স্থাপত্যশৈলীর অপরূপ নিদর্শন সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম। ভেতরে নান্দনিক কাঠামো আর বাইরে ছায়াশীতল প্রাকৃতিক পরিবেশ। পাহাড়, চা বাগান, ঘন বনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে অনিন্দ্য সুন্দর গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড, মিডিয়াবক্স, গ্রিন গ্যালারি, ক্লাব হাউজ। বিপিএল খেলতে আসা মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমদের কণ্ঠে শোনা গেছে স্টেডিয়ামটির বন্দনা। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন জানিয়েছেন মুগ্ধতার কথা। অনেকের চোখে দেশের তো বটেই, উপমহাদেশের সুন্দরতম স্টেডিয়াম এটি। কিন্তু যার আঁকা নকশায় মূর্ত হয়েছে সৌন্দর্য, সেই মাসুদুর রহমান খান অতটা খুশি হতে পারছেন না। তাকে না জানিয়ে স্টেডিয়ামের মিডিয়া সেন্টারের পেছনের পাহাড় কেটে ফেলায় মন ভারাক্রান্ত এই স্থপতি।
বিপিএল যখন মাঠে গড়ায় স্থপতি মাসুদুর রহমান তখন দেশের বাইরে। মঙ্গলবার ফিরে কথা বললেন চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে। জানালেন নকশার পেছনের গল্প, স্টেডিয়াম ঘিরে স্বপ্ন ও কিছু আক্ষেপের কথা।
গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডের দিকে তাকালে ব্রিটিশ স্থাপত্যের সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্য পাওয়া যায়। নকশা নিয়ে আপনার থিম কী ছিল?
মাসুদুর রহমান: এটা বাংলাদেশ ক্রীড়া পরিষদের সাধারণ একটা স্টেডিয়াম ছিল। অন্য জেলা বা বিভাগীয় স্টেডিয়াম যে রকম থাকে। আমি পরিদর্শনে এসে ছোট্ট একটা প্যাভিলিয়ন দেখি, যেটি খুবই নিম্নমানের। আমার মনে হল সিলেটের কোনও ঐতিহ্য বহন করছে না। সিলেটের পাহাড়, চা বাগানের যে রূপটা আছে সেটাকে ফুটিয়ে তোলার চিন্তা করলাম। এখানে কিছু ঘরবাড়ি দেখলাম। পাহাড়ের সঙ্গে ঘরগুলো যেরকম হয়, চা বাগান থাকে। ঐতিহ্যের একটা নিদর্শন থাকে। ব্রিটিশ স্থাপত্যের একটা প্রভাব ছিল এখানে। আমি সেটাই আমাদের দেশের উপাদান আর ব্রিটিশ স্থাপত্য চিন্তা করে নতুন একটা বিল্ডিং করলাম। যেটি লাল রঙের (গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড)।
অপর প্রান্তের মিডিয়া সেন্টার?
মাসুদুর রহমান: মিডিয়া সেন্টারের জন্য একটা টিভির আদল করলাম, চারকোনা ভবন। মিডিয়া মানেই তো কম্পিউটার মনিটরের সঙ্গে একটা সম্পর্ক। মনিটর বা টিভির সাদৃশ্য করার জন্য ওটার আদলটা চেঞ্জ করে দিয়েছি। কেউ এসেই যেন বুঝতে পারে কোন জায়গায় কে বসছে। খেলার কেউ বা দর্শক এসে বুঝতে পারবে কে কোথায় আছে। বিল্ডিংয়ের চেহারাই বলে দেবে মিডিয়া সেন্টার, প্রেসবক্স কী। ভেতরে কী হচ্ছে। দূর থেকে তাকালে দেখবেন মিডিয়া সেন্টার ভবন চারকোনা, টেলিভিশনের মতো।
কাজ কখন শুরু হয়?
মাসুদুর রহমান: ২০১১ বিশ্বকাপ সামনে রেখে। তখন টুটুল ভাই (দেওয়ান শফিউল আরেফিন, বিশ্বকাপের সমন্বয়ক) ছিলেন। তার সঙ্গে প্রথমে আমি থিমটা নিয়ে আলোচনা করি। তিনি খুব উৎসাহিত হন। তারপর নাদেল ভাই (শফিউল আলম চৌধুরী, সিলেট বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক) আছেন উনিও বিভিন্ন সময়ে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন।
নকশায় আর কী কী আছে যা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি?
মাসুদুর রহমান: মিডিয়া সেন্টারের পেছনের যে পাহাড় ছিল কেটে ফেলা হয়েছে। এটাতে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। উঁচু পাহাড়টা মাঠে বসেই দেখা যেত। আমাকে জানালে আমি কোনোভাবেই এটাকে কাটতে দিতাম না। কিছু কিছু কাজ করে ফেলেছে যা দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি করবে। এটা ঠিক হয়নি। আমি শুনে খুব বিরক্ত হয়েছি। আমার কনসেপ্ট সিলেটের যে চা বাগান, পাহাড়। এবং তাদের সঙ্গে ব্রিটিশদের যে সম্পর্ক, সিলেটের সঙ্গে লন্ডনের সম্পর্ক… সেই জিনিসটাই অবচেতন মনে আমার ডিজাইনের মধ্যে কাজ করেছে। আমার পরিকল্পনার মধ্যে আরও অনেক কিছুই আছে। গ্রিন গ্যালারি যেটা আছে। এটা আরেকটু ঢালু হবে। আরও কিছু কাজের একটা প্রস্তাব দেওয়া আছে মন্ত্রণালয়ে। কতটুকু ক্রীড়া পরিষদ আগাচ্ছেন তা আমি জানি না। নতুন যে গ্যালারি হয়েছে তার নিচের অংশটার টয়লেট ব্যবস্থা প্ল্যান অনুযায়ী ৬০ ভাগও হয়নি। যেরকমটা চেয়েছিলাম সেটা হয়নি, যেনতেনভাবেই কাজটা শেষ হয়েছে।
এছাড়া দেখবেন দোতলা যে গ্যালারিটা আছে, তার উপর তাবুর মতো ডিজাইন করা। সেখানে লাইট ছিল। কিন্তু তাও রাখা হয়নি। যদি লাইট থাকতো, সেটি রাতে জ্বলে থাকতো। অনেক দূর থেকে স্টেডিয়াম রাতে অন্য একটি রূপ দিত। এছাড়া এ তাবুটি আসলে কিন্তু লাইট সেড হিসেবেও আমার নকশাতে রাখা ছিল। কিন্তু তা রাখা হয়নি। তবে ওনারা কথা দিয়েছেন আমাদের ড্রয়িংয়ে যেভাবে আছে সেভাবে করবেন, বলছেন যে আগামীতে প্রজেক্ট হলে করে দেবেন এই জিনিসগুলো।
পাহাড় কেটে ফেলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্টেডিয়ামের ক্ষতির শঙ্কা আছে কিনা?
মাসুদুর রহমান: তা তো আছেই। পাহাড় তো প্রাকৃতিক জিনিস। আপনি তার ক্ষতি করলে সেও ক্ষতি করবে। সিলেটের যে স্টেডিয়াম পুরোটা কিন্তু পাহাড়ের ওপরই। মানুষ বিভিন্ন সময়ে কেটে কুটে এটির চেহারা নষ্ট করে ফেলেছে। এই স্টেডিয়ামও পাহাড়ের অংশ। পাহাড়টা সমান করে জায়গাটা বের করা হয়েছে।
শুনেছি মিরপুর স্টেডিয়ামের নকশাও আপনি করেছেন?
মাসুদুর রহমান: হ্যাঁ, মিরপুর স্টেডিয়াম আমারই নকশা করা। এছাড়া বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের নতুনভাবে যে সংস্কার কাজ হয়েছে সেটাও আমি করেছি।
বিপিএল তো দেখছেন?
মাসুদুর রহমান: দেখিনি। দেশে ছিলাম না। গতকাল রাতে বাংলাদেশে এসেছি।
স্থানীয়রা তো বটেই, দেশি-বিদেশি ক্রিকেটার, বিসিবি কর্মকর্তা, সাংবাদিক সবাই খুব প্রশংসা করছেন এই স্টেডিয়ামের…
মাসুদুর রহমান: প্রশংসা শুনতে কার না ভাল লাগে? আমারও লাগছে। তবে নকশা অনুযায়ী পুরো কাজটা দ্রুত শেষ করে আন্তর্জাতিক ম্যাচ হলে আরও বেশি ভাল লাগবে।