মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলায় চিত্রনায়িকা পরীমনির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার রিমান্ড মঞ্জুরের বিষয়ে দুই বিচারককে আবারও ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন হাইকোর্ট।
এ বিষয়ে দুই বিচারক যে লিখিত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তাতে সন্তুষ্ট নন বলে গত ১৫ সেপ্টেম্বর জানিয়েছিলেন হাইকোর্ট।
আজ বুধবার বিষয়টি নিয়ে শুনানি শুরু হলে বিচারকের পক্ষে আইনজীবী আবদুল আলীম মিয়া জুয়েল আদালতকে বলেন, ‘মাই লর্ড কি কারণে ওনারা (রিমান্ড) দিয়েছেন তা বলেছেন।’
সেসময় অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চকে বলেন, ‘মাই লর্ড ওনারা ইয়াং অফিসার। ঠিকমতো হয়ত ব্যাখ্যাটা দিতে পারেনি। আর ওনারা ক্ষমাও চেয়েছেন।’
তখন আদালত বলেন, ‘আচ্ছা আবার তাহলে তারা ব্যাখ্যা দিক। আমরা পরবর্তী শুনানির জন্য ২৪ অক্টোবর দিন রাখছি।’
আজ আদালতে আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জেড আই খান পান্না। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবু ইয়াহিয়া দুলাল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মিজানুর রহমান।
কোন তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে পরীমনির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে- সে বিষয়ে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবব্রত বিশ্বাস ও আতিকুল ইসলামের দেওয়া লিখিত ব্যাখ্যা পেয়ে গত ১৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বলেন, ‘লার্নেড ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টকে শিক্ষা দিয়েছেন। ব্যাখ্যার এই অংশটুকু পড়ছি। যেখানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। আর এই মামলার আসামি পরীমনি বিদেশি মদ, এলএসডি, আইসসহ গ্রেপ্তার হন।’
একপর্যায়ে এই প্রসঙ্গে ওইদিন হাইকোর্ট বলেন, ‘আমরা তাদের (বিচারক) ব্যাখ্যা দিতে বলেছিলাম যে, কেন পরীমনির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে? ব্যাখ্যায় তারা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র এলএসডি গ্রহণের পর একজন ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে ছুরি নিয়ে নিজের গলায় পোঁচ মেরেছেন! এখানে তো সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইন এবং আমাদের প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে। যে কারণে আমরা তাদের জবাবে সন্তুষ্ট নই।’
হাইকোর্ট সেদিন আরও বলেন, ‘উনারা (বিচারক) ব্যাখ্যায় বলেছেন উপরোক্ত বিষয় সার্বিক বিবেচনায় দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করার আদেশের ক্ষেত্রে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে নিতান্তই ইচ্ছাকৃত নয়, সরল বিশ্বাসে ভুল।’
বিচারকদের এমন ব্যাখ্যার প্রসঙ্গ টেনে ওইদিন হাইকোর্ট বলেন, ‘এখানে যে ত্রুটি হয়েছে তা (বিচারক) বিশ্বাস করেন না। এটা বলে তো হাইকোর্টকে আন্ডারমাইন করা হয়েছে।’
এরপর আদালত এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে তার ব্যাখ্যা দিতে নিজে বা আইনজীবীর মাধ্যমে দিতে বলেন।
গত ২ সেপ্টেম্বর এক আদেশে পরীমনির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার রিমান্ড মঞ্জুর করার বিষয়ে দুই বিচারককে ১০ দিনের মধ্যে তাদের লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলেন হাইকোর্ট।
ওইদিন হাইকোর্ট বলেন, ‘দুই বিচারকের ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে তাদের তলব করা হতে পারে।’ এছাড়া ওইদিন হাইকোর্ট তার আদেশে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি পুলিশের পরিদর্শক কাজী গোলাম মোস্তফাকে ১৫ সেপ্টেম্বর মামলার নথিসহ (কেস ডকেট) আদালতে হাজির হতে বলেন।
৪ আগস্ট বনানীতে পরীমনির বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়। পরে বনানী থানায় পরীমনির নামে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে র্যাব।
এরপর তিন দফায় পরীমনিকে মোট সাত দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
১৯ আগস্ট পরীমনির জামিন আবেদন নাকচ করেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত। এই আদেশের বিরুদ্ধে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করলে আদালত ১৩ সেপ্টেম্বর শুনানির জন্য রাখেন। তবে পরদিন জামিন আবেদন দ্রুত বা নির্ধারিত সময়ের আগে শুনানি চেয়ে আবেদন করেন পরীমনির আইনজীবী।
তাতে সাড়া না পেয়ে গত ২২ আগস্টের ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং অন্তর্বর্তীকালীন জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন পরীমনি। সেই আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন।
ওই রুলে পরীমনির জামিন আবেদনটি কেন দুই দিনের মধ্যে নিস্পত্তি করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। এছাড়াও রুলে পরীমনির জামিন শুনানি ১৩ সেপ্টেম্বর নির্ধারণ করে গত ২২ আগস্টে বিচারিক আদালতের দেয়া আদেশ কেন বাতিল করা হবে না তাও জানতে চান। এবং এই রুল শুনানির জন্য ১ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেন হাইকোর্ট।
এরই মধ্যে গত ৩১ আগস্ট পরীমনিকে জামিন দেন বিচারিক আদালত।
পরীমনিকে লাগাতারভাবে রিমান্ডে নেওয়ার বৈধতা প্রশ্নে স্বপ্রণোদিত রুল চেয়ে গত রোববার হাইকোর্টে আবেদন করে মানবাধিকার ও আইনি সহায়তাকারী সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
পরীমনিকে আদালতে হাজির করা ও রিমান্ডে নেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ অনুসরণ করা হয়নি উল্লেখ করে আইনজীবী জেড আই খান পান্না আদালতকে স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ প্রার্থনা করেন।
পরে এ সংক্রান্ত এক শুনানিতে হাইকোর্ট বলেন, ‘রিমান্ডের উপাদান ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তা প্রার্থনা দিল, আপনি (ম্যাজিস্ট্রেট) মঞ্জুর করে দিলেন। এগুলো কোনো সভ্য সমাজে হতে পারে না। রিমান্ড অতি ব্যতিক্রমী বিষয়।’