চলতি বছর পাঠ্য বই থেকে বাদ পড়া গল্প-কবিতা নিয়ে সংকলন প্রকাশ করেছেন এক তরুণ। বইটি বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। নতুন সংস্করণের পর আবারও বিতরণ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন সংকলিত বইটির সম্পাদক ও গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী সমুদ্র সৈকত। সংকলনটির নাম ‘যা আমাদের পড়তে দেয়নি’।
সমুদ্র সৈকত চ্যানেলআই অনলাইনকে বলেন, পাঠ্যবই থেকে ২০১৭ সালে বাদ দেয়া লেখাগুলো নিয়ে এ সংকলন। আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা হরেন্দ্র নাথ মণ্ডল-এর পরিকল্পনায় সংকলনটি করা হয়েছে।
মারুফ রসূলের কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা প্রকাশ করে তিনি বলেন, তার আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া সংকলনের কাজটি শেষ করা কঠিন হতো।
বিভিন্নভাবে উদ্যোগের পাশে থাকার জন্য ইব্রাহিম খলিল সবাক, নাহিদা নিশি, শোভন মজুমদার, রাকেশ মণ্ডলসহ সংশ্লিষ্ট অন্যদেরকও তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
তিনি বলেন: বইটি পড়ে যদি একজন মানুষও কিছুটা চিন্তাশীল এবং মেধা ও মনন দিয়ে বৈচিত্রতার সৌন্দর্য্যকে অনুভব করে সেটাই হবে আমাদের সার্থকতা। শিগগিরই বইটি পিডিএফ আকারে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হবে বলেও জানান তিনি।
‘যা আমাদের পড়তে দেয়নি’ সংকলনটির প্রচারে সহায়তা করছে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী।
এ বিষয়ে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কঙ্কন নাগ বলেছেন, বইটি আমরা প্রকাশ করিনি। বইটির প্রচারে আমরা সহায়তা করছি। এটি খুবই ভালো উদ্যোগ।
চলতি বছর ছেলেমেয়েদের হাতে পাঠ্যপুস্তক পৌঁছানোর পর ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। প্রথম থেকে দশম শ্রেণিতে অনেক বছর ধরে পড়ানো হয়েছে এমন বেশ কিছু আধেয় পাল্টে দেয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, হেফাজতে ইসলামের দাবি মেনেই বইয়ে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
বিষয়টি কেবল আলোচনা-সমালোচনাতেই থেমে থাকেনি, এ নিয়ে রিটও হয়েছে উচ্চ আদালতে। প্রখ্যাত লেখকদের লেখা বাদ দেয়াকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না জানতে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
‘যা আমাদের পড়তে দেয়নি’ সংকলনটিতে ১১টি কবিতা ও পাঁচটি গল্প স্থান পেয়েছে। এগুলো আগের পাঠ্যবইগুলোতে ছিল, কিন্তু এ বছর বাদ দেয়া হয়। কবিতাগুলো মধ্যে রয়েছে- অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদের ‘বই’, গোলাম মোস্তফার ‘প্রার্থনা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলাদেশের হৃদয়’, সানাউল হকের ‘সভা’, জসীম উদ্দীনের ‘দেশ’, ভারত চন্দ্র রায় গুণাকরের ‘আমার সন্তান’, জ্ঞান দাসের ‘সুখের লাগিয়া’, বাউল লালন সাঁইয়ের ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটা দুলছে’ এবং রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লার ‘খতিয়ান’।
‘বই’ ও ‘প্রার্থনা’ কবিতা দুটি পঞ্চম শ্রেণিতে ছিল, ‘সভা’ কবিতাটি ছিল ষষ্ঠ শ্রেণিতে, ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ কবিতাটি ছিল সপ্তম শ্রেণিতে, ‘দেশ’ অষ্টম শ্রেণিতে। বাকিগুলো ছিল নবম ও দশম শ্রেণির বইয়ে।
পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ পড়া এবং ‘যা আমাদের পড়তে দেয়নি’ সংকলনে থাকা গল্পের মধ্যে সত্যেন সেনের ‘লাল গরুটা এবং এস ওয়াজেদ আলীর ‘রাঁচি ভ্রমণ’ ছিল ষষ্ঠ শ্রেণিতে। রনেশ দাশগুপ্তের ‘মাল্যদান’ গল্পটি সপ্তম শ্রেণিতে ছিল, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাঙালির বাংলা’ গল্পটি ছিল অষ্টম শ্রেণিতে এবং সঞ্জীবচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের ‘পালামৌ ভ্রমণ কাহিনি’ ছিল নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে।
‘যা আমাদের পড়তে দেয়নি’ বইয়ের ভূমিকায় সম্পাদক সমুদ্র সৈকত লিখেছেন, যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ। ২০১৭ সালের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রণীত কয়েকটি পাঠ্যবই হাতে পাওয়ার পর অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম, এসব বই থেকে প্রগতিশীল ও ভিন্ন চিন্তার কয়েকজন লেখকের লেখা বাদ দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে জানা গেল, মৌলবাদী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের দাবির প্রেক্ষিতে পাঠ্য বইয়ে এই পরিবর্তনগুলো করা হয়েছে।সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী হেফাজতে ইসলামের এই অযৌক্তিক পরিবর্তনের দাবিগুলো মেনে নিয়ে পাঠ্য বইয়ে যে সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হলো, তা তীব্রভাবে নিন্দনীয়। আর, যে প্রক্রিয়ায় পাঠ্য বইয়ে এই পরিবর্তনগুলো করা হলো, তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাবিরোধী এবং আত্মঘাতী।
তিনি আরো লিখেন: আমি মনে করি পাঠ্য বই হওয়া উচিত সার্বজনীন এবং পরমত সহিষ্ণু চেতনার। বইগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যেন সহনশীল ও মানবিক হয় এবং ভিন্নমত ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, পাঠ্যবই প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিত। কিন্তু, পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বীজ যদি শিক্ষার্থীদের মনে এভাবে বপন করা হতে থাকে, তাহলে দিন শেষে আমাদের সব শুভ চেষ্টাই ব্যর্থ হবে।
‘ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা চিন্তা করলেই আমার মনে ভেসে ওঠে আমার আড়াই বছর বয়সী ভাগ্নে ‘কিঞ্জল’-এর মুখ। বর্তমান শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি কিঞ্জলের মতো শিশুরাও আগামীতে আমাদের পাঠ্যবই পড়ে অসাম্প্রদায়িক, সার্বজনীন ও মানবিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যাবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। শুধু, আমরা যেনো ওদের ‘মানবিক মানুষ’ হবার পথটা বন্ধ করে না দেই।’
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক অজয় রায়ের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি খুবই ভাল উদ্যোগ। মৌলবাদীদের মাথায় বার বার আঘাত করতে হবে।
তিনি বলেন: সরকারের সমর্থন ছাড়া এত বড় ঘটনা (লেখা বাদ দেয়া) ঘটতে পারে না। পাঠ্যপুস্তক তৈরিতে যাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়, মৌলবাদীদের সাথে তাদের যোগসাজশ থাকতে পারে। এদের সবাইকে চেতনার জায়গা থেকে আঘাত করতে হবে।