গত কয়েক দিনের আলোচনার শীর্ষে রয়েছেন একজন। এই একজন কে, সেটা আর নতুন করে বলার অবকাশ নেই। সারা বিশ্ববাসী জেনেছে। তারা দেখছে শার্ট ছেঁড়া, ছেঁড়া প্যান্ট, মৃতপ্রায় চেহারার একটি ছবি। একটি আর্তনাদ। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ছবিটি দেখে প্রাথমিকভাবে সেই দেশ সম্পর্কে মানুষের ধারণা কি হচ্ছে? একটি অসভ্য এবং বর্বরতার নিদারুণ নমুনা বহন করছে ছবিটি। যেটা একটি দেশের জন্য চুড়ান্ত পর্যায়ের অপমানের।
ছবিতে বিধ্বস্ত অবস্থায় যাকে দেখা যাচ্ছে, তিনি একজন মানুষ। জন্ম সূত্রে তিনি বাংলাদেশের একজন নাগরিক। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন শিক্ষকতা। একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক তিনি। সেই স্কুলটিও তার নিজের গড়ে তোলা। পেশাগত দিক দিয়ে তার অভিজ্ঞতা দীর্ঘ কয়েক দশকের। এই কয়েক দশকে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। এমনকি ঘটনার পর সরকার থেকে দুটি তদন্তকারী টিম পাঠিয়ে খোঁজ খবর করেও, তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
অথচ তিনি শাস্তি পাচ্ছেন। কি ধরণের শাস্তি সেটা আমরা সবাই জেনেছি। শুধু তাই নয়। সেই শাস্তির ভিডিও ফুটেজও দেখেছি। একজন শিক্ষক কান ধরে উঠ-বোস করছে। পাশে দাঁড়িয়ে স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমান। পেছন থেকে শোনা যাচ্ছে, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ইসলাম ধর্মের অবমাননা করেছেন। অবমাননা’র শাস্তি সরূপ তাকে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করানোর সিদ্ধান্ত দেন সাংসদ সেলিম ওসমান। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন ধর্মে কী এমন শাস্তির বিধান রয়েছে? তাছাড়া একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে এহেন শাস্তি কিসের ঈঙ্গিত বহন করে?
বাংলাদেশের ইতিহাসে শিক্ষক নির্যাতন ঘটছে অহরহ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। বিচার না হওয়ার ফলে, এই ধরণের নির্যাতনের ঘটনা সমান্তরালে বাড়ছে। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই লাঞ্ছিত হলেন নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত। এর দু’দিন পরেই মানিকগঞ্জে খানবাহাদুর আওলাদ হোসেন খান উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামাল হোসেনের ওপর হামলা করে সন্ত্রাসীরা। সর্বশেষ (এখন পর্যন্ত) কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুজ্জামানকে কুপিয়ে আহত করেছে দুর্বৃত্তরা।
এর আগে ২০১৪ সালের ২২ জুন ময়মনসিংহের গৌরিপুরের মুমিনুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগে কর্মরত সহযোগী অধ্যাপক মো. ফরিদউদ্দিন আহমেদকে লাঞ্ছিত ও দিগম্বর করা হয়। এই ঘটনায় স্থানীয় সাংসদ মজিবুর রহমান-এর সংশ্লিষ্টার অভিযোগ ওঠে। ক্যাপ্টেন মুজিবের সংসদ সদস্যপদ বাতিল ও দল থেকে বহিষ্কারের দাবীতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করেছেন গৌরীপুরবাসী।
২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর ‘সামাজিক অবক্ষয়ের পোস্টার’ শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার মৈশামুণ্ডা গ্রামে ৭০ বছর বয়সী তৈয়ব আলী মাস্টারকে পিঠমোড়া করে বেঁধে মারতে মারতে দিন দুপুরে সমগ্র গ্রাম ঘুরানো হয়। এখানে অপরাধ তৈয়ব মাস্টারের নয়। তার পুত্র প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পাওনাদারকে অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি বলে পিতাকে পুত্রের কৃতকর্মের দায় নিতে হয়েছে। তৈয়ব মাস্টারের পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়, ঘটনায় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আলী আকবর শেখ, ইউপি সদস্য আশেক আলী ও স্থানীয় মাতব্বর জড়িত। তৈয়ব মাস্টারের পুত্রবধূ রেহানা বেগম বাদী হয়ে চাঁদপুর বিজ্ঞ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন। যেটার বিচার আজও শেষ হয়নি। ৫ ছেলে ও ১ কন্যার জনক তৈয়ব মাস্টার এখন গৃহবন্দি। তাকে দফায় দফায় হত্যার হুমকী দেয়া হচ্ছে। ঘটনাটি ঘটার পর, বিষয়টি বেশ প্রচার পেয়েছিলো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে। কিন্তু অদ্যাবধি কেউ করেনি সেই অপমানের বিচার।
নির্যাতনের এমন উদাহরণ আরও বহু আছে। স্কুল শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। সর্বক্ষেত্রে এহেন নির্যাতনের চিত্র দেখা যায়। একটি ঘটনার সাথে আরেকটি ঘটনার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। নির্যাতনের ক্ষেত্রে যোগ হয় নতুনত্ব। আমাদের সামনে ভেসে উঠে এমন বিভৎস দৃশ্য, যা আদিম বর্বরতাকে হার মানায়। শুধু দৃশ্য নয়। এমন অকথ্য ভাষার অডিও বার্তা আমরা শুনেছি, যেটা কোন সভ্য সমাজে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত সামাজিক এবং নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার। অপরাধের বিচার হবে না। সুতরাং অপরাধ করতে বাধা কোথায়? স্বীয় ক্ষমতা প্রদর্শন কার না ভালো লাগে! এখানে অতিরিক্ত বাহবা পাওয়ার বাসনা এবং অসীম ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে সেলিম ওসমান বিষয়টির সাথে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছেন। ফলে, এই ঘটনার আলোচনা এতো দীর্ঘায়িত। সরকার কিংবা বিরোধী দলের দৃঢ় কোন পদক্ষেপ আমরা দেখিনি। যদিও সরকারের ৭ জন মন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছেন। তারা এই ঘটনার বিচার করবেন বলে আশার বাণী শুনিয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী অসুস্থ শিক্ষককে দেখতে গিয়েছেন এবং সেটা নিয়েও নানান কাঁদা ছোড়াছুড়ি চলছে বিভিন্ন মহলে। তবে, ঘটনার সূচনা লগ্নে সামাজিক মাধ্যমগুলোসহ বিবিধ ক্ষেত্রে প্রতিবাদের যে ঝড় উঠেছিলো,সেটি অনেকাংশে দুর্বল হয়ে পড়েছে। সুতরাং এই ঘটনারও সুষ্ঠু বিচার নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
প্রকৃত অর্থে এই ঘটনা হচ্ছে মানবিক মর্যাদার অবমাননা এবং নাগরিকের অধিকার লাঞ্ছনা। এই বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ জরুরী। এটি শুধু একজন ‘একজন শিক্ষকের’ অবমাননা নয় এটি একজন নাগরিকের প্রতি আঘাত। বিষয়টি আদৌ ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক নয়। এটি সামাজিক অবক্ষয়ের চুড়ান্ত পর্যায়ের নিদর্শন। শিক্ষক হিসেবেই কেবল শ্যামল কান্তি ভক্ত মানবিক মর্যাদার দাবিদার নয়, বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এই মর্যাদার দাবিদার। অতীতের মতো এই ঘটনাও যদি আমরা ভুলে যাই এবং প্রতিবাদ স্ফীত হয়ে যায়, তাহলে এই ধরণের ঘটনা, আগেও যেমন ঘটেছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আগামীতেও ঘটবে। অন্যায়ের ধারাবাহিকতা যেন বজায় না থাকে সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় একটি পরিবারের কর্তা যদি কোন কারণে অনুপস্থিত থাকেন,তাহলে সেই পরিবারটি হুমকীর সম্মুখিন হয়ে পড়ে। আর সেটা যদি হয়, প্রভাবশালী ব্যক্তির আদলে, তাহলে তো রেহাই পাওয়া দুরূহ। সেজন্যে আন্দোলনের পাশাপাশি লাঞ্চিত শিক্ষকের পরিবারের নিরাপত্তা দেয়ার বিষয়টি আমাদের নজরে রাখা আবশ্যক। তার ৩ কন্যার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু রাষ্ট্র সেটা পালন করছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরী। মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ‘ফেসবুক’-এ শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের পরিবারের কথা ফোকাস পাচ্ছে না। অতীতেও আমরা এমনটি দেখেছি কিন্তু কোন শিক্ষা গ্রহণ করিনি।
আমরা আশা করবো অবিলম্বে এই বিষয়টির আশানুরূপ সুরাহা হবে। যে কোন ধরণের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। আমরা যদি অবস্থানচ্যুত হয়ে পরাজয় বরণ করি, তাহলে কী নিজেরা নিজেদের ক্ষমা করতে পারবো? যে বিবেক দংশন আমাদের প্রতিনিয়ত তাড়া করছে, তার থেকে মুক্তি মিলবে কবে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)