ভারতে গত লোকসভা (২০১৯) ভোটের পর থেকেই বামপন্থীদের সম্পর্কে এই অভিযোগ খুব জোরালোভাবে উঠে আসছে যে, সেই ভোটে বামপন্থীরা নাকি তাদের ভোট ট্রান্সফার করে বিজেপিকে জিতিয়েছে।
বামভোটের জেরেই নাকি বিজেপি এই রাজ্যে ১৮টি আসন পেয়েছে। এই প্রসঙ্গের যারা অবতারণা করছেন, তারা বামভোটের রামভোটে পরিণত হওয়ার কথা বলে বামেদের জন্যেই বিজেপির বাড়বাড়ন্ত, এই তত্ত্বের অবতারণা করছেন।
এখানে প্রথমেই একথা বলতে হয় যে, কোনো রাজনৈতিক দলের কখনো কি ভোট পৈতৃক সম্পত্তি হতে পারে? ভোট যদি কোনো রাজনৈতিক দলের চিরকালীন সম্পত্তি হয়, তাহলে ইন্দিরা গান্ধী কি ‘৭৭ সালে হারেন? সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় বা তার দল কংগ্রেস কি পশ্চিমবঙ্গে ধারাবাহিকভাবে ওইরকম ভোট বিপর্যয়ের ভিতরে পড়তেই থাকে? বিধানচন্দ্র রায়ের ভোট ব্যাঙ্কে তার মৃত্যুর পরের রাজনৈতিক ঘটনাক্রম ধস নামিয়েছিল বলেই তো অতোকালের ধারাবাহিক কংগ্রেস শাসনের অবসানের পর যুক্তফ্রন্ট সরকার তৈরি হয়েছিল। ২০১১ তে কি রামভোটে জিতেছিল তৃণমূল? যেটা বামেদের নিজস্ব ভোট ছিল, সেটাই তো নানা কারণে স্থানান্তর হয়েছিল তৃণমূলের দিকে। তাই তো জিতেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে ভোট একটানা চৌত্রিশ বছর ধরে বামফ্রন্টকে ক্ষমতায় রেখেছিল, সেই ভোট স্থানান্তর হয়ে যখন মমতাকে জেতায়, তখন তো এই ভোট স্থানান্তরের বিষয়টি মুখ্য আলোচ্য হয়ে ওঠে না।
গত লোকসভার ভোটে এই রাজ্য থেকে যারা বিজেপি প্রার্থী হিসেবে জিতে সংসদে গেছেন, তাদের বেশিরভাগই তো প্রাক্তন তৃণমূলী। এই প্রাক্তন তৃণমূলীরা বিজেপিতে যাওয়াতে তৃণমূলের একটা বড় অংশের ভোট বিজেপিতে গেছে। কই ,তৃণমূল থেকে বিজেপিতে এই ভোট স্থানান্তর ঘিরে তো কখনো কোনো আলোচনা হয় না। আজ যারা এই রাজ্য থেকে বিজেপির টিকিটে লোকসভায় গেছেন, তারা কতদিন তৃণমূল কংগ্রেসে সংসদীয় বা প্রশাসনিক কমিটিগুলো বা দলীয় স্তরে ছিলেন, সেটি নিয়ে কিন্তু একবার ও আলোচনা হয় না। অর্জুন সিং, লকেট চট্টোপাধ্যায়, সৌমিত্র খান, নিশীথ প্রামাণিক প্রমুখেরা তো লোকসভা ভোটের অল্প আগেই তৃণমূল ছেড়ে কংগ্রেসে গেছেন। এরা তৃণমূলের ভোটগুলো বিজেপিতে স্থানান্তর করেননি- তা কি বলা যায়? এইসব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা তৃণমূলের ভিতরে থেকে বিজেপির হয়ে কাজ করছিলেন- এই অভিযোগ ও তো আছে। তাহলে একতরফাভাবে বামভোট স্থানান্তরিত হয়ে বিগত লোকসভা ভোটে তৃণমূলের বদলে বিজেপি ১৮টি আসনে জিতেছে, আর বামেদের ভোট কেটে সংযুক্ত হয়েছে বিজেপিতে, এই যুক্তি কি একতরফাভাবে খাটে? মুকুল রায় বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর, তৃণমূলে তার যেসব নিজের লোক ছিলেন, তারা সবাই তৃণমূল কংগ্রেসকেই ভোট দিয়ে চলেছেন তো? মুকুলবাবুর সমর্থকেরা যারা লোকসভা ভোটের সময়েও তৃণমূলের ভিতরে ছিলেন, তারা কেউই বিজেপিকে ভোট দেননি, তৃণমূলকেই দিয়েছেন — এটা নিশ্চিত তো? নাকি এসব বলতে নেই? কেবল বামভোট রামভোটে গেছে, বামেরাই রাম হচ্ছে, মমতা তার নিজের ভোটব্যাংক অক্ষুন্ন রেখে চলেছেন- এটা বলেই মনকে প্রবোধ দিলে চলবে?
এইবারের বিধানসভা ভোটের তোড়জোড় শুরু হওয়া থেকেই তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ার ধূম পড়েছে। রাজীব ব্যানার্জী, শুভেন্দু অধিকারীর মতো এককালে মমতার পরেই থাকা তৃণমূল নেতারা এবার বিধানসভার ভোটে বিজেপি প্রার্থী। তৃণমূল দলটি যেমন ব্যক্তি ইমেজ নির্ভর একটি দল, তাই এই দলে মমতা ছাড়াও বেশ কিছু নেতার নিজস্ব কিছু ভোটব্যাংক আছে। বিগত লোকসভা ভোটে তেমনই আমরা দেখেছিলাম অর্জুন সিংয়ের ভোটব্যাংকটি। তিনি যদি বামভোটে রামভোটে পরিণত করতে সক্ষম হয়েও থাকেন, তৃণমূলী ভোটকেও বিজেপির ভোটে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হননি, এই কথা মনে না করার কোনো কারণ আছে কি?
তেমনই শুভেন্দু, রাজীবদের ও বেশ কিছু নিজস্ব ভোট আছে। এদের এই নিজস্ব ভোটের কথা মমতাও জানেন। তাই এইসব তৃণমূলের নেতারা দল ছাড়ার আগে নরমেগরমে তাদের দলে রাখতে মমতা চেষ্টার ত্রুটিও করেননি। রাজীব ব্যানার্জীর মতো তৃণমূলে দশ বছর মন্ত্রী থেকেও বিতর্কহীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গোটা তৃণমূল খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। এহেন রাজীববাবুর নিজস্ব ভোটব্যাংক এবার বিজেপির বাক্সেই যে যাবে, সেটা নিশ্চিত। তারপরেও কি বামভোটের রামভোটে পরিণত হওয়ার গল্প আমরা করেই যাবো? আর এস এস থেকে ,’ আগে রাম, পরে বাম’ যে শ্লোগানটিকে খুব গোপনে অথচ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় অংশের মানুষদের ভিতরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই আর এস এসের কারসাজিকেই আমরা বামেদের লাইন বলে প্রচার করে আত্মতৃপ্তি পেতেই থাকবো, পেতেই থাকবো?
মমতা যে আলঙ্কারিক উন্নয়ন আর ডোল রাজনীতি করছেন, সেটি মানুষের জীবনজীবিকার সঙ্কটমোচনে কতোটুকু ভূমিকা নিতে পারে, এই প্রশ্ন তুলছেন বামপন্থীরা, তুলছেন আই এস এফ নেতা আব্বাস সিদ্দিকি। সেই কারণেই বামেদের শুনতে হচ্ছে, রামেদের জিতিয়ে তারা নাকি ২০২৬ সালে ক্ষমতায় ফেরার খোয়াব দেখছেন। তাই জহর সরকারের মতো প্রাজ্ঞ মানুষ ও ধর্মীয় বলেই আব্বাস সিদ্দিকির গায়ে লটকে দিচ্ছেন সাম্প্রদায়িক অভিধা। দলের কাছাকাছি (কারণ যারা মমতার খেদমতগারি করেন না, তারা এই ভাতা পান না) ইমাম, মোয়াজ্জিনদের মুসলমান সমাজের নিজস্ব টাকা দিয়ে ভাতা দেওয়ার প্রশ্নে আব্বাস বলেন মুসলমানদের চাকরির কথা। সেই চাকরির টাকায় নিজের ইচ্ছে, প্রয়োজন মতো ল্যাপটপ কেনার কথা। তাই তো তাকে সাম্প্রদায়িক বলতেই হবে মমতার ইমেজ বিল্ডার বুদ্ধিজীবীদের। মন্দির , মসজিদের সামনে ভিক্ষা চাওয়া ফকির, মিসকিনের নাগরিক অধিকার মোতাবেক কর্মসংস্থানের দাবিদার আব্বাস আর তার দল আই এস এফের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করার জন্যে সাম্প্রদায়িকদের সাথে আপোষ করছেন, এই অভিধাও পেতে হবে বামপন্থীদের। ভুললে চলবে না, মিশ্র এলাকায় এই মহামিলনের কান্ডারি মহঃ সেলিমকে দিয়ে সভা করার প্রস্তাব দলীয় স্তরে এলে প্রাক্তন বামপন্থী সাংসদ ও বলেন: সেলিম তো মুসলমান। আসলে একদিন অসংসদীয় আচরণের জন্যে ওই দলীয় সতীর্থের স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক নিশ্চিত বহিষ্কার এই সেলিমই ঠেকিয়েছিলেন। জাতিসত্তা তুলে, ধর্মসত্তা তুলে তাই সেলিমদা চিরদিন গালি খেয়েই যাবেন, খেয়েই যাবেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)