গল্প থেকে জীবন নাকি জীবন থেকে গল্প- এ প্রশ্নের উত্তরটা আজ অনামিকা খুঁজে বেড়াচ্ছে তার জীবনে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে সে ভাবছে এবার কি হবে। মৃত্যুও তাকে বেকার জীবন থেকে মুক্তি দিলো না। উল্টো হাসপাতালের বিলটা এখন বাড়তি খরচ হলো পরিবারের জন্য।
অনামিকা (বিশেষ কারণে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হলো) সংবাদ ভিত্তিক মিডিয়া জগতের একজন কর্মী। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে কাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে। যদিও এখন বেকার। কাজের সূত্রে পরিচিত জন আর বন্ধু বান্ধবদের পরিধিটা বিশাল। কিন্তু এখন তার আশে পাশে তেমন কেউ নেই। তার চেনা জানার জগতটা কেমন যেন বদলে গেছে নিজের চাকরিটা চলে যাওয়ার পর। যোগাযোগটা এখন সামাজিক মাধ্যমে সবটাই সীমাবদ্ধ বলা যায়। ফেসবুকে বা অন্যান্য মাধ্যমে নীতিকথা লেখা মানুষগুলোকে বেশ অচেনা লাগে এখন তার। অন্যদিকে নিজের মেধা, প্রজ্ঞা আর কাজের প্রতি আগ্রহকে মনে হয়ে তার সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা। তা না হলে কাজের অভিজ্ঞতা থাকার পরেও দিনের পর দিন সে বেকার। চাকরি খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত। দেশে প্রতিনিয়তই পেপার পত্রিকা, অন্য লাইন আর টেলিভিশন চ্যানেল হচ্ছে। কিন্তু সে সাথে বেকারত্ব বাড়চ্ছে এ সেক্টরে। যা আসলেই অসঙ্গতিপূর্ণ। এর অন্তরালের কারণটা রহস্যময় বলেই মনে হয় অনেকটা ।
এছাড়া দেখা যা, একজন ভালো সাংবাদিক চাকরি পায় না। আবার পত্রিকা বা চ্যানেলের মালিকরা লেখার জগতের প্রাপ্য শ্রমের মূল্য দিতে নারাজ। অনেকেরই ধারণা লেখালেখি এটা কি এমন কাজ। এ কাজে কি এমন পরিশ্রম হয়। অদ্ভুত এক ধারণা এ সমাজে কলম পেশাজীবীদের নিয়ে।
তাই তো জীবিকা আর বেকারত্বের যন্ত্রণাকে সইতে না পেরে মিনার মাহমুদের মতো সাংবাদিকরা যখন আত্মহননের পথ বেছে নেয় তখন তাদের কথা মনে করে সকলে। চির বিদায়ে শোক বন্দনা বইতে থাকে স্মৃতিচারণে। কিন্তু বেঁচে থাকতে কেউ তাদের একটা চাকরি দেয়নি। কিংবা এ প্রতিভাবান মানুষরা যে দেশের সম্পদ তা চিন্তা করেনি কখনও । ঠিক এমনই বেকারত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল অনামিকা। কারণ এ যন্ত্রণা কতটা হলে নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয় মানুষ আজ তা বুঝে অনামিকা।
কলমটা যখন রুদ্ধ হয়ে যায় অভাবের তাড়নায়, তখন সব কিছু অর্থহীন হয়ে পড়ে। অনামিকা হয়তো বা মিনার মাহমুদের মত বড় কেউ নয়। কিন্তু তার জীবনে পেশা নেশা সবটাই কলমকে ঘিরে। সে কলমটাকে ভেঙ্গে নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল নীরবে। কিন্তু পারেনি বলে এখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে ভাবছে, সন্তান পরিবার সবার কাছে কি জবাব দিবে এবার?
অনামিকার প্রশ্নের উত্তরটা এখন সংবাদ জগতের কারো কাছে আছে কিনা জানা নেই। কিন্তু এ মিডিয়া জগতের রথী মহারথীরা দেশ, সমাজ আর নিজেদের পেশা নিয়ে স্বপ্নের কথা বলে আশার আলো দেখায় আগামী প্রজন্মকে। কিন্তু বর্তমানের বেকার সাংবাদিকদের নিয়ে ভাবার সময় বড় কম তাদের। কারণ সংবাদ জগত এখন দেশের ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে।
অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেন, তিনি এতগুলো টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দিয়েছেন মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে। তবে এখানে কিছু মানুষের সাময়িক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও চাকরির নিশ্চয়তা নাই।
এ চ্যানেলগুলো থেকে সাংবাদিকের যেভাবে চাকরি চলে যায় তা হয়তো প্রধানমন্ত্রীর জানা নাই। তাই বেকার সাংবাদিকদের অনিশ্চিত জীবনের গল্পগুলো এখন কেবল নিজেদের নিরর কান্না।
অনামিকার মত কলম পেশাজীবীরা দেশের কথা বলে, তুলে ধরে সমাজের সমস্যা। তারা যে সমাজের আয়নার প্রতিচ্ছবি। তাই বিবেকবোধ একজন সাংবাদিক চাইলেই পারে না অভাবের তাড়নায় নিজেকে বদলে ফেলতে। আর সে কারণেই অনামিকা আজ পরাজিত এক সাংবাদিক।
হাসপাতালের ডাক্তাররা তাকে বাঁচিয়ে দিয়ে একটা নতুন জীবন দিলো ঠিকই । কিন্তু এ নতুন জীবনে নিয়ে তার কোন উচ্ছ্বাস নেই। কারণ অনামিকা যে বেকার সাংবাদিক। অনামিকা জানে না আদৌ কি সে বলতে পারবে-‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা।’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)