নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থানার ওসি আব্দুল আহাদ খানের বিরুদ্ধে ধর্ষণকে আত্মহত্যা বলে মামলা করতে চাপ প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে৷ বেসরকারি একটি টেলিভিশনের প্রতিবেদনে এ বিষয়টা প্রকাশ পাওয়ায় এ নিয়ে এলাকায় শুরু হয়েছে ব্যাপক তোলপাড়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠছে, কেন আইনের রক্ষক হয়ে আইনের আশ্রয় প্রার্থনাকারীর বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন তিনি?
৯ মে শনিবার সন্ধ্যায় নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার সিংধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ মাহবুব মোর্শেদ কাঞ্চনের মোহনগঞ্জের বাসায় মারুফা (১৪) নামে এক গৃহকর্মীকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটে৷ ১১ মে সোমবার বিকালে মারুফার মা আকলিমা আক্তারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই দিনই নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও সিংধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ মাহবুব মোর্শেদ কাঞ্চনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ৷
কিশোরী মারুফা ও মাহবুব মুর্শেদ কাঞ্চন একই গ্রামের৷ দুই বছর ধরে কাঞ্চনের বাসায় কাজ করতো মারুফা৷ মারুফার লাশ নিজেই হাসপাতালে নিয়ে যায়। কাঞ্চন পুলিশকে না জানিয়ে মারুফার লাশ নিয়ে কেন হাসপাতালে গেলেন?
সিংধা ইউনিয়নের সাবেক সংরক্ষিত (৩,৫,৬) মহিলা মেম্বার সন্ধ্যা রানী রায় জানান, আকলিমা (মৃত কিশোরীর মা) আমার সাহায্য নিতে দেখা করতে চেয়েছিল। সে জানায় সোমবার তাকে থানায় অভিযোগের জন্য যেতে বলেছে। তার আসতে দেরি দেখে বিকেলে ফোন করি। সে আমাকে বলে, পুলিশ তাকে আটকে রেখেছে। ওসি ও চেয়ারম্যান সাক্ষরের জন্য চাপ প্রয়োগ করছে। আমি তাকে বলি, কোনো কাগজে স্বাক্ষর করো না। এ অবস্থায় ওসি ওর কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলে এবং আমাকে জিডি ও মামলার ভয়ভীতি দেখায়।
সন্ধ্যা রানীর কথা সত্যি হলে ওসি আহাদ খান পেশাগত গুরুতর অসদাচরণ করেছেন। তিনি এমনটি কেন করলেন? পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উচিত এ অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা৷ একজন ওসি কি এরকম আচরণ করতে পারেন? তার দায়িত্ব তো অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা।
অন্যদিকে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯ এর ৩৪ (১) ধারা অনুযায়ী ১৯ নভেম্বর ২০১৯ সালে নানা অপরাধমূলক কার্যক্রম ও জনস্বার্থবিরোধী কাজের জন্য কাঞ্চনকে চেয়ারম্যানের পদ হতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল৷ এই বিতর্কিত ব্যক্তিটিই আবার বহাল তবিয়তে জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে৷ এখন আবার তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ। সাংবাদিকরা ক্যামেরা নিয়ে গিয়ে দেখে ওসি আহাদ খান ও অভিযুক্ত কাঞ্চন থানায় বসে আছে৷ মারুফার হত্যাকে আত্মহত্যা বলতে চাপ সৃষ্টি করছে তার মা আকলিমাকে৷ ওসির এই প্রভাবিত হওয়ার কারণ তার জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদকের পদ নয় কি? দলের এই পদপদবীর অপব্যবহারে তো দলেরই ক্ষতি। তাহলে অনৈতিক কাজ করলে যদি চেয়ারম্যানের পদ চলে যায়, দলের পদ কেন নয়?
এছাড়া কাঞ্চনের কুকীর্তি নতুন কিছু নয়৷ তার বিরুদ্ধে অনেক আগে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার আব্দুল মমিন এমপির সই জালিয়াতিরও অভিযোগ রয়েছে৷ জেলা আওয়ামী লীগ কি এসব জানতো না? এমন এক বিতর্কিত ব্যক্তি কিভাবে জেলা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদ পেল?আরও পেল দলীয় মনোনয়ন? কারা তাকে এই পদ ও মনোনয়ন পাইয়ে দিল? সংস্কৃতির সাথে যার নূন্যতম কোন সম্পর্ক নেই এমন একজন ব্যক্তি হয়ে গেলো সাংস্কৃতিক সম্পাদক! এক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক না হয়ে অপসাংস্কৃতিক পদ সৃষ্টি করে তাকে হয়তো এমন একটি পদ দিলে তা যৌক্তিক হতো৷
এভাবে সর্বত্রই ভুল মানুষের নেতৃত্ব দখল ও তাদের সাথে আমলা মৈত্রীই আজ ভয়ের৷ প্রধানমন্ত্রীর নথি জালিয়াতিতেও থাকে এসব দখলদার নেতৃত্ব ও সরকারী কর্মচারি-কর্মকর্তা৷ করোনাকালের ত্রাণ চুরিতেও থাকে এসব দখলদার নেতৃত্ব ও কিছু সরকারি কর্মকর্তার যোগসাজশ৷ নুসরাতকে ‘খারাপ মেয়ে’ হিসেবে ফুটিয়ে তোলাতেও থাকে এরা। বরগুনার মিন্নির মামলাকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টাতেও লিপ্ত থাকে এসব দখলদার নেতৃত্ব ও কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা৷ মারুফা ধর্ষণ ও হত্যাকে আত্মহত্যা হিসেবে প্রমাণের অপচেষ্টাতেও এদের যোগসাজশ দেখা যাচ্ছে।
ফেনীর সোনাগাজী থানার নুসরাত হত্যা মামলায় দায়িত্বের অবহেলা ও সাইবার ক্রাইম মামলায় সাবেক ওসি মোয়াজ্জেেম জেলে আছে। মোহনগঞ্জ থানার ওসির কারসাজি তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক৷ আর দলগত ভাবে ব্যবস্থা নেয়া হোক মাহবুব মুর্শেদ কাঞ্চনের বিরুদ্ধে৷ অবিলম্বে কাঞ্চনকে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদ হতে অপসারণ করা হোক৷ এদের কারণে আওয়ামী লীগ এবং পুলিশের ভালো কাজ ধুলোয় মিশে যেতে পারে না। এদের সংখ্যা খুবই নগণ্য।
আশ্চর্যের বিষয় হলো- ধর্ষক ও খুনী কাঞ্চন জামিন পেয়ে গেল? ১৪ মে দৈনিক দেশ রূপান্তর পত্রিকার শিরোনাম ছিলো: ‘হত্যা মামলায় আওয়ামী লীগ নেতাকে বাঁচাতে ওসির কারসাজি’৷ আর ১৫ তারিখই তার জামিন হয়ে গেল! কাঞ্চনের জামিনে হতাশ ধর্ষণ ও হত্যার শিকার কিশোরীর পরিবার ও এলাকার মানুষ৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে প্রতিবাদের ঝড়৷
জানা যায়, দুর্বল এফআইআর-এর কারণেই কাঞ্চন ধর্ষণ করার সাত দিনের মাথায় জামিন পেয়ে গেছে৷ ধর্ষক ও খুনীকে যে বা যারাই সহায়তা দেয় তারা দেশের শত্রু, বিবেকের শত্রু৷ এই দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এখনই সময়৷ একজন ধর্ষক ও খুনী যদি এভাবে জামিন পেয়ে যায় তাহলে বিচারপ্রার্থীদের আস্থা নষ্ট হতে পারে। আমাদের প্রত্যাশা আইন আদালতের প্রতি মানুষের আস্থাবোধ বৃদ্ধি পাক৷ অসহায় ও নিরপরাধ মানুষ ভরসা করতে শিখুক এসব স্থানকে৷
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)