হঠাৎ আযান শুনে ঘুম ভাঙলে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো বুঝেতে আমি কী আসলে ঢাকায় নাকি নেদারল্যান্ড। ২৪ ঘণ্টার টানা ভ্রমণ, বিশ্রাম না নিয়ে সন্ধ্যা থেকে মিটিং, এরপর ক্লান্তি নিয়ে রাতে ঘুমাতে যাওয়া। কাজেই আযান শুনে বুঝতে পারছিলাম না কোথায় আছি। পরে বুঝলাম না নেদারল্যান্ড শহরেই আছি। ঘুম যেহেতু ভেঙে গেল লিখতে শুরু করলাম। কিন্তু সবার আগে প্রশ্ন হলো দেশটার নাম নেদারল্যান্ড না হল্যান্ড?
আমাদের অনেকের কাছেই হল্যান্ড আর নেদারল্যান্ডসও একই দেশ। আসলে কিন্তু তা নয়। ১২টা অঙ্গরাজ্য নিয়ে গঠিত দেশটির দুটি অঙ্গরাজ্যের নাম শুধু হল্যান্ড। তবে এ কথা ঠিক হাজার বছরের ইতিহাসে দেশটির নাম অসংখ্যবার বদলেছে। কখনো দ্য ডাচ রিপাবলিক, কখনো দ্য ইউনাইটেড স্টেটস অফ বেলজিয়াম আবার কখনো দ্য কিংডম অফ হল্যান্ড। একসময় দেশটির নাম হল্যান্ড ছিল দেখেই হয়তো এখনো অনেকে দেশটিকে ঐ নামেই চেনে।
আচ্ছা নেদারল্যান্ড মানে কী? ডাচ ভাষায় নেদারল্যান্ডস মানে হচ্ছে “low lands” অর্থাৎ নিচু ভূমি।
নেদারল্যান্ডস এর ৬০ ভাগেরও বেশি জায়গা সমুদ্রপৃষ্ঠের নীচে অবস্থিত বলে এর নাম হয়েছে নিম্নভূমিসমূহ বা Netherlands। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি পানির শহর কোনটি? উত্তর হল আমস্টারডাম। দেশটির চার ভাগের এক ভাগ নদী, নালা, খাল-বিলে ভরা। তারা কোন খাল ভরাট করেনি। বরং দেশটি ঘুরলে দেখা যায় কী সুন্দর যত্ন করে সব রেখেছে তারা।
যেটা বলছিলাম ১২টা অঙ্গরাজ্য নিয়ে গঠিত দেশটির দুটি অঙ্গরাজ্যের নাম শুধু হল্যান্ড। নর্ড হল্যান্ড (নর্থ হল্যান্ড) এবং জেইড হল্যান্ড (সাউথ হল্যান্ড)। বাকিগুলো হলো, জিল্যান্ড, ইউত্রেখট, গেল্ডারল্যান্ড, নর্ড ব্রাবান্ট, ওভারাইসেল, ফ্লেভোল্যান্ড, ড্রেন্থে, ফ্রিসল্যান্ড, গ্রনিঞ্জেন ও লিম্বার্গ। দেশটির রাজধানী এবং বিশ্বখ্যাত শহর আমস্টারডাম নর্থ হল্যান্ডেই অবস্থিত। এছাড়াও আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর, কুকেনহফ দক্ষিণ হল্যান্ডে অবস্থিত।
বারটি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত দেশটির এদেরকে প্রদেশ বলা হয়। প্রত্যেকটি প্রদেশে একজন গর্ভনর দ্বারা শাসিত, যাকে কমিশনার অব দ্য কুইন বা কমিস্যারিস ভ্যান দ্য কোনিগিন বলা হয়। শুধু মাত্র লিমবার্গ প্রদেশের প্রধানকে গর্ভনর বলা হয়। প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মিউনিসিপালিটিসে বিভক্ত। ২০১০ সালের হিসেবে ৪৩০টি প্রদেশে আছে।
১৮১৫ সাল থেকে নেদারল্যান্ডসে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রচলিত। আর ১৮৪৮ সাল থেকে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু রয়েছে। ২০১০ সালে ইকোনমিস্ট পত্রিকা নেদারল্যান্ডসকে দশম শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ঘোষণা করে।
নেদারল্যান্ডসের রাজনীতি একটি সংসদীয় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র এবং একটি বিকেন্দ্রীকৃত ঐক্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামোতে পরিচালিত হয়। নেদারল্যান্ডসকে একটি consociational রাষ্ট্র হিসেবে বর্ণনা করা যায়। ওলন্দাজ রাজনীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুসমূহের উপর ব্যাপক ঐকমত্যে পৌঁছানোর প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়।
২০০৬ সালের ওলন্দাজ সংসদ নির্বাচনে সোশালিস্ট পার্টি বা Socialistische Partij বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
সরকারি হিসেবে নেদারল্যান্ডসের জনসংখ্যা ১৮ মিলিয়ন। দেশটির রাজধানীর নাম আমস্টারডাম।ওলন্দাজ ভাষায় Amsterdam মানে মূলত: Amstel Dam আম্স্ট্যল্ ডাম্ অর্থাৎ “আমস্টেল নদীর বাঁধ। নেদারল্যান্ডসের রাজধানী ও অন্যতম প্রধান শহর এটি। এটি বিশ্বের অন্যতম প্রধান বন্দর, ও বাণিজ্যকেন্দ্র। নবম শতাব্দীতে নির্মিত এই শহর। শহরটি নেদারল্যান্ডের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে বিবেচিত হয়।
নেদারল্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডামের খাল এখন UNESCO World Heritage. আমস্টারডামে রয়েছে অনেকগুলো বিশ্বমানের জাদুঘর।
২০১২ সালে, ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বসবাসের জন্য আমস্টারডামকে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ শহরের মর্যাদা দেয়। Bl বিখ্যাত অ্যামস্টারডাম বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছেন আনা ফ্রাঙ্কের ডায়রি খ্যাত অ্যানে ফ্রাঙ্ক, শিল্পী রেমব্র্যান্ড্ট ভ্যান রিজান এবং ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ এবং দার্শনিক বারুচ স্পিনোজা।
রাজধানী হলেও নেদারল্যান্ডস সরকারের মূলকেন্দ্র এখানে নয়, হেগ শহরে মানে আমি এখন যেখানে আছি।
হেগ শহরকে এরা বলে ডেন হাগনেদারল্যান্ডস সরকারের প্রশাসনিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত এটি। উত্তর সাগরের উপকূলবর্তী ৬ কিলোমিটার দূরবর্তী সমভূমি অঞ্চলটি নগরের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। স্টেটস জেনারেল নামে পরিচিত জাতীয় সংসদের অধিবেশন এখানেই বসে।গতকাল এখানকার ছবিই দিয়েছি। বিদেশের সব দূতাবাস এখানে। এমনকি আমাদের বাংলাদেশেরও আছে।
শুরুতেই বলছিলাম আযানের কথা। আসলে দেশটিতে দশলাখেরও বেশি মুসলিম আছে। তুর্কি, মরক্কো, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান,সোমালিয়া এবং সাবেক ডাচ কলোনি সুরিনাম থেকে তারা এসেছেন। দেশটির বড় শহর আমস্টারডাম,রটারডাম,হেগ এবং ইউট্রেক্টে বেশির ভাগ মুসলিম বাস করে। আর সে কারণেই মসজিদ আছে অনেক। আযানের সুন্দর শব্দ ভেসে আসে।
এবার কয়েকটা অন্যরকম তথ্য দেই। সাইকেল এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় বাহন।নেদারল্যান্ডসের রাজধানীর জনসংখ্যা সাত লাখের মতো৷ আর সাইকেলের সংখ্যা আনুমানিক দশ লাখ৷ দেশটিতে সাইকেল পার্ক করার নির্দিষ্ট জায়গা আছে শহরে৷ কিন্তু সেগুলো ভরা থাকে অধিকাংশ সময়৷ তাই অনেকে রাস্তার পাশে অবৈধভাবে রাখেন সাইকেল৷ সেখানে সাইকেল চুরিও এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এক লাখ সাইকেল প্রতি বছর চুরি হয়।
রিক্সার শহর ঢাকা হলে সাইকেলের শহর নেদারল্যান্ডের রাজধানী। শুনে অবাক হতে পারেন, দেশটাতে ৩৫ হাজার কিলোমিটার সাইকেল লেন আছে। স্যুট বুট পরে সবাই এখানে সাইকেল চালায়।
ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন, ব্যবসা বাণিজ্য আর সম্পদে বহু আগে থেকে সমৃদ্ধ নেদারল্যান্ড। পনের ষোল শতকে যে শুধু ব্রিটিশরাই যে পুরো দুনিয়া চষে বেড়িয়েছে এমন কিন্তু না। পর্তুগীজ, স্প্যানিশ আর ব্রিটিশদের সাথে সাথে ডাচরাও ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা পৃথিবীতেই, সব গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নিজেদের দখলে নেয়ার চেষ্টা করেছে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মত ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও বিদ্যমান ছিল। তারা সেই ১৬০৫ সালেই ভারতবর্ষে বাণিজ্য শুরু করেছিল।
জার্মানরা এই অঞ্চলের মানুষদের ডাচ বলতো। নেদারল্যান্ডসের সব মানুষকে এখনো বলে ডাচ এবং এটাই তাদের ভাষা। তবে নেদারল্যান্ডসের অধিবাসীদের ওলন্দাজও বলা হয়। এই ওলন্দাজরা কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে গিয়েছিল বাণিজ্য করতে। পুরান ঢাকায় তাদের কুঠিই পরে মিটফোর্ড হাসপাতাল বা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ বোধহয় এখন ফুটবলের কারণে নেদারল্যান্ডকে চেনে বিশেষ করে ২০১০ সালের বিশ্বকাপ রানার্সআপ দল হিসেবে দেশটির নাম গ্রামে গঞ্জে ছড়ায়। যারা বেড়াতে যান তাদের অনেকের কাছেই দেশটি টিউলিপ ফুলের দেশ নামে পরিচিত। কারও কাছে আবার সাইকেল আর সাইক্লিং-এর দেশ। তবে আমার কাছে যেটা খুব ভালো লাগে সেটা হলে এখানকার রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা।
রাজনীতি ও প্রশাসনিক সব ক্ষেত্রে ডাচরা সামাজিক ও রাজনৈতিকসহ সব ইস্যুতে আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। আর এই প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করেই দেশটা চলছে। মানুষ এখানে মানুষকে শ্রদ্ধা করে। তারা কল্যাণমুখী মানবিক রাষ্ট্র হতে চাইছে। জেনে অবাক হবেন, পৃথিবীর সবচাইতে ভদ্র পুলিশ বলা হয় নেদারল্যান্ডসর পুলিশকে। যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেন আলোচনার মাধ্যমে তারা সমাধান করে। নেদারল্যান্ডসের অনেক জেলখানা প্রতিবছর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র কয়েদির অভাবে।
আমার কাছে এই আলোচনা, পরস্পরকে শ্রদ্ধা আর মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি মুগ্ধ করে। কারণ আমি সবসময় একটা মানবিক দেশ আর মানবিক পৃথিবী চাই।
বাংলাদেশে তো আজকাল কথা বলতেও ভয় লাগে, ভিন্নমত বা অন্যের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ দিনকে দিন কমে যাচ্ছে।
তবুও আমি একটা মানবিক সুন্দর ভেড়ের স্বপ্ন দেখি। আর সেই ভেড়ের জন্যই আমার সব লড়াই। আমার সব লেখা। আমার সব কাজ। শুভ সকাল হেগ। শুভ সকাল বাংলাদেশ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)