ করেন, ‘আর তাদের সাথে বলো শিষ্টাচারপূর্ণ কথা।’ (আল-কুরআন, সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৩)। তাদের সাথে সদ্ব্যবহারের জোর তাগিদ এবং নির্দেশ দিয়ে পাক-কালামের অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘আর পিতা-মাতার সাথে পৃথিবীতে উত্তম ব্যবহার করো।’ (আল-কুরআন, সুরা লোকমান : ১৫)
(গ) তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য মনেপ্রাণে চেষ্টা করা।
(ঘ) চলাফেরা, কথাবার্তা ও উঠাবসায় নিষ্ঠার সাথে তাঁদের প্রতি আদব বজায় রাখা।
(ঙ) তাদের নাম ধরে না ডাকা।
(চ) অন্তরের অন্তস্থল থেকে তাদের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা রাখা।
(ছ) তাদের সেবা ও খিদমাতের জন্য প্রয়োজনে নফল ইবাদতসমূহ বর্জন করা।
(জ) তাদের একজন বা উভয়েই বার্ধক্যে উপনীত হলে যাবতীয় দেখভাল করা। অসুস্থ হলে সেবাশুশ্রুষা করা। অক্ষম হলে অন্নবস্ত্র ও বাসস্থানের নিশ্চিত করা।
(ঝ) অশালীন ও অশ্লীল-অশ্রাব্য ভাষায় তাদেরকে গালিগালাজ করা। রসুলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কবিরা গুনাহসমূহের মধ্যে মটাই অন্যতম। যে, নিজ পিতা-মাতাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করা।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ, পৃ. ৪১৯)
ইন্তেকালের পর পিতামাতার প্রতি আমাদের করণীয়
(ক) তাদের কৃত অছিয়ত পূর্ণ করা।
(খ) আল্লাহর দরবারে তাদের মাগফিরাত কামনা করে দু‘আ করা। পবিত্র কুরআনের ঘোষণা, এবং বলো, হে আমার প্রতিপালক! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। (আল-কুরআন, সুরা বনি ইসরাইল : ২৪)
(গ) ফাতিহা, দান-সদকা ও তিলাওয়াতে কুরআনের মাধ্যমে তাদের জন্য সাওয়াবের ব্যবস্থা করা।
(ঘ) সপ্তাহান্তর তাদের কবর যিয়ারত করা। (তাফসিরে ফাতহুল আজিজ)
(ঙ) তাদের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সদাচারণ করা।
(চ) তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। হাদিসের বাণী, ‘পিতার ইন্তিকালের পর সন্তানসন্ততি তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করাই মাতাপিতার সাথে সদাচারণ করার অন্তর্ভূক্ত।’ (আল-হাদিস)
পিতা-মাতা আমাদের অমূল্যরতন। তাদের সাথে সদাচার, তাদের সেবাশুশ্রুষা, খোঁজখবর রাখা এবং খিদমাতের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন কর যাবে। অন্যথা, আমাদের ইহ-পারলৌকিক জীবন বিফল! মায়ের সেবার কারণেই হযরত ওয়াইছ ক্বরনি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সাহাবিয়্যাতের মর্যাদায় ভূষিত হননি। এ থেকে আমাদের অনেক শিক্ষনীয়।
তাই, আসুন আমরা আমাদের পিতা-মাতার সাথে সর্বোচ্চ সম্মান বজায় রেখে তাদের করুণার শামিয়ানায় আশ্রয় নিই। অর্জন করি মহিয়ান আল্লাহর নৈকট্য। নিশ্চিত করি তাদের পদতলে সুপ্ত থাকা বেহেশত।