কয়েকদিন ধরে মনে মনে একটা অপরাধবোধে ভুগছি । কেবলই মনে হচ্ছে সুন্দরবন ঘুরে এসে কি কোন অন্যায় করে ফেললাম? সেখানে বেড়াতে যাওয়ার জন্য লেখালেখি করে বন্ধু-পরিচিতদের উৎসাহিত করে কি ভুল করে ফেললাম? আবার নিজেই নিজের মনকে সান্তনা দিচ্ছি এই বলে যে, বহু মানুষতো অনেকদিন ধরেই এখানে যাচ্ছেন, ঘুরছেন, পশুপাখি দেখছেন, সুন্দরবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরছেন- এতো নতুন কিছু নয়।
কিন্তু সত্যি বলতে কী, এরপরও বেশ কয়েকটি কারণে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আমাদেরই নির্বুদ্ধিতায় আমাদের দেশের অতি মূল্যবান একটি প্রাকৃতিক সম্পদ হারিয়ে যাবে। উন্নয়নের কাছে মানুষ, প্রাণী, বন-জঙ্গল, পরিবেশ, প্রতিবেশ সব পরাজিত হতে যাচ্ছে। কোন বিশেষজ্ঞ বা বোদ্ধা হিসেবে নয়, এই প্রকৃতির সন্তান হিসেবেই নিজেকে খুব অসহায় ও দোষী মনে হচ্ছে ।
সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক বলেছেন সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। সুন্দরবন বাঁচাতে গবেষকরা পর্যটক নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেছেন। প্রতি বছর লাখো পর্যটক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন দেখতে যান। বিশেষ করে শীত মৌসুমে এই সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক যা বলেছেন, তা রীতিমত ভয় পাওয়ার মত । তিনি বলেছেন,“সুন্দরবনে একটি জটিল ও সংবেদনশীল ইকো-সিস্টেম বিদ্যমান। বর্তমানে সুন্দরবনে যে পর্যটন ব্যবস্থা চলছে, তা কোন অবস্থাতেই পরিবেশসম্মত নয়।” এখানকার ৯টি পর্যটন এলাকায় মৌসুমে প্রতিদিন ৪৫ হাজার পর্যটক যাচ্ছেন। এবং এরা যেখানে-সেখানে খাবারের প্যাকেট, পলিথিন, বোতল ও ডিব্বা ফেলছেন। যা বনের প্রাণী ও মাইক্রো-অর্গানিজমের ক্ষতি করছে। আর জাহাজ ও লঞ্চগুলো যত শব্দ করে যাতায়াত করে, তাতে সবচেয়ে অসুবিধা হয় সেইসব প্রাণীর যারা শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে চলাফেরা করে তাদের।
আমি নিজেই নিজেকে সান্তনা দিলাম এই বলে যে যদিও আমরা ঐ লাখো পর্যটকদের মধ্যে একটি গ্রুপ কিন্তু আমরাতো এইসব অভিযোগের আওতায় পড়িনা। আমরা গলা ছেড়ে গান করেছি কিন্তু পিকনিক পার্টির মত মাইক বাজাইনি, আমরা খেয়েছি কিন্তু কোন বোতল, প্যাকেট বা অন্যকিছুর একটি টুকরাও পানিতে ফেলিনি । আমাদের লঞ্চটিও মাঝেমধ্যে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর তাছাড়া ট্যুরিস্টরাতো অনেককিছুই জানেন না বা মানেন না। তাদের জানানোর ও মানানোর দায়িত্ব বনবিভাগ, পর্যটন বিভাগ ও যেসব ট্যুর কোম্পানি ওখানে কাজ করছে, তাদের। তারাই যাত্রা শুরুর আগে নিয়মকানুন সবাইকে জানাবে এবং তা মানতে বাধ্য করবে। মাইক বাজানোর অনুমতি বড় বড় জাহাজগুলো পায় কীভাবে? মাইক, জাহাজের জেনারেটর, ভটভটি নৌকার ইঞ্জিনের শব্দে আমাদেরই, মানে শব্দ প্রিয় মানুষেরই কানে তালা লাগার অবস্থা। সেখানে নীরব-নিবিড়তায় বেড়ে ওঠা পশু-পাখি-মাছেদের যে কী দুর্দশা হয়, তা সহজেই অনুমেয়।
সুুন্দরবনের কিন্তু বিপদের কোন শেষ নেই । এইতো গত ২০ জানুয়ারি সকালে সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্ট থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে একহাজার মেট্রিক টন কয়লাবাহী একটি লাইটার জাহাজ ডুবে গেছে। এই নিয়ে গত তিন বছরে ফার্নেস অয়েল, সিমেন্টের কাঁচামাল, কয়লা ও সারবাহী মোট ৯টি জাহাজ সুন্দরবন ও এর আশেপাশের এলাকায় ডুবে গেছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ দুর্ঘটনা কবলিত এলাকায় জলজ প্রাণী ও পরিবেশের দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির আশংকা করছেন। তারা মনে করেন তেলের দূষনের চেয়েও কয়লার দূষণ ভয়াবহ। এই যে ক্রমাগত জাহাজগুলো দুর্ঘটনা কবলিত হচ্ছে এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কিনা, জানিনা। এগুলো সময়মত পানি থেকে তোলা হচ্ছে কিনা, জানিনা। এখনই এই অবস্থা, রামপাল চালু হলে যে কী হবে, কে জানে? আমাদের এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা নিয়ম থাকলেও কেউ নিয়ম মানে না, নিয়ম মানছি কিনা এটা দেখারও কেউ নেই, দেখলেও শাস্তির বা জরিমানার কোন রেওয়াজ নেই। আর শাস্তি হলেও ফাঁক গলে বেড়িয়ে যাওয়াটাও কঠিন কিছু নয় ।
আমরা কোন নিয়মই মানি না, মানতে চাইও না। নিজেরা সারাদিন হৈচৈ, শোরগোলের মধ্যে থাকি। নোংরা আবর্জনা নিজেরাই যত্রতত্র ছড়াই, অন্যেরা ছিটালেও কোন গা করিনা। যেখানে বসবাস করি সেই জায়গা নোংরা করি, যেখানে বেড়াতে যাই সেখানেও আবর্জনার স্তুপ গড়ে তুলি। তাতে কার কী ক্ষতি হল, প্রকৃতি, প্রাণীকুল থাকলো কি থাকলো না, তাতে কার কী এসে গেল। সুন্দরবন কিংবা বান্দরবান , টেকনাফ কিংবা তেতুলিয়া- আমরা যেখানেই প্রকৃতি দেখতে বা সময় কাটাতে যাই, সেখানে গিয়ে আমরা প্রকৃতির ক্ষতিই করি। পরিবেশ, প্রতিবেশ, প্রাণী, বন্যপ্রাণী কারো সম্পর্কে কোন ধারণা না নিয়েই চলে যাই বেড়াতে। যদি আমি বলি শুধু বেড়ানোর জন্য নয়, যাই ঐ সুন্দর জায়গাটাকে নষ্ট করতে, তাও খুব একটা বাড়িয়ে বলা হবে না।
সুন্দরবনের নতুন বিপদ মোবাইল প্রযুক্তির আগ্রাসন। সরকারি কোম্পানি টেলিটক এখানে আরো ৮টি নতুন টাওয়ার বসাতে চাচ্ছে। এর আগে বসিয়েছে তিনটি। এই তিনটি টাওয়ার সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রাণীকুলের উপর কী প্রভাব রাখছে, এনিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। তারা ইতোমধ্যে বনবিভাগের কাছে অনুমতি চেয়ে চিঠিও দিয়েছে। সময় ধরে দিয়েছে মার্চ মাস। স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর টাওয়ার তরঙ্গের প্রভাব কি হতে পারে, সে ব্যাপারে তাদের কোন সমীক্ষা আছে কি? এরকম একটি সংবেদনশীল বিষয়ে আমরা কেন এত অবিবেচকের মত ভূমিকা রাখছি, বুঝতে পারছি না। শুধু সংবেদনশীলই বা বলি কেন, এই বনতো আমাদের সম্পদ। আমরা জানি মোবাইল ফোনের টাওয়ার, বিদ্যুতের লাইনের ভেতর দিয়ে প্রবাহমান তরঙ্গ পাখি ও কীটপতঙ্গের উপর খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যে কারণে বিশ্বের অনেক দেশেই বনভূমি বা বনাঞ্চলে এধরণের টাওয়ার বসানোর অনুমতি নেই।
আমরা যে রামপাল কয়লাভিত্তিক প্রকল্প করবোই, এ বিষয়ে সবাই মোটামুটি নিশ্চিত। সে হরতাল, ভয়তাল- যাই হোক এখানে এই প্রকল্প হবেই । কারো কোন কথা কানে তোলার আর কোন সুযোগ নাই। ইউনেস্কো ও আইইউসিএন গতবছরই বলেছে যে প্রস্তাবিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সুন্দরবনের জন্য গুরুতর হুমকি। এর কয়লার ছাই আর বর্জ্য পানিকে দূষিত করবে। অতিরিক্ত জাহাজ চলাচল, কয়লা বহণ, শিল্পস্থাপণের কুপ্রভাব এই বনকে বনের অধিবাসীদের ক্ষতি করবে। ইউনেস্কো এই প্রকল্প বাতিল করে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে , যেন বনটা বাঁচে, বিপন্ন না হয় এই সম্পদ। সেকথা শোনার কেউ নেই। সরকার মনে করেনা এইসব আয়োজনে সুন্দরবনের কোন ক্ষতি হবে।
কাজেই যা হওয়ার তাই হবে- ক্ষতিগ্রস্ত হবে সুন্দরবন । ক্ষতিগ্রস্ত হতে হতে একদিন বিপন্ন হয়ে হারিয়ে যাবে এই বন, বনের প্রাণী, নদীর পানি, পানিতে থাকা মাছ ও জলজ উদ্ভিদ। পেশাচ্যুত হবে মাওয়ালি, বাওয়ালিরা। আর আমাদের মত ‘ভ্রমণ সন্ত্রাসীরা’ তখন অন্য কোন ক্ষেত্র খুঁজে নেবো বেড়ানো বা ধ্বংস করার জন্য।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)