কিশোরগঞ্জের নিকলি, হিলোচিয়া, সরারচর, মঠভাঙ্গার বাজার ও কুরশার মোড়ে লাঠিতে ভর দিয়ে ঠকঠক করে হেঁটে বেড়ান বীর মুক্তিযোদ্ধা সখিনা। হেঁটে হেঁটে অগ্নি ঝলসানো চোখে যেন একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন প্রায় শতবর্ষী এই নারী। সখিনার গ্রামের বাড়ি নিকলি উপজেলার গুরুই গ্রামে। তার সাথে এই প্রতিবেদকের দেখা হয় হিলোচিয়া বাজারে।
পল্লী চিকিৎসক বাবুল পালের দোকানের পেছনে সখিনার সাথে আলাপচারিতায় উঠে আসে স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক অজানা বিষয়। যুদ্ধ ও যুদ্ধের স্মৃতিচারণ ছাড়া সখিনার আপন বলে কিছু নেই। হিলোচিয়া বাজারের কাছে বরমাই পাড়া গ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়ার বাড়িতে আশ্রিত থাকেন তিনি। লাল মিয়াও কয়েকমাস আগে মারা গেছেন। তার পরিবারের অন্যরাও সখিনাকে তাদের পরিবারের সাথে মিশিয়ে নিয়েছেন।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয় এই এলাকার কুখ্যাত ডাকাত বসু। বসু সখিনার বোনের ছেলে মতিউর রহমানকেও যুদ্ধে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। মতিউর রহমান যুদ্ধে যাচ্ছে শুনে সখিনাও তাদের সঙ্গী হতে আগ্রহ প্রকাশ করে। কারও নিষেধ সখিনা মানলোনা। ডাকাত বসু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে গড়ে তুলে দুর্ধর্ষ বসু বাহিনী। ধীরে ধীরে নিকলি বাজিত পুরে পাকবাহিনীর আতঙ্ক হয়ে ওঠে তার বাহিনী। সখিনা এই বসু বাহিনীর গোয়েন্দা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে কাজ করত। বসু সম্পর্কে নানা কথা প্রচার ছিল পাক বাহিনী ও তার দালালদের মাঝে। বসু একটা ভয়ংকর, খুনী সে একাধারে ৭দিন পানির নিচে থাকতে পারে ইত্যাদি। সখিনা পাকবাহিনীর হাতে ধৃত হয়ে একবার সরারচর ক্যাম্পে আটক হন। পাক সেনারা তার কাছে বসুর অবস্থান সম্পর্কে জানতে চায়। সখিনা উর্দুভাষায় কথা বলা শুরু করে নিজেকে পাকসেনাদের বন্ধু হিসাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। সুযোগমত সখিনা সরারচরের পাকবাহিনীর ক্যাম্প হতে পালিয়ে আসে। পালানোর সময় ওখান হতে একটি দা নিয়ে আসে। সখিনা বলেন, পাকবাহিনীর দা দিয়েই পাকবাহিনীর দালালদের কুপিয়ে মেরেছি।
সখিনা বলেন, কইরাল হতে ১২ জন পাকবাহিনীর দালাল ধরে আনে কুরশার মোড়ে। সখিনা মুক্তিসেনাদের বলেন এদের কয়েকজনকে মারার ভাগ আমাকে দেন। ওখান হতে দুইজন সখিনার ভাগে পড়ে। এদেরকে নিয়ে যায় ছেতরা স্কুলে।পাকবাহিনীর দালাল দুটোকে পাকবাহিনীর দা দিয়েই সখিনা কুপিয়ে হত্যা করেন। সখিনা নিজেই এই দুই দালালকে ছেতরা সড়কের পাশে মাটি চাপা দেন।
এভাবে আরও তিন দালালকে হত্যা করেছেন বলে জানান সখিনা। চোখের সামনে শহীদ সাথী সহযোদ্ধাদের লাশের স্মৃতিস্মরণে এলে তার চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে। ডাকাত বসু ও তার মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠা সম্পর্কে বলেন বসু মুক্তিযুদ্ধে না এলে নিকলি বাজিতপুরের মানুষ বাঁচতোনা। বসু সম্পর্কে অনেক কথা চালু আছে নিকলি বাজিতপুরের মুরুব্বিদের মুখে মুখে। বসু আসছে বললে বাচ্চার কান্না বন্ধ হয়ে যেত, মানুষ কাটা তার কাছে লাউ কুমড়া কাটার সমান। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে বসু আবার ডাকাত হয়ে যায়। হিলোচিয়া বাজারের অদূরে ছাতিরচর গ্রামের সামনে ঘোড়াউত্রা নদীর পাড়ে বসুর শরীরের মাংস, হাড্ডি কেটে নদীতে ফেলে মাছকে খেতে দিয়েছিল।
ছাতির চর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হানিফ ইসলাম বলেন, বসু একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা এটা যেমন সত্য একজন কুখ্যাত নিষ্ঠুর খুনী এটাও তেমন সত্য। বসু খুন হওয়ার পরে মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ে। জনতার দাবীর মুখে নিকলি থানা পুলিশ বসু হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে পারেনি। তারা লিখে দেয় ডাকাত বসু গণপিটুনিতে মারা যায়। সখিনাও স্বীকার করেন স্বাধীনতার পরে বসুর পুনরায় ডাকাত হয়ে ওঠা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সখিনা একবার ঢাকায় স্যালুট দিয়ে বঙ্গবন্ধুর গাড়ি থামিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধু সখিনাকে বাসায় দেখা করতে বলেন। সখিনা দেখা করতে যান ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে। নিচতলায় রাত্রি যাপন করেন। সখিনা বলেন,শেখ কামাল সকালে আমাকে নাস্তাও খাইয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন সখিনা। বলেন তার যুদ্ধে যোগ দেয়া ও বোনের ছেলে মতিউর রহমানের শহীদ হওয়ার কথা। বঙ্গবন্ধু সখিনাকে বলেন, আপনি মতিউরের খালা তাই আমারও খালা। একমাস পরে আরেকবার আমার সাথে দেখা করতে আসবেন। এই বলেই সখিনা কেঁদে ওঠেন, বলেন আর দেখা করা হলোনা। খুনীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ফেলে।
হিলোচিয়া বাজারের পল্লি চিকিৎসক বাবুল পাল বলেন, সহায় সম্বলহীন অসুস্থ সখিনা বিবিকে দেখলে ভীষণ খারাপ লাগে। উন্নত চিকিৎসা ও সেবা পেলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার ছাত্রলীগ নেতা আতিকুল ইসলাম জুয়েল বলেন,আমরা যুদ্ধ দেখিনি। কিছুদিন পরে হয়ত দেশে আর কোনো জীবিত মুক্তিযোদ্ধা থাকবেন। সখিনা বিবিসহ সকল মুক্তিযোদ্ধার কাছ হতে যুদ্ধের নানা ঘটনা, ইতিহাস সংরক্ষণ ও প্রচার করলে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবে বলেই আমার বিশ্বাস।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)