চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

নৃত্য-ছন্দে অনন্য সন্ধ্যা

স্বনামধন্য শিল্প-প্রতিষ্ঠান ‘সাধনা’র সহোদরা সংগঠন কল্পতরুর আয়োজনে গত ২ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় তিন দিনব্যাপী ভরতনাট্যম নৃত্যোৎসব ‘রঙ্গার্পণ’। কল্পতরুর আয়োজনে এই নৃত্যোৎসবে তিন সন্ধ্যায় নৃত্য পরিবেশন করেন শুদ্ধা শ্রীময়ী দাস, শাম্মি আখতার এবং জুয়েইরিয়াহ মৌলি। বুধবার শেষ সন্ধ্যায় ছিল নৃত্যশিল্পী জুয়েইরিয়াহ মৌলি-র পরিবেশনা।

পরমকরুণাময় ঈশ্বর এবং নৃত্যগুরুদের আশীর্বাদে উপস্থিত দর্শকদের শুভেচ্ছা জানিয়ে মৌলি এ আয়োজন শুরু করেন পুষ্পাঞ্জলির মধ্য দিয়ে। পুষ্পাঞ্জলি– একটি শ্লোক অনুসরণে সৃষ্ট যা হস্তি-মস্তক দেবতা গণপতির আশীর্বাদ প্রার্থনা করে উপস্থাপিত হয়। যার উদ্দ্যেশ্য জগতের সকল বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে যেন সফলতা নেমে আসে শুভ কর্মে।

রাগ আরাভি এবং তাল আদি সম্বলিত এই পুষ্পাঞ্জলির কম্পোজিশন করেছেন ডি এম বালামুর্লি কৃষ্ণ। এরপর উপস্থাপন করা হয় আলারিপু যা একটি শ্লোকের অনুসরণে সৃষ্ট, যে শ্লোক দেবতা মুরুগার আরাধণায় নিয়োজিত। এই আলারিপুর তাল মিশ্র চাপ যা দেবতা মুরুগার ছয়টি অভিব্যক্তির সমন্বয়ে প্রকাশিত। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন কীর্তি রামগোপাল।

এরপর জুয়েইরিয়াহ মৌলি উপস্থাপন করেন ভার্নাম, যেখানে বিরহকাতর নায়িকা দেবতা নটরাজের বিচ্ছেদে কাতর। যে তার সখীদের অনুরোধ করে তার বার্তা পৌঁছে দিতে এবং তার দেবতাকে তার কাছে এনে দিতে। সে বলে, এই চাঁদ তার দেবতার আরক্তিম সুন্দর মুখশ্রীকে মনে করিয়ে দেয়, তাকে যন্ত্রণাদগ্ধ করে মাতাল ক্রোধে, তীব্র করে তার আকাঙ্খা আর আবেগ! সে ভাবে কী কারণে বিলম্বিত এই আগমন তার দেবতার এবং প্রতীক্ষা করে যেন এই বসন্তেই তিনি আসেন। ভার্নামের শেষ অংশে নায়িকাটি প্রকাশ করে তার তীব্র ব্যাকুলতা, সে জানায় সর্বদা সে তার কথাই ভাবছে, হে মহান দেবতা শঙ্কর। তিনিই একমাত্র যিনি দেবতা বিষ্ণুর প্রশংসা পেয়েছিলেন। তিনিই সেই জন যিনি চিদাম্বরমে নৃত্য করেন স্বর্গীয় বাদ্য সহযোগে এবং পদ্ম পাতার উপরে ফুটিয়ে তোলেন দারুণ মুদ্রা তার চরণযুগলে।

এ ভার্নামের রাগ মালিকা এবং তাল আদি। মৌলি এ নৃত্যটিও তার ভাববাচ্যে দুর্দান্ত ভাবে ফুটিয়ে তুলে উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করেন। এটি শ্রী কে এন দণ্ড উদাপানিপিল্লাই এর কম্পোজিশন। নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন কীর্তি রামগোপাল।

দেভার্নামা-তে মা যশোদা ছোট্ট বালক কৃষ্ণ-কে বাইরের রাস্তায় কিংবা অন্য গোপীদের বাড়ি না গিয়ে বাড়িতে থেকে খেলাধুলায় মেতে থাকতে অনুরোধ করেন। দর্শক বিশেষত নৃত্য বিশেষজ্ঞ নয় এমন দর্শক এই পরিবেশনা খুব উপভোগ করেন। মানিওলাগআডোউ গোবিন্দা- এর রাগ বৃন্দাবাণী, তাল আদি, এটির কম্পোজিশন কবি পুরন্দর দাস। নৃত্য পরিচালনায় কীর্তি রামগোপাল।

জুয়েইরিয়াহ মৌলি-র সর্বশেষ পরিবেশনা ছিল কবি সুরদাস-এর একটি কম্পোজিশন। যেখানে তরুণী রাধা ঈর্ষান্বিত হয় কৃষ্ণকে অন্য গোপীদের সাথে অন্তরঙ্গ হতে দেখে। জোরপূর্বক ঝগড়া করার নিমিত্তে রাধা বলে উঠে, কৃষ্ণ যেন তার গরুগুলোকে রাঁধার গোয়াল ঘর থেকে সরিয়ে নেয়। রাধা আরও বলে যায় যে, তার গরু বরং উত্তম কৃষ্ণ এবং তার পিতার পালন করা গরুর চাইতে। রাধা দৃঢ়ভাবে বলে – ‘আমরা সমানে সমান!’

‘কারিগনারি হারি আপনি গায়েন’– এর রাগ হংসধ্বনি, তাল আদি। এর কম্পোজিশন করেছেন সুরদাস। নৃত্য পরিচালনায় গুরু ব্রাঘা বেসেল।

অনুষ্ঠান শেষে শিল্পী-র বক্তব্যে মৌলি কৃতজ্ঞতা জানান উপস্থিত সবাইকে। তার নৃত্যগুরুদের সবার প্রতি যারাই তার পথ চলায় তার পাশে থেকেছেন, সাধনার প্রধান লুবনা মরিয়মকে সর্বদা তাকে উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা যোগানোর জন্য এবং তার পরিবারকে তার পাশে থাকার জন্য।

ছবি: ফয়সাল জাফর

অনুষ্ঠান শেষে সাধনা-র প্রধান লুবনা মরিয়ম, মৌলির নৃত্যগুরু শ্রীমতি কীর্তি রামগোপাল সহ সংগীত আয়োজনে থাকা কর্ণাটকী বাদ্যযন্ত্র সংগীত শিল্পীদের সবাইকে মঞ্চে ডেকে নেওয়া হয়। এসময় স্বনামধন্য নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান মৌলিকে তাঁর সংগঠন বাংলাদেশ নৃত্য শিল্পী সংঘের পক্ষ থেকেও উত্তরীয় পরিয়ে দেন এবং মঙ্গল কামনা করেন।

ঢাকার মঞ্চে মৌলির যাত্রা সেই শৈশব থেকেই। তার নাচের শুরু হয় ছায়ানটে বেলায়েত হোসেন খান এবং কল্পতরু-তে শ্রী অমিত চৌধুরী-র হাত ধরে। ১৫ বছর ধরে ভরতনাট্যম চর্চার মধ্যে তিনি ওয়েস্ট বেঙ্গল ডান্স গ্রুপ ফেডারেশন থেকে গোল্ড মেডেল পেয়ে ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করেন। আই সি সি আর স্কলারশিপ নিয়ে ব্যাঙ্গালুরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১ম ক্লাসে মেধা তালিকায় ২য় স্থান অর্জন সহ মাস্টার্স সম্পন্ন করেন ভরতনাট্যমে। সেসময় নৃত্যগুরু কির্তী রাম গোপাল-এর কাছেও বিশেষ তালিম নিয়েছেন ভরতনাট্যম নৃত্যের। তিনি নৃত্য চর্চার শুরুতে তিন বছর শর্মিলা ব্যানার্জীর কাছেও মণিপুরী নৃত্যের উপর তালিম নিয়েছেন।

ছবি: জাকি জামান

তিনি খাজুরাহো নৃত্যোৎসব, আভায় প্রভাসী নৃত্যোৎসব (চেন্নাই), ষষ্ঠ গিড়নার মাহাৎসব (গুজরাট), এভরি ফ্রাইডে প্রোগ্রাম অব আই সি সি আর (ব্যাঙ্গালুরু), আরু আওরঙ্গবাদ উৎসব (আওরঙ্গবাদ), হসুর নাট্যাঞ্জলি (তামিলনাড়ু), সাঁই নৃত্যোৎসব (ব্যাঙ্গালুরু), বেঙ্গল ক্ল্যাসিকাল মিউজিক ফেস্টিভ্যাল-২০১৭ (ঢাকা), স্টারস অব টুমরো (কলকাতা) সহ দেশে বিদেশে নানান উল্লেখযোগ্য নৃত্যোৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং সম্মানিত নৃত্যগুরু ও সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতোন অনুষ্ঠিত হওয়া আন্তর্জাতিক নৃত্যোৎসব ওসেন ডান্স ফেস্টিভ্যাল-২০১৯ এর উদ্বোধনী দিনে মৌলি নিজের প্রযোজনায় ভরতনাট্যম নৃত্য ‘অর্ধ নারীশ্বর’ উপস্থাপন করেন। তিনি ভারতের সুরের নাট্যাঞ্জলি উৎসবে সম্মানজনক নাট্যাকালামনী অ্যাওয়ার্ড, ভারতের ‘গিড়নার রত্ন’ এওয়ার্ড এবং ব্যাঙ্গালুরুর ডান্স যাত্রী প্রতিযোগিতা-য় ২য় পুরস্কার অর্জন করেছেন।