জনাব আবুল কাশেম ফজলুল হক, শ্রদ্ধেয় পিতা ও শিক্ষক আমাদের ক্ষমা করবেন। গণমানুষের কবি দিলওয়ারের কবিতার শিরোনাম ধার করে, আপনার পিতার অধিক শিক্ষক অন্তরের কাছে এই প্রার্থনা। ক্ষমা প্রার্থনা এজন্য যে, পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বোঝা অর্থাৎ “পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ” নিয়েও আপনি কেবল একজন শোকগ্রস্থ পিতা নন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের একজন গর্বিত শিক্ষক থেকে সারা জীবনের অনুশীলন শিক্ষকতার মহান আদর্শ অনুসরনে জাতির সামনে শিক্ষকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
কিন্তু আমরা কিংবা আমাদের মেধা ও মানবিক বোধ হীন রাজনীতিবিদ, চিন্তার দৈন্যে আক্রান্ত বাণিজ্যিক মিডিয়া, সুশীল কিংবা কুশিল, সুমতি অথবা কুমতি, বিচার কিংবা প্রশাসন যন্ত্র কেউ তা অনুধাবনে সমর্থ হইনি। নিজেদের এই দীনতা নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা ভিন্ন আর কি বা আমরা করতে পারি , এই অদ্ভুত উটের পিঠে সওয়ার স্বদেশে ?
তবে শ্রদ্ধেয় পিতা ও শিক্ষক , আমরা আপনাকে এইটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি এই ক্ষমা প্রার্থনা কোন রাজনৈতিক অমানবিক বক্তব্যের জালে ফেঁসে ততোধিক রাজনৈতিক প্রার্থনা নয়, এই প্রার্থনা বুকের গভীর থেকে উঠে আসা আকুতি, আশাকরি ক্ষমা করবেন ।
স্যার, আপনার সন্তান হারানো পরবর্তী বক্তব্য , বিচার না চাওয়া হত্যাকারীদের তাদের ভুল অনুধাবন এবং ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বাড়াবাড়ির বিষয়ে যা বলেছেন তাকে দুটি পর্যায়ে দেখা যায় ।
প্রথমতঃ আপনার বক্তব্য আমি দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সেই গর্বিত শিক্ষকদের বক্তব্য হিসেবে জাতির প্রয়োজনে যারা ব্যাক্তিগত শোক, চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে জাতির কণ্ঠ ধারন করেছেন । উদাহরনের অভাব আর দলবাজদের তাণ্ডবে যাদের কথা আমরা ভুলতে বসেছিলাম । সারা জাতি যখন নিরাপত্তাহীন, বিচারহীনতার জালে আবদ্ধ, দেশী-বিদেশী কেউ নিরাপদ নয়, আজ আপনার মতই লক্ষ পিতা কিংবা শিশু যখন তার কাজের জন্য বাইরে যাওয়া সন্তান কিংবা পিতার নিরাপত্তা নিয়ে প্রতিক্ষণ আশঙ্কায় ভোগে তখন জাতির একজন শিক্ষক হয়ে কেবল নিজের সন্তানের নিরাপত্তা দিতে বিফল রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে কি বিচার চাইতে পারেন আপনি? স্যার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের একজন শিক্ষক কি জাতির অভিভাবক নন? অভিভাবক হয়ে যখন আপনি দেখেন আপনার শত সন্তান কোন সন্ধান না রেখেই উধাও হয়ে যায়। আর মাসের পর মাস রাষ্ট্র যন্ত্র কেবল তাদের খুজে বেরায়, তাদের কাছে কেবল নিজ সন্তানের হত্যার বিচার দাবী আপনার গর্বিত শিক্ষক অন্তরে কতটা হীনমন বোধ জাগাত তা অনুধাবনের ক্ষমতা কি এদের আছে?তাই নাগরিক ও পিতার অন্তর নিয়ে অক্ষম রাষ্ট্রের কাছে প্রার্থনা না করে সন্তানের ঘাতকদের ক্ষমার বিনিময়ে সবার শুভ বুদ্ধির উদয় কামনা করেছেন , এ মুহূর্তে এর কোন বিকল্প কি আছে জাতির সামনে ?স্যার, প্রশ্ন হল এই শুভ বুদ্ধির উদয় যাদের জন্য একান্ত প্রযোজ্য তারা কি আপনার বার্তার গুরুত্ব অনুধাবন করেন বা করতে প্রস্তুত ?
স্যার, সারা জীবন শিক্ষকতা অর্জিত দূরদৃষ্টি, চর্চিত মেধা, জ্ঞানের আলোকে আলোকিত অন্তর নিয়ে আপনি যখন শিক্ষকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হন শোক সামলে, যখন জাতির সামনে এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় সংকটের দিকটি তুলে ধরেন , যখন উচ্চারন করেন ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে বাড়াবাড়ি বন্ধ হোক, তখন উভয়েই একজোটে আপনাকে প্রতিপক্ষ সাব্যস্ত করবে এটাই স্বাভাবিক। সরকার বলেন জঙ্গি নেই , আমরা দেখি ধর্মের নামে ধর্ম রক্ষার নামে তারা ঘোষণা দিয়ে হত্যা করে। জানতে ইচ্ছে করে ধর্মের নামে এই মানব হত্যা যদি জঙ্গিবাদ না হয় জঙ্গিবাদ তবে কি , জঙ্গি তবে কারা ?
আবার ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে ধর্মহীনতার দোহাই দিয়ে একদল জ্ঞানপাপী যখন ধর্মীয় মহান পুরুষদের নিয়ে অশ্লীলতায় মাতেন, কুরুচি আর কুৎসা প্রচার যাদের কাছে বাকস্বাধীনতা ! তখন সমাজের ভিত্তিমূলে যে আঘাত আসে তা অনুধাবন করতে বলেছেন উভয়কেই। যে উচ্চারন জাতিকেও দায়মুক্ত করে বটে। নুপংসুক আমরা এই সহজ সত্যটা উচ্চারনে বড় ভীত যে স্যার ।
দ্বিতীয়ত : স্যার, একজন শিক্ষক এর পাশাপাশি রাষ্ট্রের একজন প্রবীণ নাগরিক ও বটে আপনি। সেই সাথে দুঃখজনক হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাসিন্দা। দুঃখজনক বলছি এজন্য যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অধিবাসী হিসেবে আপনি জানেন স্বাধীনতা পরবর্তী অত্র এলাকার একটি হত্যাকাণ্ডের খুনিদের শাস্তি হয় নি। এমন কি ইতিহাস পরিবর্তনকারী ডাঃ মিলন হত্যার সাজা পেতে হয় নি কাউকে! আমরা যাকে হিন্দি সিনেমা “নো ওয়ান কিলড জেসিকা” অনুকরনে বলেছিলাম ” নো ওয়ান কিলড ডাঃ মিলন ” ! সব রাজনৈতিক হত্যাই বিচারহীন সংস্কৃতির চোরা স্রোতে চাপা পরেছে কেবল বাদী পক্ষের প্রাপ্তি প্রাথমিক আশ্বাস ও পরবর্তীতে নানান হুমকি আতংক এবং আদালতের বারান্দায় পায়াচারি। রাষ্ট্রের একজন প্রবীণ নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের এই অমার্জনীয় অপরাধের প্রতিবাদে আপনি সন্তান হত্যার বিচারের দাবী ত্যাগ করা ছাড়া আর কি করতে পারতেন ? সন্তান হত্যার বিচার না চেয়ে আপনি এই ভ্রান্ত মতাবলম্বীদের শুভ বুদ্ধির উদয় কামনা করেছেন , বিনিময়ে তাদের দিয়েছেন ক্ষমা। কারন আপনি জানেন এদের শুভ বুদ্ধির উদয় না হলে এক দীপেনে শেষ হবার নয় এই নির্মমতা যা শেষ পর্যন্ত জাতিকে বিপর্যস্ত করবে, শত দীপন হারা করবে ।
স্যার, শুরুতে ক্ষমা প্রার্থনা মঞ্জুরের আবেদন করেছি, শেষে আপনার অনুমতি ছাড়াই একটি ক্ষমা প্রার্থনা মঞ্জুর করছি।
জনৈক মান্যবর আপনার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তার বলা কথার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছেন। মান্যবর , আমরা তা গ্রহন করলাম সেই সাথে আমাদের নেত্রীর উচ্চারিত ,” ফরগিভ নট ফরগেট” কথাটি মনে করিয়ে দিয়ে বলতে চাই মানবতা বিবর্জিত রাজনীতি কাম্য নয় , নিরাপত্তা না দিতে পারেন সমবেদনা জানাতে সমস্যা কোথায় ? মান্যবর, আমরা আপনাদের আগামী ভুমিকা দেখার অপেক্ষায় রইলাম ক্ষমা মঞ্জুর পূর্বক ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)