চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

পাকিস্তানী সাপের বাচ্চারা কিলবিল করছে

ব্লগার শব্দটির সঙ্গে কখন পরিচয় বাংলাদেশের মানুষের? ঘাড় ঘোরানোর দরকার নেই, চোখ বন্ধ করে একটু পেছনে তাকান। খুব বেশি পেছনে যাওয়ার দরকার নেই, মাত্র ৩৩ মাস। দুই হাজার ১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারির আগে এদেশের খুব বেশি মানুষের ব্লগার শব্দটির সঙ্গে পরিচয় ছিলো না। ওইদিন এবং তার পরে যে মানুষ ব্লগার এবং ক্লগারদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে তার কারণ এক অসাধারণ গণজাগরণ।

মৃত্যুদণ্ডের বদলে আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়ায় মানুষ যখন ঘরে বসে ফুঁসছিলেন, চোখের জল শুকিয়ে যাওয়া শহীদ পরিবারের সন্তানেরা আরো একবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন, কিন্তু কার কাছে কিভাবে নালিশ জানাবেন বুঝতে পারছিলেন না; তখন যারা ক্ষুব্ধ সব মানুষকে রাস্তায় নেমে আসার সুযোগ করে দিয়েছিলো তারা একদল ব্লগার। তার পরের ইতিহাস সবার জানা।

গণজাগরণের প্রবল গণচাপে আইন সংশোধন করতে বাধ্য হয় সরকার। প্রসিকিউশন রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে আপিল করার সুযোগ না রেখে যুদ্ধাপরাধীদের বেঁচেবর্তে থাকার যে কৌশলী সুযোগ রাখা হয়েছিলো আইনে পরিবর্তন এনে তা রদ করা হয়। এর ফলে আপিল হলে যাবজ্জীবন রায়ে ‘ভি-চিহ্নের’ নামে আসলে বাংলাদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো কসাই কাদেরকে তার অপরাধের দেনা মেটাতে হয় ফাঁসিতে ঝুলে।

তবে সেই দেনা-পাওনা মেটানোর পথটা আগের মতো পরেও খুব সহজ ছিলো না। শাহবাগে গণজাগরণ শুরু হলে একে ‘বিডিআর ট্র্যাজেডি’র মতো সরকার পতনের আরেকটি ‘মওকা’ মনে করেছিলো জন্ম থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের সঙ্গে মুখচুম্বনে থাকা বিএনপি। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম পরিস্কারভাবে শুধু যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথা জানিয়ে দিলে বেগম খালেদা জিয়ার জ্বলুনি শুরু হলে সেটা গোপন না করে তিনি শাহবাগকে নাস্তিক ব্লগারদের সমাবেশ হিসেবে উল্লেখ করে যে বক্তৃতা-বিবৃতি শুরু করেন সেই ধারাবাহিকতায় গোয়েবলসীয় প্রোপাগান্ডা শুরু করে মাহমুদুর রহমানের ‘আমার দেশ’।

ব্লগারদের মাধ্যমে শুরু হয়ে শাহবাগ লাখো মানুষের গণজাগরণের মঞ্চ হলেও এভাবে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয় যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়া মানেই ব্লগার এবং ব্লগার মানেই নাস্তিক। আর সেই তথাকথিত নাস্তিকদের বিরুদ্ধে মাঠে নামে এতোদিন অজানা-অচেনা এক সংগঠন নাম যার হেফাজতে ইসলাম। হেফাজত এরপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ ৪২ জনের মৃত্যুর কারণ হয়ে যে তাণ্ডব চালিয়েছে সেটা কারো অজানা নয়।

খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক স্বার্থে আর জামায়াত তার যুদ্ধাপরাধী নেতাদের বাঁচানোর লক্ষ্যে হেফাজতকে মাঠে নামালেও সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, আর কোনো গণজাগরণ যাতে না ঘটে সেজন্য আওয়ামী লীগ সরকারও তলে তলে হেফাজতকে উস্কানি দিয়েছে। সরকারের পক্ষে হেফাজতকে জমি-জিরেত এবং অন্য সুবিধা দেয়ার কথা বাদ দিলেও তাদের তাণ্ডবের বিচার না হওয়া এর এক বড় প্রমাণ। এভাবে হেফাজত নামের সাপটিকে দুধকলা দিয়ে পোষ মানিয়ে আর বাংলাদেশে সব ধরণের জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বটবৃক্ষ যে জামায়াত, তার নেতাদের ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচারের মুখোমুখি করে সরকার আপাতঃ দৃষ্টিতে বড় বড় সাপগুলোকে ঝাপিতে পুরে ফেলতে পারলেও তাদের বাচ্চা আর জ্ঞাতি গোষ্ঠি কখনো আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে, কখনো আনসার আল ইসলাম পরিচয়ে, কখনো আইএস বা আল কায়েদার উপমহাদেশীয় শাখার নাম উল্লেখ করে ঠিকই বিষের ছোবল অব্যাহত রেখেছে।

প্রগতির পক্ষের সব মানুষ তাদের চূড়ান্ত টার্গেট হলেও গত আড়াই বছরে তাদের মূল টার্গেট যে ব্লগাররা হচ্ছেন এর মূল কারণ সেই গণজাগরণ। কারণ গণজাগরণের মাধ্যমে মানুষ রায় দিয়েছে যে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে কোনোরকম আপোষ গ্রহণযোগ্য হবে না। গণজাগরণের শুরু থেকেই তাই এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্লগার এবং কর্মীদের উপর আঘাত এসেছে। কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে গণজাগরণের আগেও ব্লগারদের হুমকি-ধমকি দেয়া হয়েছে, একজনকে আহত করা হয়েছে; কিন্তু চাপাতির চূড়ান্ত আঘাত আসতে শুরু করে গণজাগরণের পর থেকেই।

প্রথমেই ঢাকার মিরপুরে রাজীব হায়দার শোভনকে হত্যা করা হয়, এরপর সিলেটে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এবং গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক জগৎজ্যোতি তালুকদারকে। আর ২০১৫ সাল হয়ে উঠে ব্লগার হত্যার বছর। বইমেলা চলার সময় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘মুক্তমনা’ ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা এবং বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ড. অভিজিত রায়কে হত্যা করা হয়। সেসময় আহত হন তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। পরের মাসের ৩০ তারিখ ‘মুক্তমনা’র ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে একই কায়দায় হত্যা করা হয়। মাঝে একটু বিরতি দিয়ে ১২ মে হত্যা করা হয় সিলেটের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে। ঢাকায় ৭ আগস্ট ব্লগার নিলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়কে হত্যা করা হয়।

সর্বশেষ শনিবার নিহত হন ড. অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন। প্রায় একইসময় অভিজিতের বইয়ের আরেক প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল এবং রনদীপম বসু ও তারেক রহিমকে কুপিয়ে আহত করা হয়।

এটা বুঝতে পারা খুব কঠিন না যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ব্লগার সম্প্রদায়ের উপর একের পর এক হামলার ধারাবাহিকতায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রিভিউ শুনানির মাত্র দুইদিন আগে একজনকে হত্যা আর তিনজনকে কুপিয়ে আহত করার সঙ্গে ওই বিচারের সম্পর্ক আছে। যেমন সম্পর্ক আছে দুই বিদেশী হত্যার সঙ্গেও। যে নামেই ব্লগারদের হত্যা করা হোক, যে নামেই দায়-দায়িত্ব স্বীকার করা হোক; সবকিছুর কেন্দ্রে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার। এ কারণে এটা ধারণা করার যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে যে, এসব হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যে কলকাঠি নাড়ছে তার নাম আই এস আই।

পাকিস্তানী এই গোয়েন্দা সংস্থা শুধু যে তাদের স্বার্থের রক্ষকদের রক্ষা করে দায় মেটানোর চেষ্টা করছে এমন নয়, এর সঙ্গে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিও সম্পর্কিত। তাদের স্বার্থে একটি অস্থিতিশীল বাংলাদেশ প্রয়োজন। ওই টার্গেট অর্জনেই বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানো, বিদেশী খুন এবং একের পর এক মুক্তচিন্তার মানুষকে হত্যা। জামায়াতের প্রকাশ্য শক্তি যেহেতু প্রায় নিঃশেষিত আইএসআই তাই লক্ষ্য পূরণে আপাততঃ তিনটি কৌশল গ্রহণ করেছে:
১. জামায়াতের গোপন ক্যাডারদের মাধ্যমে নতুন নতুন জঙ্গি সংগঠনের জন্ম।
২. আগে থেকেই সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর অভিভাবকত্ব গ্রহণ।
৩. আই.এস কিংবা আল-কায়েদার মতো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর ডালপালা বিস্তার।

এভাবে আপাতঃ বিচ্ছিন্ন কিন্তু গোপন জায়গা থেকে একক এবং কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করে আইএসআই যে লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে চায় সেগুলো হচ্ছে:
১. বিচার ভণ্ডুল করতে না পারলেও সাকা-মুজাহিদের মতো পুরনো মিত্রদের যতোদিন সম্ভব বাঁচিয়ে রেখে পাকিস্তানপন্থী নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলা।
২. নিজামী-মুজাহিদ-সাকাদের মতো পাকিস্তানী বড় পিলারগুলো ধসে পড়লেও যাতে বাংলাদেশে তাদের পক্ষে কার্যক্রম অব্যাহত থাকে সেজন্য নতুন নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।
৩. পট পরিবর্তনের মাধ্যমে পাকিস্তানপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠা।

এসব করতে গিয়ে আইএসআই সেই জঙ্গি সংগঠনগুলোকে বেছে নিয়েছে যারা তাদের অন্ধত্বের কারণে ব্লগার মানেই নাস্তিক মনে করে, আর নাস্তিক হলেই তাকে কতল করা ওয়াজিবও মনে করে। এভাবে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে মুক্তমনাদের হত্যার মচ্ছবে নেমেছে আইএসআই সমর্থনে নতুনভাবে শক্তিশালী পুরনো জঙ্গি সংগঠন অথবা একেবারেই নতুনভাবে গজিয়ে উঠা জঙ্গি সংগঠন। অন্ধকারের এই শক্তি জয়ী হবে না যেরকমভাবে একাত্তরে পাকিস্তান এবং সমর্থক মুসলিম লীগ বা জামায়াত জয়ী হতে পারেনি। কিন্তু এটাতো সবারই জানা যে, পরাজয় নিশ্চিত জেনেও পালিয়ে যাওয়ার আগে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে গিয়েছিলো নিজামী-মুজাহিদের আল-বদর।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)