আমার প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ এখন পরিণত হয়েছে এক মৃত্যু উপত্যকায়। প্রতিদিন প্রতি মূহুর্তে মৃত্যুভয় তাড়া করে ফিরছে দেশের প্রতিটি মুক্তচিন্তার প্রগতিশীল মানুষের মনে। আফিমে মত্ত খুনীরা একদিন যেভাবে মেতে উঠেছিল রক্তের হোলিখেলায়, বিশ্বাসের আফিমে মত্ত গুপ্তঘাতকেরা আজ আবারো মেতে উঠেছে সেই মরণখেলায়।
পরমত অসহিষ্ণুতার বিষবাস্পে বিষিয়ে উঠছে আকাশ বাতাস। নিয়মিত বিরতিতে একের পরে এক খুন হয়ে যাচ্ছেন ভিন্নধারার মানুষেরা। অথচ তেমন কোন প্রতিক্রিয়া নেই জনমনে। যেন নিতান্তই মামুলি ব্যাপার এগুলো। আর আলোকিত মানুষগুলো হারিয়ে বাতিঘরের অভাবে ক্রমশই ব্ল্যাক হোলের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা।
একটার পরে একটা খুন। কিন্তু নেই কোন প্রতিকার। হুমায়ুন আজাদ হত্যাচেষ্টার মধ্যে দিয়ে যে চাপাতি ট্র্যাডিশন শুরু হয়েছিল, তা আজ পরিণত হয়েছে একটি বিষবৃক্ষে। মূলত ব্লগার আর অনলাইন এক্টিভিস্টরাই এর প্রধানতম শিকারে পরিণত হলেও মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হয়েছে প্রকাশক আর শিক্ষকদের নামগুলোও। ক্রমেই সেই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ফেসবুকের দু-একটা স্ট্যাটাস ছাড়া নেই তেমন কোন প্রতিবাদও।
হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন, বাঙালির আসলে গোল্ড ফিশের স্মৃতি। গোল্ড ফিশের প্রতিটি স্মৃতির স্থায়ীত্ব মাত্র এক সেকেণ্ড। এই কারণে তার কোন দুঃখের স্মৃতি নেই। জীবনের প্রতিটি স্মৃতিই তার কাছে অত্যন্ত আনন্দের। এক সদানন্দ পরিবেশ দিনরাত ঘিরে রাখে তাকে। আর আমরা বাঙালিদেরও আজ সেই একই অবস্থা। কিছুদিন পরপর এক একটা নিত্যনতুন ঘটনা ঘটে, আর আমরা আগের ইস্যু অসমাপ্ত রেখেই মেতে উঠি নতুন ইস্যুতে। হুজুগে বাঙালি তকমা আমাদের এমনি এমনিই জোটেনি।
এই কারণেই ব্লগার হত্যা, সুন্দরবন,আইসিসি, তনু হত্যা, রিজার্ভ গায়েব, রানা প্লাজা, মান্না-শফিক, জয়-ইমরান কোন ইস্যুই স্থায়ীত্ব পায়নি আমাদের কাছে। আর পুরোপুরি সেই সুযোগটাই গ্রহণ করছে সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী। তারা ভালোই জানে দু-চারদিন হাউকাউ করার পরে বাঙালি আর ফিরেই তাকাবে না। নিত্যনতুন ইস্যুর পেছনে বল্গাহারা ঘোড়ার মতো তারা ঠিকই ছুটে বেড়াবে।
অপরাধ করে বিচার না হলে অপরাধ বাড়বেই। এটাই অপরাধ বিজ্ঞানের চিরাচরিত নিয়ম। আর এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই আজ আমাদের একের পরে এক মেধাবী মানুষগুলোকে আমরা ক্রমাগতভাবেই হারিয়ে চলেছি। খুন করে যদি বিচার না হয় ,তাহলে খুন করতে সমস্যা কি? একধরণের মাতস্যান্যায়ের দিকে ক্রমশ ধাবিত হচ্ছি আমরা। রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে যে ধরণের মাতস্যান্যায় প্রায় ১০০ বছর বিরাজমান ছিলো বাংলার বুকে।
সেইসাথে আমরা ভুলে গেছি প্রতিবাদের ভাষাও। চোখের সামনে প্রকাশ্য রাস্তায় কাউকে অন্যায়ভাবে মারতে দেখলেও আমরা মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে হাটা শুরু করি। যেন কিছুই হয়নি। চাচা আপন প্রাণ বাঁচার নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছি সবাই। সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হচ্ছে কি? নাকি থেমে থাকছে মৃত্যুর মিছিল? আজ না হয় কাল, বিষধর ফণী কিন্তু ঠিকই ছোবল হানছে।
এ পর্যন্ত যাদের হারিয়েছি শুধু মত প্রকাশের অপরাধেঃ
# ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ ঢাকায় খুন হন ব্লগার রাজিব হায়দার,
# ০২ মার্চ, ২০১৩ সিলেটে খুন হন গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ,ছাত্রলীগ নেতা জগৎজ্যোতি তালুকদার,
# ০৯ এপ্রিল, ২০১৩ বুয়েট ক্যাম্পাসে বুয়েটের ছাত্র ,গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী আরিফ রায়হান দ্বীপকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়,
# ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সাভারে অ্যাকটিভিস্ট ছাত্র আশরাফুল আলমকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ,
# ১৬ নভেম্বর, ২০১৪ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এ কে এম শফিউল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়,
# ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের নার্সিং ইনস্টিটিউটের লেকচারার অঞ্জলি দেবী চৌধুরীকে জঙ্গিরা কুপিয়ে হত্যা করে,
# ১৫ নভেম্বর, ২০১৪: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়,
# ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪: চট্টগ্রামে কথিত এক ফকিরের আস্তানায় ঢুকে ফকিরসহ দুইজনকে গলা কেটে হত্যা করে বোমা ফাটিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা,
# ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫: ঢাকার কূটনৈতিক পাড়া গুলশানে চেজারে তাভেল্লা নামের এক ইতালীয় নাগরিককে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়,
# ৩ অক্টোবর, ২০১৫: রংপুরের কাউনিয়ায় মুখোশধারীদের গুলিতে নিহত হন জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি, যিনি ওই এলাকায় একটি জমি ইজারা নিয়ে ঘাসের খামার করেছিলেন,
# ৫ অক্টোবর, ২০১৫: ঈশ্বরদীর ব্যাপ্টিস্ট মিশনের ‘ফেইথ বাইবেল চার্চ অব গড’ এর ফাদার লুক সরকারকে গলা কেটে হত্যার চেষ্টা করা হয়,
# ২২ অক্টোবর,২০১৫ : ঢাকায় গাবতলীতে একটি তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের এক এএসআইকে ছুরি মেরে হত্যা করা হয়,
# ২০১৫ সালের ২৪ অক্টোবর: রাজধানীর হোসাইনী দালানে শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতির মধ্যে ফাটানো হয় গ্রেনেড। এতে দুজন নিহত হন, আহত হন শতাধিক,
# ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর: দিনাজপুরে পিয়েরো পারোলারি নামে এক ইতালীয় পাদ্রীকে হত্যার চেষ্টা হয় গুলি করে,
# ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর: মাগরিবের নামাজের সময় বগুড়ার শিবগঞ্জের হরিপুরে শিয়া মসজিদে ঢুকে গুলি চালানো হলে মুয়াজ্জিন নিহত হন, আহত হন আরও চারজন,
# ২০১৫ সালের ৪ ডিসেম্বর: দিনাজপুরের কাহারোলে ঐতিহ্যবাহী কান্তজিউ মন্দির প্রাঙ্গণে এক মেলায় বোমা হামলা হয়,
# ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর: বগুড়ার কাহারোলে ইসকনের এক মন্দিরে ঢুকে গুলি ও বোমা হামলা চালানো হয়। একই দিনে চুয়াডাঙ্গায় খুন হন স্থানীয় বাউল উৎসবের এক আয়োজক। পরদিন তার লাশ পাওয়া যায়,
# ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, বইমেলা থেকে ফেরার পথে জঙ্গি হামলায় খুন হন বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়, সাথে গুরুতর আহত হন তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমদ,
# ৩০ মার্চ, ২০১৫ অফিস যাওয়ার পথে খুন হন অনলাইন এক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর বাবু,
# ৯ই এপ্রিল ২০১৫, নিজ বাসায় গলা কেটে হত্যা করা হয় ইসলামী ফ্রন্ট নেতা মাওলানা নূরুল ইসলাম ফারুকীকে,
# ১২ মে, ২০১৫ সিলেটে বিজ্ঞান লেখক অনন্ত বিজয় দাসকে জঙ্গিরা কুপিয়ে হত্যা করে,
# ০৭ আগস্ট, ২০১৫ ঢাকায় নিজ বাসায় জঙ্গিদের হাতে খুন হন ব্লগার নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় {নিলয় নীল},
# ৩১ অক্টোবর, ২০১৫ ঢাকায় জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সাল আরেফিন দীপনকে জঙ্গিরা কুপিয়ে হত্যা করে,
# ৬ই এপ্রিল, ২০১৬ কুপিয়ে খুন করা হয় গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও অনলাইন এক্টিভিস্ট নাজিমঊদ্দীন সামাদকে,
# ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করীম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়,
# সর্বশেষ বিগত ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৬ সালে রাজধানীর কলাবাগানের লেক সার্কাসে ঘরে ঢুকে কুপিয়ে খুন করা হয় জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু এক নাট্যকর্মীকে। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি’র কর্মসূচি কর্মকর্তা জুলহাজ (৩৫) সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সাময়িকী ‘রূপবান’ সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন।
এর সাথে যুক্ত হয়েছে সরকারের মাননীয় স্বররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির খুনীদের গ্রেফতার করার চাইতে ভিকটিমদের দোষ অনুসন্ধানের ঘোষণা দেয়ার মতো অপসংস্কৃতি, যা নিঃসন্দেহে ঘাতক চক্রকে ক্রমাগত উৎসাহী করে চলেছে।
একটি ব্যাপার লক্ষণীয় শুধু যে নাস্তিকরাই এসব হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তা কিন্তু নয়। দিনাজপুরের খ্রিষ্টান পাদ্রী,পঞ্চগড়ের হিন্দু পুরোহিত, আর মাওলানা ফারুকীর মতো পূর্ণ ধর্মপ্রাণ মানুষেরাও এসব নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড থেকে রক্ষা পাননি। আর সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নিয়মিতভাবেই চলছেই হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের মহোৎসব। বোমা ফুটছে শিয়া সম্প্রদায়ের সমাবেশে। আগুন জ্বলছে পাহাড়ে। এককথায় চারিদিকে এক দুঃসহ পরিস্থিতির ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছে বাংলাদেশ।
আর তাই রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছেন অপরপক্ষের উপরেই। ফলে সৃষ্টি হয়েছে একধরণের বিচারহীনতার সংস্কৃতি। যা উৎসাহিত করছে আরো অধিক হত্যার পরিকল্পনাকে। কেননা অপরাধের সুষ্ঠু বিচার ও কঠিন শাস্তির বিধান না থাকলে যেকোনো সমাজেই স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায় অপরাধ। এটা অপরাধ বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান সূত্র। আর জেনে শুনে সেই আগুনেই ঘৃতাহুতি দিচ্ছে এসব বক্তব্য। যাতে প্রকারান্তরে উৎসাহিতই হচ্ছে খুনিরা।
কবি আহসান হাবীব লিখেছিলেন,
“তোমার আমার দিন ফুরায়েছে যুগটাই নাকি বৈপ্লবিক-
গানের পাখিরা নাম সই করে নীচে লিখে দেয় রাজনীতিক
থাকতে কি চাও নির্বিরোধ?
রক্তেই হবে সে ঋণ শোধ।
নীড় প্রলোভন নিরাপদ নয় বোমারু বিমান আকস্মিক
আরব্ধ গান এইখানে শেষ আজকে আহত সুরের পিক “
মৃত্যুর মিছিল ক্রমশ দীর্ঘতর হচ্ছে। এই মিছিলে আস্তিক, নাস্তিক, জাতি, ধর্ম, দলমত নির্বিশেষে সবাই আছেন। কারণ এদের সবার একটি জায়গায় ঐক্য ছিলো। সবাই চেয়েছিলেন গড়ে তুলতে একটি মুক্ত, স্বাধীন, অসম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা। এখন আপনারাই ভেবে দেখুন, ধর্মান্ধতা আর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠবেন কিনা। কারণ এর পরবর্তী শিকার আপনি, আমি যে কেউ হতে পারি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)