স্থপতি ও নগর বিশেষজ্ঞদের প্রতিবাদের মধ্যেই গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে স্থাপত্য বিদ্যা এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার নিদর্শন দেশের প্রথম কৃষি গবেষণাগার। রাজধানীর খামারবাড়ির দ্বিতল এই ভবন থেকেই শুরু হয়েছিল কৃষিক্ষেত্রে প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণা; উৎপাদনে ঘটেছিল বিপ্লব। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের সাক্ষী এ ভবন সংরক্ষণের বদলে তাকে ধুলিস্মাৎ করে দেওয়া হলো।
শতবর্ষী এ ভবন হঠাৎ ভাঙা শুরু হলে স্থপতি, নগর বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলীদের প্রতিবাদের পর তা ভাঙা বন্ধ করতে মৌখিক নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু সে আদেশের শুনানি হওয়ার আগেই ভবনটি পুরোপুরি গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
বুধবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ভবনটি পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভাঙা অংশের উপাদানগুলো আলাদা করতে শ্রমিকরা ব্যস্ত রয়েছেন।
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে থাকা ভবনটির ব্যাপারে জানতে চাইলে বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক ড. মোঃ ফরিদ উদ্দিন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: এটাতো আগেই ভাঙা শুরু হয়েছিল। আর ভাঙার দায়িত্ব পেয়েছে পিডব্লিউটি (গণপূর্ত অধিদপ্তর)। তারা এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবে।
হাইকোর্টের আদেশের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন: আমরা মঙ্গলবার আদালতে গিয়েছিলাম। কিন্তু শুনানি হয়নি।
তবে পিডব্লিউডি দায় পুরোপুরি অস্বীকার করেছে বলেছে তাদের কোন কর্তৃত্ব নেই। যথাযথ অনুমোদন সাপেক্ষে তারা কেবল তুলা উন্নয়ন বোর্ডের হয়ে কাজটি করে দিচ্ছে।
যোগাযোগ করা হলে পিডব্লিউডি’র প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ওই ভবন রাখা না রাখার ব্যাপারে আমাদেরতো কোন কর্তৃত্বই নেই। সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে আমরা কেবল কাজটি করে দিচ্ছি। হাইকোর্টের আদেশের ব্যাপারেও তার কাছে কোন চিঠি আসেনি বলে জানান তিনি।
স্থপতি ও প্রকৌশলীদের মতে, কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের শুধু প্রথম কৃষি গবেষণাগার হিসেবেই নয়, রাজধানীর খামার বাড়ির দ্বিতল ভবনটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল স্থাপত্যবিদ্যা এবং প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন হিসেবেও। তারা বলেন, এই গবেষণাগারটি হতে পারতো স্থাপত্যবিদ্যা হাতে কলমে শিক্ষার একটি অপরিহার্য উপকরণ। একশ আট বছরের পুরনো ভবনটির ছিল প্রত্নতাত্তিক গুরুত্বও। ঐতিহ্যগতভাবে এর মর্যাদাও অনেক।
সম্প্রতি এ ভবনটি ভেঙে ফেলা শুরু করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অধীন তুলা উন্নয়ন বোর্ড । ভবনটির প্রায় অর্ধেকটা ভেঙে ফেলার পর স্থপতি ও প্রকৌশলীদের প্রতিবাদের মুখে সেটি ভাঙা স্থগিত রাখার মৌখিক নির্দেশনা দেন আদালত। গত বৃহস্পতিবার বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের বেঞ্চ মৌখিকভাবে ওই আদেশ দেন।
শনিবার ‘খামারবাড়ির শতবর্ষী কৃষি ল্যাবরেটরি ভবন ধ্বংসের প্রতিবাদে’ মানববন্ধন করে আরবান স্টাডি গ্রুপ, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ সংস্কৃতি সচেতন স্থপতি এবং নাগরিকবৃন্দ। মানববন্ধনে তারা ভবনটি ভাঙা বন্ধ করে পুননির্মাণ করে সংরক্ষণের জোর দাবি জানিয়েছিলেন। এর মধ্যেই তড়িঘড়ি করে ভেঙে ফেলা হল ঐতিহ্যবাহী এ ভবনটি।
ভবনটি ভাঙার ব্যাপারে ঠিকাদারের প্রতিনিধি বুধবার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: এখানে মানববন্ধন হওয়ার পর আমরা ভাঙা বন্ধ রেখেছিলাম। কিন্তু ‘বড় স্যারেরা’ তাড়া দিয়ে আমাদের বলেছেন বন্ধ করছো কেন? তাড়াতাড়ি ভাঙো।
ভবনটির গুরুত্ব তুলে ধরে স্থপতি সুতপা দাস চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেছিলেন: সারাদেশেই এমন ভবন বিরল। এর স্থাপত্য শৈলী এবং নির্মাণ কারুকার্য অসাধারণ। আধুনিক স্থপতিদের জন্য একটি গবেষণার বিষয়।
১৯৯৯ সালে বুয়েট থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক এ স্থপতি জানিয়েছিলেন, ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ভবনটি এতটাই উন্নত স্থাপত্যবিদ্যায় নির্মাণ করা যে এটি পরিবেশের সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাওয়ানো। এর ভেতরে এসির কোন দরকার নেই। কাঠের সিঁড়িগুলো এতটাই মজবুত এবং নান্দনিক যে আধুনিক যুগেও এমন নিদর্শন বিরল।
‘এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন আমরা কেন ধংস করে ফেলতে চাইছি? নতুন ভবন করতে হলে আমাদের কি আর জায়গা ছিল না? একজন স্থপতি হিসেবে আমি বুঝি এই ভবনটির গুরুত্ব কতটা।’
এটি ধ্বংস না করে বরং এটিকে একটি জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলা যেত বলে মত দিয়ে তিনি বলেন: এখানে প্রদর্শন করা যেত ব্রিটিশ আমল থেকে আমাদের কৃষির যত অর্জন তার সবকিছু। এতে একদিকে যেমন ভবনটি পর্যটকের আকর্ষণের বস্তুতে পরিণত হতো তেমনি আমাদের কৃষির ইতিহাস ও ঐতিহ্য দেখে অনুপ্রাণিত হতে পারতো বর্তমান প্রজন্ম। বিদেশীদের কাছেও আমরা গর্ব করে দেখাতে পারতাম আমাদের সমৃদ্ধ বিজ্ঞান নির্ভর অতীত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের সাবেক চেয়ারপার্সন মানসুবা তাবাসসুমের বাবা ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং মা ছিলেন এই গবেষণাগারটির প্রিন্সিপাল বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
এই গবেষণাগারটির অতীতে সমৃদ্ধির কথা তুলে ধরে চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলছিলেনন: আমার বয়স যখন ছয় বছর তখন আমি নিয়মিত মায়ের সঙ্গে এখানে আসতাম। তখন আমার মাকে দেখেছি এখানে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে কাজ করতে।
তবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষেই ভবনটি ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে দাবি করে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহি পরিচালক চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ২০১৩ সালেই ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। এরপর এই জায়গায় নতুন প্রকল্প পাশ হয় একনেকে। ভাঙার আগে আমরা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, নগর উন্নয়ন কমিটি, রাজউক এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়েরও অনুমতি নিয়েছি।
মাস কয়েক আগে সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর সরেজমিন পরিদর্শনে এসে ভবনটি ভাঙার অনুমতি দিয়ে গেছেন বলেও জানান তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক ড. মোঃ ফরিদ উদ্দিন।