চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

পরিবার ও দেশের কাছে তোমাদের ঋণ ভুলে যেও না: ড. আনিসুজ্জামান

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তনে গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেছেন: ‘তোমরা ভুলে যেও না তোমাদের আজকের কৃতিত্বের মূলে রয়েছে পরিবার, শিক্ষায়তন ও এই গরিব দেশ। পৃথিবীর যেখানেই তোমরা থাকো, যে অবস্থায় থাকো- পরিবার ও দেশের কাছে তোমাদের ঋণ ভুলে যেও না। সাধ্যমতো চেষ্টা করো সে ঋণ পরিশোধ করতে। এ কথা জেনো, তোমরা বাংলাদেশের সেই স্বল্প সৌভাগ্যের মানুষদের মধ্যে স্থান লাভ করেছো যারা উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ পেয়েছে। মনে রেখো, দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখনও সাক্ষরতার সুযোগবঞ্চিত। পারলে তাদের জন্য কিছু করো। তারা তোমাদেরই ভাই-বোন।’

শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে আয়োজিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মো. আবদুল হামিদ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।

ড. আনিসুজ্জামান বলেন: আমি খুব জোর দেবো শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধের বিকাশে। উচ্চশিক্ষা লাভ করে শিক্ষার্থীরা যদি ভালোমন্দ বিচার করতে না পারে এবং ভালোর পক্ষে দাঁড়িয়ে মন্দকে প্রতিরোধ করতে না পারে তাহলে তাদের উচ্চ শিক্ষা বৃথা। জীবনে আহরিত মূল্যবোধ সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ নাও হতে পারে। শিক্ষার্থীরা যদি মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া মূল্যবোধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, সর্বাগ্রে আমি তাকেই স্বাগত জানাবো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান, প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ, প্রো-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দীনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদ ও ইনস্টিটিউটের ডিন ও পরিচালকবৃন্দ, সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্যবৃন্দ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

সমাবর্তন উপলক্ষে গত দুইদিন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। শনিবার সকাল থেকেই সমাবর্তনস্থলে গ্র্যাজুয়েটরা আসতে শুরু করেন। কেউ কেউ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে দল বেঁধে ছবি তুলেন। আবার কেউ কেউ ব্যস্ত ছিলেন সহপাঠীদের সাথে হাসি-ঠাট্টায়।

সময়ের সাথে সাথে সমাবর্তন অভিমুখে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। শিক্ষার্থীদের সাথে অতিথিবৃন্দও আসতে শুরু করেন। বেলা ১২টার দিকে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মো. আবদুল হামিদের নেতৃত্বে শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। শোভাযাত্রা শেষে রাষ্ট্রপতি অতিথিদের নিয়ে মঞ্চে আগমন করেন। এরপর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। সবাই দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন।

ড. আনিসুজ্জামান

১২টা ৫মিনিটের দিকে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত ও নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা স্বাগত সংগীত ও নৃত্য পরিবেশন করেন। সাংস্কৃতিক পরিবেশনা শেষে বিভিন্ন অনুষদের ডিন ও কোষাধ্যক্ষ পিএইচডি, এমফিল, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীদের নাম রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের নিকট উপস্থাপন করেন। এতে রাষ্ট্রপতি ৮১ জনকে পিএইচডি, ২৭ জনকে এমফিল এবং ২১ হাজার ১শ’ ১১ জন গ্র্যাজুয়েটকে ডিগ্রি প্রদান করেন। পরে তিনি কৃতি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ৯৬টি স্বর্ণপদক প্রদান করেন।

সমাবর্তন বক্তৃতায় জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন: শিক্ষাব্যবস্থা হওয়া উচিত পিরামিডের মতো। এর ভিত্তি হবে চওড়া, উচ্চ শিক্ষা হবে তার চূড়া। সকলে যাতে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করতে পারে, তা সর্বাগ্রে দেখা দরকার।

তিনি বলেন: ইংরেজিতে উচ্চশিক্ষার একটি সমার্থ হলো টারশিয়ারি এডুকেশন বা তৃতীয় স্তরের শিক্ষা। তার মানে, দুটি স্তর (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা- আমাদের দেশে প্রচলিত উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাও এর অন্তর্গত) অতিক্রম করে এই তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করতে হয়। এর ভিত্তি আগের দুই স্তরের শিক্ষা। সেই দুই স্তরের শিক্ষা সম্পর্কে কিছু না বলে শুধু উচ্চ শিক্ষার কথা বলা বাগবিস্তার মাত্র।

রাষ্ট্রের একাধিক ধরনের শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতাকে দুর্ভাগ্যজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন: আমাদের দেশে নিম্নস্তরের শিক্ষার যে অনেকগুলো ভাগ রয়েছে তা আমাদের দুর্ভাগ্য। বাংলাদেশ রাষ্ট্রই একাধিক ধরনের শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে। গরীব পরিবারের শিশু ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষায় প্রবেশ করার কথা কল্পনা করতে পারে না। অন্যদিকে ধনী পরিবারের সন্তান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার কথা ভাবতেই পারে না। যদিও সরকারিভাবে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাধারাও পাশাপাশি চলছে। তারপর রয়েছে দু’ধরনের মাদ্রাসা শিক্ষা। সাধারণত গরিব ছেলেমেয়েই সেখানে যায়। এমনকি যারা সওয়াব হাসিল করতে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন, তারাও নিজেদের সন্তানকে সেখানে পাঠান না।

ড. আনিসুজ্জামান বলেন: পৃথিবীতে জ্ঞানের যে বিস্ফোরণ ঘটছে তা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ফলে আমাদের লব্ধ জ্ঞানের অনেকটাই প্রতিনিয়ত বাতিল হয়ে যাচ্ছে। সেখানে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হচ্ছে। জ্ঞানের সৃষ্টিতে আমরা তেমন অগ্রসর হতে পারিনি। তবে যে নতুন জ্ঞান সৃষ্ট হচ্ছে, তা আয়ত্ব করতে আমরা চেষ্টা করছি। সে প্রয়াস তীব্র না হলে আমাদের শিক্ষার্থীরা সত্যি সত্যি পিছিয়ে পড়বে।

ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে উপযুক্ত শিক্ষা না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রার্থিতা মানে উন্নীত হতে পারছে না মন্তব্য করে এই জাতীয় অধ্যাপক বলেন: আমাদের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, শিক্ষা বিস্তারের জন্য তা আবশ্যক। তবে এ ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে উপযুক্ত শিক্ষা পাওয়া যায় না। ফলে শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে বিশেষত- বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রার্থিতা মানে উন্নীত হতে পারছে না। তারা যখন শিক্ষার তৃতীয় স্তরে অর্থাৎ উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রবেশ করে তখন এই দুর্বলতা আর দূর করার সম্ভাবনা থাকে না। অবশ্য ১৯ শতকের শেষ দিক থেকে বলা হতে থাকে যে, এদেশে শিক্ষার মান অবনমন ঘটছে। তবে উচ্চ শিক্ষার মানের অবনমন সম্পর্কে কর্মে নিয়োগকর্তারা এখন যেভাবে সমস্বরে কথা বলছেন তা আগে শোনা যায়নি। আমাদের উচিত বিষয়টি বিবেচনা করা এবং তার প্রতিকার খুঁজে পাওয়া।

সমাবর্তন উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল বডি ও শৃঙ্খলা পরিষদের সমন্বয়ে নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের রোভার স্কাউট ও বিএনসিসির সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করেন।